পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিতে বাড়ছে অন্তঃকোন্দল

২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের আগে হুগলিতে নির্বাচনী জনসভায় বক্তব্য দেন নরেন্দ্র মোদি
ফাইল ছবি: এএনআই

উত্তর প্রদেশসহ ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে চলছে নির্বাচনী প্রচার–প্রচারণা। এসব রাজ্যে জয় পেতে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার। মোদি ক্ষমতায় আসার পর পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির অবস্থান পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করেছে বিজেপি। এ জন্য তিনি ও অমিত শাহ বেশ কয়েকবার সফর করেছেন পশ্চিমবঙ্গে।

কিন্তু অনেক চেষ্টার পরও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হটিয়ে পশ্চিমবঙ্গে তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি বিজেপি। উল্টো গত বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকেই রাজ্য বিজেপির অন্দরে বেসুরে বাঁশি বাজতে শুরু করেছে। সর্বশেষ কলকাতা পৌর করপোরেশনের নির্বাচনে বিজেপি বিপুল ভোটে পরাজিত হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দলের অন্তঃকোন্দল প্রকাশ্যে আসে। দলের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একের পর এক দোষারোপের পালা চলে। শুরু হয় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব।

বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এই দ্বন্দ্ব সামাল দিতে মাঠে নামলেও ব্যর্থ হয়েছে বারবার। সম্প্রতি নতুন রাজ্য কমিটিতে দিলীপ ঘোষকে রাজ্য সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে সুকান্ত মজুমদারকে সামনে আনা হলেও তেমন একটা লাভ হয়নি। ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ৭৭ জন বিধায়কের মধ্যে ৬ জন দল ছেড়েছেন।

এই যখন অবস্থা, তখন সম্প্রতি বিজেপির মতুয়া সম্প্রদায়ের পাঁচজন বিধায়ক নতুন করে বিদ্রোহ করে বসেন। তাঁদের দাবি, বিজেপির রাজ্য ও জেলা কমিটিতে মতুয়া সম্প্রদায়কে যোগ্য নেতৃত্বে আনা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনে মতুয়া সম্প্রদায় একটি নির্ণায়ক শক্তি। বিধানসভার ২৯৪টি আসনের মধ্যে অন্তত ৮৩টি আসনে মতুয়া সম্প্রদায় প্রভাবশালী। তাঁদের অভিযোগ, রাজনৈতিক ময়দানে মতুয়ারা যথেষ্ঠ শক্তিশালী থাকা সত্ত্বেও সেভাবে এই সম্প্রদায়কে মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না। এ ধরনের নানা অভিযোগে রাজ্যের মতুয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতিনিয়ত ক্ষোভ বাড়ছে।

গত মঙ্গলবার মতুয়া মহাসংঘের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় জাহাজ চলাচল প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর মতুয়া সম্প্রদায়ের পাঁচ বিজেপি বিধায়কের সঙ্গে বৈঠক করেন। মতুয়াদের তীর্থভূমি উত্তর চব্বিশ পরগনার গাইঘাটার ঠাকুরবাড়িতে এই বৈঠক হয়। এ সময় হরিণঘাটা, বনগাঁ উত্তর, গাইঘাটা ও রানাঘাট দক্ষিণের বিজেপি বিধায়ক যথাক্রমে অসীম সরকার, অশোক কীর্তনিয়া, সুব্রত ঠাকুর ও মুকুটমণি অধিকারী উপস্থিত থাকলেও বনগাঁ দক্ষিণের বিধায়ক স্বপন মজুমদার অনুপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে শান্তনু ঠাকুরের কাছে নানা অভিযোগ তুলে ধরেন বিধায়কেরা। তাঁরা বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বারবার মতুয়াদের দাবি মানার কথা বললেও কার্যত সেটি উপেক্ষা করে গেছেন তাঁরা। এমন প্রেক্ষাপটে বৈঠকে উপস্থিত মতুয়া বিধায়কেরা অবিলম্বে তাঁদের দাবি মেনে মতুয়াদের যোগ্য মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানান।

এদিকে মতুয়া সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়ন প্রশ্নে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ হয়ে বিজেপির পাঁচ বিধায়ক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ছেড়েছেন। সর্বশেষ বিজেপির খড়গপুরের বিধায়ক অভিনেতা হিরণ চট্টোপাধ্যায় হোয়াটসঅ্যাপ ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

অপর দিকে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির নতুন কমিটি তৈরির সময় বাদ পড়েন কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু, সহসভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার, রাজ্য সম্পাদক রীতেশ তেওয়ারির মতো নেতারা। এটা মেনে নিতে পারেননি বিজেপির একাংশের নেতারা। ফলে তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন।

এরই মধ্যে শনিবার কলকাতার হেস্টিংস এলাকায় পোর্ট ট্রাস্টের অতিথিশালায় মতুয়া সম্প্রদায়ের বিধায়কদের নিয়ে বৈঠকে বসেন বিজেপির বিদ্রোহী নেতারা। সেখানে যোগ দেন মতুয়া সম্প্রদায়ের চার বিধায়ক—সুব্রত ঠাকুর, মুকুটমণি অধিকারী, অশোক কীর্তনিয়া ও আশীষ বিশ্বাস।

গতকালের বৈঠকে অংশ নেওয়া বিজেপি নেতারা দলের সাংগঠনিক সম্পাদক অমিতাভ চক্রবর্তীকে অপসারণের দাবি জানান। এমনকি বৈঠকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাঁদের দাবি না মানলে তাঁরা অন্য পথে যাবেন। এ ইঙ্গিতের পর পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নতুন করে প্রশ্ন উঠে এসেছে, তবে কি রাজ্য বিজেপি বিভক্ত হয়ে যাবে?

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বিভক্ত হবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর হয়তো ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে। কিন্তু রাজ্য বিজেপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক রাজ্যপাল তথাগত রায়ের এক টুইটবার্তায় পশ্চিমবঙ্গ বিজেপিতে ভাঙনের সুরই পাওয়া গেল। গতকালের ওই টুইটে তিনি লিখেছেন, ‘মৃত্যুর পথে এগোচ্ছে বঙ্গ বিজেপি। বিধানসভা ও পৌর ভোটের পরও আত্মবিশ্লেষণ নেই। গভীর অসুখ লুকিয়ে রাখলে সারে না, অসুখ লুকিয়ে রাখলে মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়।’