পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে আবার তৎপর মাওবাদীরা

পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহল এলাকা
ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

পশ্চিমবঙ্গের মাওবাদী–অধ্যুষিত জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের ছায়া পড়েছে। শান্ত জঙ্গলমহল ফের অশান্ত হয়ে উঠছে। মাওবাদীরা জানান দিচ্ছে, তারা এখনো জঙ্গলমহলে আছে এবং থাকবে।

ঝাড়খন্ড রাজ্য লাগোয়া ছোট পাহাড় ও জঙ্গলবেষ্টিত তিনটি জেলা নিয়ে জঙ্গলমহলের অবস্থান। জেলা তিনটি হলো পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া। পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনকে ঘিরে ধীরে ধীরে অশান্ত হয়ে উঠছে পরিবেশ। গত আগস্ট মাস থেকে শুরু হয়েছে নতুন তৎপরতা। দল ধরে এলাকায় শুরু হয়েছে টহল। গ্রামে গ্রামে পড়ছে পোস্টার। কোনো কোনো গ্রামে টাকা চেয়ে শুরু হয়েছে হুমকি।

২০১১ সালে বামফ্রন্ট সরকারের সর্বশেষ রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের আগে অশান্ত হয়ে উঠেছিল এই জঙ্গলমহল। মাওবাদীরা সংঘবদ্ধ হয়ে বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে প্রকারান্তরে ‘বিদ্রোহ’ ঘোষণা করেছিল। মাওবাদীরা বামফ্রন্টকে ক্ষমতা থেকে হটানোর ডাক দিয়েছিল। সেখানে মাওবাদীদের শীর্ষ নেতা কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেণজি ছিলেন মূল মাথা। তাঁর নেতৃত্বেই চলছিল মাওবাদীদের তৎপরতা। জঙ্গলমহলকে রূপ দিয়েছিল অনেকটা ‘মুক্ত এলাকা’ হিসেবে।

এই জঙ্গলমহলের লালগড়ের জামবনী এলাকায় ২০০৮ সালের ২ নভেম্বর জিন্দাল গোষ্ঠীর একটি স্টিল প্ল্যান্টের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে ফিরছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামবিলাস পাশোয়ান প্রমুখ। ওই সময় মাওবাদীরা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে হত্যার জন্য সড়কে পুঁতে রাখে স্থলমাইন। কিন্তু মাইন বিস্ফোরণের নির্দিষ্ট সময়ের একটু আগে রাস্তা পার হয়ে যায় মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি। তবে পুলিশের পাইলট কার ওই দুর্ঘটনায় পড়ে। এতে ছয়জন পুলিশ সদস্য আহত হন।

২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময় পশ্চিমবঙ্গের বিরোধীদলীয় তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা দেন, নির্বাচনে তাঁর দল ক্ষমতায় এলে মাওবাদীদের সমস্যার সমাধান করবেন। তাদের দাবিদাওয়া মেনে নেবেন। তাদের জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেবেন। মমতার এই ডাকে সাড়াও মেলে মাওবাদীদের।

মাওবাদীদের একাংশ মমতার পাশে এসেও দাঁড়ায়। তাঁর পাশে দাঁড়ান জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ‘পুলিশি সন্ত্রাসবিরোধী জনগণের কমিটির’ নেতা ছত্রধর মাহাত।

২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচন জয়ী হন মমতা। রাজ্যে অবসান হয় ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের। মমতা ক্ষমতায় আসার পর উদ্যোগ নেন জঙ্গলমহলে শান্তি ফেরানোর। ডাক দেন মাওবাদীদের অস্ত্র সমর্পণের। সেই ডাকে মাওবাদীদের একাংশ সাড়া দেয়। তাদের জীবনের মূল¯স্রোতে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন আর্থিক প্যাকেজ দেন, ব্যবস্থা করেন পুনর্বাসনের। কিন্তু তাতে কট্টরপন্থী মাওবাদীরা সাড়া দেননি। কিষেণজিও সাড়া দেননি। ফলে, মমতা জঙ্গলমহলে শান্তি ফেরাতে অস্ত্র ধরেন কিষেণজির বিরুদ্ধে। অবশেষে জঙ্গলমহলের শীর্ষ এই মাওবাদী নেতা পুলিশের সঙ্গে এক লড়াইয়ে মৃত্যুবরণ করেন ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর।

কিষেণজির মৃত্যুর পর জঙ্গলমহলে মাওবাদী তৎপরতা ধীরে ধীরে কমতে থাকলেও কিছুদিন পর মাওবাদীদের অন্য নেতারা গোপনে শুরু করেন তৎপরতা। এর নেতৃত্ব দেন মাওবাদী নেতা আকাশ। সেই তৎপরতা এখনো চলছে গোপনে জঙ্গলমহলজুড়ে।

তবে এই মাওবাদীরা দিনের বেলা জঙ্গলমহলে তৎপরতা চালালেও রাতের বেলা তাঁরা পাশের ঝাড়খন্ড রাজ্যের পূর্ব সিংভুম জেলায় রাত কাটান। এভাবেই চলছে মাওবাদীদের তৎপরতা।

জঙ্গলমহলের একটি গ্রাম
ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

এদিকে ২০২১ সালের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন এগিয়ে এলে ফের তৎপরতা বাড়তে থাকে মাওবাদীদের। ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসের দিন লাবণী গ্রামে কালো পতাকা তোলে মাওবাদীরা। ২৭ আগস্ট পচাপানি গ্রামে টাকা চেয়ে পোস্টার লাগায়। তারা এক গ্যাস ডিলারের কাছে টাকা চেয়ে তাঁর বাড়িতে গুলিবর্ষণও করে। ৩ সেপ্টেম্বর বেলপাহাড়ির ঢাঙ্গিগ্রামে পর্যটকদের মোবাইল ছিনতাই আর ৪ সেপ্টেম্বর সিন্দুরিয়ার রাস্তায় ঠিকাদার সৌরভ রায়ের কাজ বন্ধ করার হুমকি দিয়ে পোস্টার লাগায়। এসব ঘটনার মাধ্যমে মাওবাদীরা জানান দিতে শুরু করে যে তারা এখনো তৎপর।

মাওবাদীরা ডাঙ্গিকুসুম এলাকায় একটি পর্যটক দলের মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটায়। ৩ সেপ্টেম্বর পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়গপুরের একটি পর্যটক দল ঘুরতে গিয়েছিল জঙ্গলবেষ্টিত এই ডাঙ্গিকুসুমে। সেখানে তাঁরা পাহাড়ের লেকে নেমে গোসল করেন। তারপর ফেরার পথে তাঁরা সাতজনের এক মাওবাদী দলের মুখোমুখি হন। এই মাওবাদীরা মুখ ঢেকে গামছা বেঁধে তাঁদের সামনে এসে পড়ে। এই দলে তিন নারী মাওবাদী ছিলেন। তাঁদের মুখও ঢাকা ছিল। মুখোমুখি হওয়ার পর মাওবাদীরা ছবি তুলতে নিষেধ করে। এরপরে তারা পর্যটকদের মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। ওই পর্যটকেরা এলাকা ছেড়ে খড়গপুরে চলে আসার সময় মাওবাদীরা ফিরিয়ে দেয় তাঁদের মোবাইল। এই দলে থাকা তিন নারী মাওবাদী হলেন জবা, শ্যামলী ও মিতা। এর আগে নারী মাওবাদী নেত্রী জাগরি, সুচিত্রা, তারাসহ অনেকেই আত্মসমর্পণ করে জীবনের মূল¯স্রোতে ফিরে এসেছেন।

এসব তৎপরতার মুখে পুলিশ সূত্রে বলা হয়েছে, এই জঙ্গলমহল থেকে কাশ্মীরে ফিরে যাওয়া ৩ কোম্পানি কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনী বা সিআরপিএফকে ফের ফিরিয়ে আনা হচ্ছে জঙ্গলমহলে।

এই ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আসার পর তৎপর হয়ে পড়ে রাজ্য পুলিশ। গতকাল শনিবার রাজ্য পুলিশের ডিজি বা মহাপরিচালক বীরেন্দ্র ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করেন। বৈঠক করেন ঝাড়গ্রামের পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে।