ভারতে তৈরি করোনা টিকা নিয়ে যত কথা

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার যৌথ উদ্যোগে সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ায় প্রস্তুত হয় করোনা প্রতিষেধক ‘কোভিশিল্ড’
এএফপির প্রতীকী ছবি

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে বিশ্বের সর্ববৃহৎ টিকাদান কর্মসূচি শুরু করেছে ভারত। এর এক সপ্তাহ না যেতেই কোভিড-১৯–এর লাখ লাখ ডোজ টিকা প্রতিবেশী কয়েকটি দেশকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে দেশটি। একে ‘টিকা কূটনীতি’ বলে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে।

ভারতের ওষুধ প্রশাসন করোনায় কোভিশিল্ড (যুক্তরাজ্যে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার স্থানীয় নাম) ও কোভ্যাক্সিন নামে স্থানীয় ওষুধ প্রতিষ্ঠান ভারত বায়োটেকের উৎপাদিত টিকা ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে। বিশ্বে টিকার ৬০ শতাংশই উৎপাদিত হয় ভারতে। দেশটিতে রয়েছে টিকা উৎপাদনের অর্ধডজন বড় প্রতিষ্ঠান।

কোভিশিল্ড কীভাবে কাজ করে?

ভারতে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করছে সেরাম ইনস্টিটিউট। বিশ্বের সর্ববৃহৎ টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এটি। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, তারা মাসে পাঁচ কোটির বেশি ডোজ টিকা তৈরি করছে।

শিম্পাঞ্জির সাধারণ ঠান্ডাজনিত সমস্যার জন্য দায়ী ভাইরাসের (অ্যাডেনোভাইরাস) নতুন সংস্করণ থেকে তৈরি করা হয়েছে কোভিশিল্ড। দেখতে অনেকটা করোনাভাইরাসের আদলে হলেও এটির প্রয়োগে অসুস্থতা দেখা দেবে না।

যখন কোভিশিল্ড একজন ব্যক্তির শরীরে প্রয়োগ করা হয়, তখন তা করোনার বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা সৃষ্টিতে অ্যান্টিবডি তৈরির কাজ শুরু করে। পরবর্তী সময়ে যেকোনো ধরনের করোনার সংক্রমণ থেকে তাঁকে সুরক্ষা দেয় এটি।

৪ থেকে ১২ সপ্তাহের ব্যবধানে নিতে হবে এ টিকার দুটি ডোজ। বাসায় ব্যবহৃত রেফ্রিজারেটরের অনুরূপ ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এটি নিরাপদে সংরক্ষণ করা সম্ভব। ফলে আরও কয়েকটি টিকার চেয়ে এটি সহজে সংরক্ষণ ও সরবরাহ করা যাবে।

অন্যদিকে বর্তমানে বিভিন্ন দেশে ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। এটি অবশ্যই মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। আর এই টিকা স্থানান্তর করা যাবে সীমিতসংখ্যক বার। এ দুই বিষয়ই বিশেষত ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ। দেশটিতে গ্রীষ্মে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠতে দেখা যায়।

কতটা কার্যকর কোভিশিল্ড?

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা (কোভিশিল্ড) টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে (মানবদেহে পরীক্ষা) দেখা যায়, যখন এটি কারও দেহে প্রথমে অর্ধডোজ ও পরে পূর্ণ ডোজ দেওয়া হয়েছে, তখন এর কার্যকরিতা পাওয়া গেছে ৯০ শতাংশ। তবে অর্ধডোজ-পূর্ণ ডোজের এ ধারণার পক্ষে যথেষ্ট পরিষ্কার তথ্য-উপাত্ত এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

তবে অপ্রকাশিত কিছু তথ্য-উপাত্তে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, দীর্ঘ বিরতি দিয়ে এ টিকার প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হলে সার্বিক কার্যকারিতা বেড়ে যায়।

সেরাম ইনস্টিটিউট বলছে, কোভিশিল্ড ‘খুবই কার্যকর’ এবং যুক্তরাজ্য ও ব্রাজিলে তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালে এর কার্যকারিতার পক্ষে সমর্থন পাওয়া গেছে। তিনটি ধাপে সম্পন্ন করা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে টিকা যথাযথ রোগ প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তুলতে পারে কি না ও টিকার কারণে কোনো অস্বাভাবিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় কি না, সেসব বিষয় দেখা হয়।

তবে রোগীদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করা সংগঠন অল ইন্ডিয়া ড্রাগ অ্যাকশন নেটওয়ার্ক বলেছে, কোভিশিল্ডের ট্রায়াল নিয়ে তারা সন্তুষ্ট নয়। কেননা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভারতীয়দের ওপর এই টিকার সম্পূরক ট্রায়াল (ব্রিজিং স্টাডি) চালায়নি।

অবশ্য কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, এ টিকা ঠিকমতো কাজ করবে না, এমনটা সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই। বিভিন্ন বয়সী ও নানা জাতিসত্তার মানুষের ওপর এর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হয়েছে।

করোনাভাইরাস
ছবি: রয়টার্স

কোভ্যাক্সিনের অবস্থা কী?

ভারত সরকারের সমর্থনে এই টিকা উৎপাদন করেছে ২৪ বছরের পুরোনো টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভারত বায়োটেক। এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ১৬টি টিকা উৎপাদন করে, তা ১২৩টি দেশে রপ্তানি করেছে।

কোভ্যাক্সিন একটি ‘নিষ্ক্রিয় টিকা’, যার অর্থ এটি তৈরি করা হয়েছে মৃত করোনাভাইরাস থেকে। মানবদেহে এই টিকা নিরাপদ বলে প্রমাণিত হয়েছে। টিকা প্রয়োগের পর এটিকে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য মানবদেহে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে দেখা গেছে। চার সপ্তাহের ব্যবধানে দিতে হয় এর দুটি ডোজ। আর সংরক্ষণ করা যায় ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়।

ভারত বায়োটেক বলছে, তাদের কাছে কোভ্যাক্সিনের দুই কোটি ডোজ মজুত রয়েছে। চলতি বছরের মধ্যে দুই শহরের চারটি কারখানা থেকে ৭০ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদনের আশা তাদের।

কোভ্যাক্সিন নিয়ে কী বিতর্ক?

বিতর্কের শুরুটা হয় ভারতের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থার বক্তব্যে। সংস্থাটি বলেছিল, জনস্বার্থে জরুরি পরিস্থিতিতে এ টিকা সীমিত পর্যায়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মতো প্রয়োগ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বনের লক্ষ্যেই এভাবে প্রয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়েছে টিকাটির।

টিকার ট্রায়াল চলার মধ্যেই লাখ লাখ মানুষের ওপর কীভাবে এ টিকার জরুরি প্রয়োগের অনুমতি দেওয়া হলো, সেটি ভেবে বিস্মিত বিশেষজ্ঞরা। তবে কোভ্যাক্সিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা উভয়ই বলছে, এই টিকা ‘নিরাপদ এবং এটি একটি শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধক্ষমতা’ গড়ে তুলতে সহায়তা করে।

তবে অল ইন্ডিয়া ড্রাগ অ্যাকশন নেটওয়ার্ক বলেছে, যে টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি, তা প্রয়োগ করার জন্য অনুমোদন দিতে বৈজ্ঞানিক যুক্তি দেখানোর ঘটনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় তারা। এ টিকার কার্যকারিতা নিয়ে তথ্যের ঘাটতি থাকায় গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

কোভ্যাক্সিনকে অনুমোদন দেওয়ার বিষয়টিকে সমর্থন করেছে ভারত বায়োটেক। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, ‘দেশে গুরুতর ও জীবনের জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী রোগ নিয়ন্ত্রণে দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের পর সংশ্লিষ্ট ওষুধ ব্যবহার করার অনুমতি ভারতের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল–সংক্রান্ত আইনগুলো সমর্থন করে।’ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এই টিকার কার্যকারিতা নিয়ে তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে প্রতিষ্ঠিনটি।

ভারতীয় টিকা নিচ্ছে যেসব দেশ

ভারতে তৈরি টিকার প্রথম ডোজ ইতিমধ্যে বাংলাদেশ, ভুটান, মালদ্বীপ, নেপাল, মিয়ানমার ও সিসিলিতে পৌঁছেছে। অনুমতি সাপেক্ষে এই টিকা শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান ও মরিশাসেও পাঠানোর পরিকল্পনা করছে ভারত। এরই মধ্যে দেশটি ব্রাজিলে বাণিজ্যিকভাবে কোভিশিল্ড রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পর ভারত বিশ্বজুড়ে টিকা সরবরাহ অব্যাহত রাখবে।