প্রিয়াঙ্কার প্রচার, মায়াবতীর গোসসা

বিএসপির প্রধান মায়াবতী
বিএসপির প্রধান মায়াবতী

পরিচালক সাঈদ আখতার মির্জার সেই বিখ্যাত হিন্দি চলচ্চিত্রটির কথা নিশ্চয় মনে আছে। অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ, শাবানা আজমি, স্মিতা পাতিল, ওম পুরীর সেই মারমার কাটকাট চলচ্চিত্রটির নাম ছিল ‘অ্যালবার্ট পিন্টো কো গুসসা কিউ আতা হ্যায়’। সব সময় রেগে থাকতেন মোটর মেকানিক অ্যালবার্ট পিন্টো (নাসিরুদ্দিন শাহ)। একদিন তাঁর বোধোদয় হলো, অর্বাচীন শ্রমিকেরা নয়, ধনী বুর্জোয়া মালিকেরাই যত নষ্টের গোড়া। সেই সিনেমার নাম ধার করে এই লেখার শিরোনাম দেওয়া যেতে পারে, মায়াবতী কো গুসসা কিউ আতা হ্যায় (মায়াবতী কেন রাগ করেন)।

সত্যিই রেগে রয়েছেন বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী মায়াবতী। রেগে আছেন কংগ্রেসের ওপর।

কিংবা আরও সহজ করে বলা যেতে পারে, কংগ্রেসের ভাই-বোনের জুটি রাহুল-প্রিয়াঙ্কার ওপর। এই মুহূর্তে তাঁরাই বহেনজির চোখের বালি। কেননা, মায়াবতীর উপলব্ধি, এই জুটি আখেরে ক্ষতি করছে তাঁরই।

বিজেপিকে থামাতে উত্তর প্রদেশে সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টির জোটে কংগ্রেস যোগ দিক, মায়াবতী তা একেবারেই চাননি। না চাওয়ার দুটি কারণ—প্রথমটি, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশের বিধানসভা ভোটে তাঁর দলকে কংগ্রেসের কল্কে না দেওয়া। তাঁর দাবিমতো আসন দিতে ওই দুই রাজ্যে কংগ্রেস রাজি হয়নি। ক্ষুব্ধ মায়াবতী উত্তর প্রদেশে তার শোধ তোলেন কংগ্রেসকে জোটে না নিয়ে। দলিত নেত্রীর যুক্তি ছিল, কংগ্রেসের উচ্চবর্ণের ভোট দলিত বা অনগ্রসরদের দিকে কখনো যায় না। চলে যায় বিজেপিতে। অতএব কংগ্রেসকে জোটে নিলে লাভের চেয়ে লোকসান বেশি। যুক্তি যে অসাড়, তা নয়। কংগ্রেসের উপলব্ধিও তা-ই। কংগ্রেস তাই একা লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত মায়াবতীর গাত্রদাহ আরও বেশি বাড়িয়ে তোলে। আজ তাই তিনি উঠতে-বসতে গাল পাড়ছেন কংগ্রেসকে।

এই ক্ষোভের একটা বড় কারণ অবশ্যই প্রিয়াঙ্কা। উত্তর প্রদেশের যে অংশের ভার প্রিয়াঙ্কার হাতে, সেই পূর্বাঞ্চল মায়াবতীর ক্ষমতার ভরকেন্দ্র। প্রিয়াঙ্কা সেখানে বিশেষ নজর দিয়েছেন দলিত জনগণের দিকে, যাঁরা এতগুলো বছর ধরে মায়াবতীকেই তাঁদের ত্রাতা বলে মেনে এসেছেন। মায়াবতীর নিজের জাত ‘জাটভ’ ছাড়া মাল্লা, নিষাদ, কৌরির মতো ছোট ছোট তপসিলি জাতির মানুষজনের মাঝে চলে যাচ্ছেন প্রিয়াঙ্কা, অবলীলায় মিশে যাচ্ছেন, বুনে দিতে চাইছেন সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন। প্রকাশ্যেই জানাচ্ছেন, এই বছরের লোকসভার ভোট নয়, তাঁর নজরে রয়েছে ২০২২ সালের রাজ্য বিধানসভার ভোট। প্রমাদ গোনারই কথা মায়াবতীর। তাই ৭২ হাজার টাকার ন্যূনতম আয় নিশ্চিত করার কংগ্রেসি প্রকল্প ‘ন্যায়’-এর ঘোষণাকে তিনি আজগুবি খোয়াব বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। বিজেপিকে সরানোর পাশাপাশি তিনি চাইছেন শতাব্দীপ্রাচীন কংগ্রেস যেন উত্তর প্রদেশে পায়ের তলায় শক্ত জমির সন্ধান না পায়।

সেই জন্যই রাহুল যখন রাজ্যের ৮০টি আসনেই প্রার্থী দেওয়ার কথা বলেন, মায়াবতী ঠাট্টা করে বলেছিলেন, কংগ্রেসকে অণুবীক্ষণযন্ত্রের খোঁজ করতে হবে। মায়াবতীর গোসসা আরও বাড়ে ‘ভীম সেনা’র প্রধান চন্দ্রশেখর ওরফে রাবণের সঙ্গে প্রিয়াঙ্কা দেখা করায়। দলিত চন্দ্রশেখরকে মায়াবতী তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ধরে নিয়েছেন। ২৮ বছরের এই তরুণ দলিত মন সেইভাবে আন্দোলিত করেছেন ৩০ বছর আগে কাঁসিরামের নেতৃত্বে মায়াবতী যা করতে পেরেছিলেন। রাবণ কাছে আসতে চেয়েছিলেন মায়াবতীর। ভীত ও সন্ত্রস্ত মায়াবতী তাঁকে জায়গা দেননি ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কায়। বরং চন্দ্রশেখরকে বিজেপির দালাল বলে অভিহিত করেছেন। সেই তরুণের সঙ্গে দেখা করে প্রিয়াঙ্কা বুঝিয়ে দিয়েছেন, রাজ্যে হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করতে গেলে দলিত মন জিততে হবে। জোটের দরুন যে আসনগুলো মায়াবতীর হাত থেকে বেরিয়ে গেছে, সেখানে তাঁর অনুগামীদের বেছে বেছে কংগ্রেসের প্রার্থী করেছেন রাহুল।
উত্তর প্রদেশে রাহুল-প্রিয়াঙ্কার কৌশল দ্বিমুখী—ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যর মতো উচ্চবর্ণের ঐতিহ্যগত ভোট টেনে বিজেপির পথে কাঁটা বিছানো। পাশাপাশি দলিত মন জিতে ভবিষ্যতের পথ প্রস্তুত করা। দলে প্রিয়াঙ্কার অন্তর্ভুক্তির পর রাহুল বলেছিলেন, ওয়ান ডে ক্রিকেটের জন্য প্রিয়াঙ্কাকে দলে আনা হয়নি। নজরে তাঁর টেস্ট ম্যাচ। প্রিয়াঙ্কা লম্বা রেসের ঘোড়া। মায়াবতীর কপালে তাই চিন্তার ভাঁজ। গোসসার কারণও সহজবোধ্য।