পশ্চিমবঙ্গে ৫০ বছরে এত ভোট পায়নি কেউ

এবার তৃণমূল ভোট পেয়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ। এর আগে ১৯৭২ সালে কংগ্রেস ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিল।

পশ্চিমবঙ্গের কালীঘাটে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস মোট ২১৩টি আসন পেয়েছে। ২০১৬ সালের নির্বাচন থেকে এবার আসন বেড়েছে দুটি। বেড়েছে ভোট পাওয়ার হারও। এবার তৃণমূল প্রায় ৪৮ শতাংশ (৪৭.৯৪%) ভোট পেয়েছে, যা তারা অতীতে কখনো পায়নি। বস্তুত ১৯৭২ সালের পর গত ৫০ বছরে এককভাবে কোনো দল পশ্চিমবঙ্গে এত বেশি ভোট পায়নি।

১৯৭২ সালে ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিল কংগ্রেস। আর পশ্চিমবঙ্গে ভোটের ৭০ বছরের ইতিহাসে ভোটপ্রাপ্তির দিক থেকে তৃণমূল এখন দ্বিতীয় স্থানে। এই প্রসঙ্গে তৃণমূল নেতা ও রাজ্যসভার সাংসদ শুখেন্দুশেখর রায় প্রথম আলোকে বলেন, এটা বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ একটা ঘটনা।

‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের মহিমা ও প্রভাবে কংগ্রেস ওই ভোট পেয়েছিল। আর এবারে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে সেই রেকর্ড আমরা ছুঁয়ে ফেললাম,’ বললেন সুখেন্দুশেখর রায়, যিনি সেই সময় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

বামফ্রন্টের ভোটও ৫০ শতাংশের ওপরে গিয়েছিল, সেটা ছিল তাদের জোটগত হিসাবে, একক দল হিসাবে নয়। সিপিআইএমসহ (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্ক্সিস্ট) কোনো বাম দল ৪৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ ভোটের কাছাকাছিও যায়নি। ১৯৭২ সাল বাদ দিলে গত ৭০ বছরে এককভাবে কোনো দলের এটাই সবচেয়ে বেশি ভোটপ্রাপ্তি।

বিজেপির অর্জনও কম নয়

এই নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অর্জনও কম নয়। তারা এত আসন এর আগে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় পায়নি। বিজেপির জন্মের অনেক আগে, ১৯৫১-৫২ সালের প্রথম নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদী দল হিন্দু মহাসভা ও ভারতীয় জনসংঘ—দুই দল মিলে ১৩টি আসন পেয়েছিল। এই জনসংঘ থেকেই ১৯৮০ সালে বিজেপির জন্ম হয়। ফলে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ যখন এবার বিজেপির ৭৭টি আসন পাওয়াকে ‘খুব বড় সাফল্য’ বলে বর্ণনা করেন, তখন খুব অতিরঞ্জিত কিছু নয়।

রোববার রাতে বিধানসভার ভোটের ফল প্রকাশের পর তাৎপর্যপূর্ণ আরেকটি ঘটনা সামনে এসেছে। আট দফা নির্বাচনের প্রথম কয়েকটি দফার পরই ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহসহ অন্যান্য বিজেপি নেতা বলতে শুরু করেন, তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠতায় (১৪৮ আসন) পৌঁছে গিয়েছেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, প্রথম পাঁচ দফার পর তৃণমূল কংগ্রেস বরং ১৬৬–তে পৌঁছে গিয়েছিল, আর বিজেপি পৌঁছেছিল ৪২-এ। মোটামুটি প্রতি দফা ভোটেই বিজেপির থেকে তৃণমূল কংগ্রেস অনেকটা এগিয়ে ছিল। চতুর্থ দফায় ৪১টি আসনে ভোট গ্রহণ হলেও বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ২টি আসন। তৃতীয়, ষষ্ঠ ও অষ্টম দফাতেও বিজেপি খুব খারাপ ফল করেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিজেপির রাজ্য স্তরের এক নেতা দলের দুটি দুর্বলতার কথা বললেন, যা তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত বলে তিনি জানালেন। প্রথমত সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের পদে থাকা সুব্রত চ্যাটার্জিকে সরানো হয়েছিল নির্বাচনের কয়েক মাস আগে। এখন মনে হচ্ছে, এটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।

দ্বিতীয়ত, এক লাখের ওপরে বুথ থাকলেও সেই বুথ ও অঞ্চল দেখাশোনার জন্য বুথপিছু ১০ জন সদস্য দরকার। যার অর্থ ১০ লাখের ওপরে কর্মী থাকা দরকার, যা পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির নেই। ‘এটা দেখা দরকার—কোথায় আমরা এজেন্ট দিতে পারিনি এবং অন্য দলের লোকেরা আমাদের এজেন্ট হয়ে কোথায় কাজ করেছেন,’ বলেন বিজেপির ওই নেতা। তিনি জানান, দলের ভেতরে কাটাছেঁড়ার কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।

বাম–কংগ্রেস কি হারিয়ে যাচ্ছে

ভারতের প্রথম নির্বাচন হয়েছিল ১৯৫১-৫২ সালে। তারপর এই প্রথম বামপন্থী ও কংগ্রেস কোনো আসন পেল না। কাটাছেঁড়ার কাজ যে তাদের শিবিরেও শুরু হয়েছে, তা জানিয়েছেন দুই দলের নেতৃত্ব। বামফ্রন্ট ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, এবার সেটা কমে হয়েছে ৫ দশমিক ৬৭। কংগ্রেসের ভোট ৫ দশমিক ৫ থেকে কমে হয়েছে ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

এবার বিধানসভায় একটা আসনেও জেতেনি বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস। তাদের সঙ্গে জোটে থাকা আব্বাস সিদ্দিকীর দল ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ) কেবল একটি আসন পেয়েছে।

বামফ্রন্টের ভোট প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী রণবীর সমাদ্দার প্রথম আলোকে বলেন, বাম রাজনীতিতে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। বামফ্রন্টের ভালো ছেলে–মেয়ে ও কর্মীরা তৃণমূলকে ভোট দিলেন আর অপেক্ষাকৃত ক্ষমতালোভী, দুর্নীতিগ্রস্ত অংশটা চলে গেল বিজেপিতে। এটা কয়েক বছর ধরেই হচ্ছে। এই নির্বাচনেও হয়েছে।

রণবীর সমাদ্দারের মতে, ‘গরিবদের, মুসলমানদের কী করে ধরে রাখা যায়, দুর্নীতিগ্রস্তদের সরিয়ে কীভাবে নতুন ছেলেমেয়েকে দলে টানা যায় এবং তাদের কীভাবে প্রার্থী করা যায়—এ নিয়ে যে সামান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে, তা তৃণমূল কংগ্রেসেই হচ্ছে। তাদেরই এখন প্রকৃত বাম দল বলতে হবে।’

তৃণমূল কংগ্রেস থেকে যাঁরা বেরিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে শুভেন্দু অধিকারীসহ মোট দুজন জিতেছেন এবারে। রণবীর সমাদ্দারের মতে, দুর্নীতিগ্রস্তদের দল থেকে সরিয়ে ভালোই করেছে তৃণমূল।
তবে মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোট কোন দিকে বেশি গেছে, তা এখনো খুব একটা স্পষ্ট নয়। সব আসনের ফল পৃথকভাবে সামনে এলে তা বোঝা যাবে। তৃণমূলের তরফে তাদের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ও বিজেপির সাংসদ শান্তনু ঠাকুর দুজনেই দাবি করেছেন, নমশূদ্র ও মতুয়া ভোট তাঁদের সঙ্গেই রয়েছে।