ভারত ছাড়ল হারলি ডেভিডসন, পুনর্গঠন ব্যয় সাড়ে ৭ কোটি ডলার

ভারতে ২০১১ সালে ব্যবসা শুরু করে হারলি ডেভিডসনছবি: কোম্পানির ওয়েবসাইট

ভারত ছাড়ছে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বিলাসী মোটরসাইকেল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হারলি ডেভিডসন। ভারত ছাড়ার কারণে সংস্থাটির ৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পুনর্গঠন ব্যয় (রিস্ট্রাকচারিং কস্ট) হবে। সংস্থাটি এক বিবৃতির বরাত দিয়ে হিন্দুস্তান টাইমসের খবরে এ কথা বলা হয়েছে।

ভারত ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে সংস্থাটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, চলতি বছরের ৬ আগস্ট থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্লোবাল ডিলার নেটওয়ার্ক, আন্তর্জাতিক বাজার, ভারতে বিক্রি ও মোটরসাইকেল তৈরি বন্ধ করে দেওয়া–সংক্রান্ত বিষয়ে অতিরিক্ত রিস্ট্রাকচারিং অ্যাকশনে সম্মতি দিয়েছে কোম্পানি।

গত দুই মাস আগে হারলি ডেভিডসন জানিয়ে দেয়, আপাতত হারলি ডেভিডসন নজর দিতে চায় উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দিকে।

তারা যুক্তরাষ্ট্রের মতো চালু বাজার ধরতে আরও জোর দেওয়া ও লাভজনক মোটরসাইকেল তৈরির পথে হাঁটতে চায়। এ ছাড়া ছোট বাজার থেকে বেরিয়ে যেতে চায় সংস্থাটি। পুনর্গঠন ব্যয়ের ৭৫ মিলিয়ন (সাড়ে ৭ কোটি) ডলারের মধ্যে ৮০ শতাংশ নগদ ব্যয় হবে। এর মধ্যে প্রায় ৩ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে কর্মী ছাঁটাইসংক্রান্ত এককালীন খরচ বাবদ। প্রায় ৫ মিলিয়ন ডলারের নন–কারেন্ট অ্যাসেট অ্যাডজাস্টমেন্ট ও চুক্তি শেষ করা এবং অন্যান্য খরচসহ প্রায় ৬৭ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হবে সংস্থাটিকে।

আগামী ১২ মাসের মধ্যে এই পুনর্গঠনসংক্রান্ত যাবতীয় কাজ তারা সেরে ফেলতে চায়।
হারলে ডেভিডসন জানিয়েছে, এ বছর তাদের মোট পুনর্গঠন ব্যয় দাঁড়াবে ১৬৯ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ভারতে ৭০ জনের মতো কর্মী ছাঁটাইয়ের খরচ ধরা আছে। করোনাসহ নানা কারণে ভারতে ব্যবসা ভালো হচ্ছিল না হারলির। তাদের মোট বিক্রির ৫ শতাংশেরও কম বিক্রি হয় ভারতে। তারপর করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতির মুখে পড়েছে সংস্থাটি।

৩৫টি ডিলারশিপ বন্ধ, কাজ হারাবেন ২০০০ মানুষ

এদিকে চটজলদি ভারত থেকে ব্যবসা গোটানোর সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হারলির ডিলাররা। কারণ অনেক টাকা ব্যয় করে ডিলারশিপ নেওয়া হয়েছিল শুধু হারলির মোটরবাইক বেচবেন বলে। আসল বিপদে পড়েছেন তাঁরাই। ডিলারদের সংগঠন ফাডার অভিযোগ, এতে বহু মানুষের ক্ষতি হবে। ৩৫টি ডিলারশিপ বন্ধ হওয়ায় কাজ হারাবেন ২০০০–এর বেশি মানুষ।

হারলির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা ব্যবসা বন্ধ করলেও সহযোগীদের সঙ্গে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী ভারতীয় ক্রেতারা ডিলারদের পরিসেবা পাবেন। ভবিষ্যতেও ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলবে সংস্থা এবং প্রয়োজনে সহায়তা দেবে। তবে কাজ হারাবেন প্রায় ৭০ জন কর্মী।

তবে অপর একটি সূত্রের খবর, মোটরবাইক তৈরি বন্ধ করলেও ভারতে বিক্রি–বাট্টা চালাতে আগ্রহী হারলি ডেভিডসন। এ জন্য হিরো মোটো করপোরেশনের সঙ্গে কথা চলছে। সূত্রটির দাবি, ডিস্ট্রিবিউশনসংক্রান্ত ওই চুক্তি হলে হিরো হারলির বাইক আমদানি করে বিক্রি করতে পারবে।

হারলি ডেভিডসনের প্রায় ১২টি মডেলের মোটরসাইকেল ভারতে বিক্রি হচ্ছিল
ছবি: কোম্পানির ওয়েবসাইট

করোনাভাইরাসের কারণে ব্যবসায় মন্দা চলছে বিশ্বের অনেক বড় কোম্পানির। ধস নেমেছে বিক্রি-বাট্টায়। নানা কারণে ভারতে ক্রমেই বিক্রি কমছিল হারলির মোটরসাইকেলের। কোভিড-১৯ মহামারিতে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করে। গেল আর্থিক বছরে ভারতে আড়াই হাজার ইউনিটের কম মোটরসাইকেল বিক্রি করতে পেরেছে হারলি ডেভিডসন।

এ বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাসে ১০০টি বাইক বিক্রি করেছে মার্কিন কোম্পানি। এ কারণে সম্প্রতি একাধিক মডেলের দাম কমিয়ে দিয়েছিল মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি। কোম্পানিটি মধ্যবিত্তের মধ্য বিলাসী মোটরসাইকেলটিকে জনপ্রিয় করার জন্য ২০১৮ সালের জুলাইয়ে ২৫০ সিসির বাইক দুই বছরের মধ্যে বাজারে ছাড়ার ঘোষণা দেয়। এর মধ্যে হারলি তার দুটো মডেলের দাম ৬৫ হাজার থেকে ৭৭ হাজার রুপি পর্যন্ত কমিয়ে দেয়। কিন্তু তবুও বাড়েনি বিক্রি।

‘দ্য হিন্দু’র খবরে বলা হয়েছে, কম বিক্রি এবং ভবিষ্যতে চাহিদা বৃদ্ধি করার মতো পরিস্থিতি না থাকায় এক দশকের মধ্যে ভারত ছাড়ছে হারলি ডেভিডসন।

কিছুদিন আগেই ভারতীয় মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারী সংস্থা রয়্যাল এনফিল্ডের সঙ্গে প্রতিযোগিতার জন্য ৩৩৮ সিসির মোটরসাইকেল এনেছিল হারলি ডেভিডসন।

এনফিল্ডের বুলেট ব্র্যান্ডের মোটরবাইকের মোকাবিলায় এ মোটরসাইকেল এনেছে মার্কিন সংস্থাটি। কিন্তু বিক্রি ভালো হয়নি।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে কম বয়সী ক্রেতাদের মধ্যে দামি মোটরসাইকেল কেনার ক্ষমতা না থাকায় ঘরোয়া বাজারে আগেই বিক্রিতে মার খেয়েছে হারলি ডেভিডসন।

ভারতের হারলির বিক্রি হওয়া বাইকগুলোর দাম ৫ থেকে ৩৮ লাখ রুপির মধ্য
ছবি: কোম্পানির ওয়েবসাইট

২০১১ সালে ভারতের হরিয়ানার বাওয়ালে কারখানা তৈরি করে ব্যবসা শুরু করে মোটরসাইকেল তৈরিতে বিখ্যাত হারলি ডেভিডসন। এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোটরসাইকেলের বাজার। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দেশটিতে বিলাসবহুল মোটরসাইকেলের চাহিদাও দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় হারলি দেশটিতে ব্যবসা শুরু করে।

ভারত মূলত কম দামি ও অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী মোটরসাইকেলের অন্যতম বৃহৎ বাজার।

তবে বৃহৎ মধ্যবিত্ত জনসংখ্যার পাশাপাশি উচ্চবিত্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে দেশটিতে দামি ও বিলাসবহুল মোটরসাইকেলের ব্যাপকভিত্তিক বাজার তৈরি হয়েছে।

হারলি ডেভিডসনের প্রায় ১২টি মডেলের আমদানি করা মোটরসাইকেল ভারতের বড় শহরগুলোতে ৫ লাখ থেকে ৩৮ লাখ রুপি মূল্যে বিক্রি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভারত সফরের আগে হারলি ডেভিডসনের পক্ষ থেকে ভারতে ২০১১ সালের মোটরসাইকেল তৈরির ঘোষণা দেওয়া হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের পর হারলি ডেভিডসন কেবল ব্রাজিলেই এ ধরনের কারখানা তৈরি করেছিল। ভারত হবে তৃতীয় দেশ, যেখানে হারলি ডেভিডসন মোটরসাইকেল তৈরির জন্য কারখানা স্থাপন করছে। চীনের পর ভারতই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোটরসাইকেলের বাজার।

দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে দেশটিতে ধনবান মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ায় বিলাসবহুল ও ফ্যাশনেবল মোটরসাইকেলের বাজার সৃষ্টি হয়েছে। বাজারটি ধরাই হারলি ডেভিডসনের উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু না জমায় ব্যবসা শুরুর দশকের মধ্যে ব্যবসা গোটাচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশের কোম্পানিটি। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় হারলি ডেভিডসন দ্বিতীয় মার্কিন গাড়ি নির্মাতা সংস্থা, যারা ভারত ছাড়ছে। এর আগে ২০১৭ সালে গুজরাটে নিজেদের কারখানা বন্ধ করে দেয় জেনারেল মোটরস।