ভারতে সরকার বিরোধিতায় সংসদ উত্তাল

রাজ্যসভায় বিরোধী দলের নেতাদের হট্টগোল। নয়াদিল্লি, ভারত, ২২ জুলাইছবি: এএনআই

তৃতীয় দিনেও সরকার বিরোধিতায় উত্তাল হলো ভারতীয় সংসদের উভয় কক্ষ ও জাতীয় রাজনীতি। দফায় দফায় মুলতবি হলো সংসদীয় অধিবেশন। বস্তুত, একাধিক বিষয় নিয়ে এমন নাজেহাল অবস্থা নরেন্দ্র মোদির সরকারকে সাম্প্রতিক সময়ে হতে হয়নি।
সরকার বিব্রত অক্সিজেনের অভাবে কারও মৃত্যু না হওয়া সম্পর্কিত বিবৃতি নিয়ে।

বিড়ম্বিত পেগাসাস নজরদারিকে কেন্দ্র করে ও বিতর্কিত কৃষি আইন প্রত্যাহারে সংসদ ভবনের অদূরে কৃষকনেতাদের অবস্থান আন্দোলন নিয়ে। পেট্রোপণ্যের লাগাতার মূল্যবৃদ্ধিতেও সরকারের সমালোচনা তীব্রতর হচ্ছে। দুশ্চিন্তা তা নিয়েও। এরই মাঝে বৃহস্পতিবার বিরোধীরা হাতে পেয়ে যান বিরোধিতার নতুন এক অস্ত্র, প্রতিষ্ঠিত হিন্দি পত্রিকা ‘দৈনিক ভাস্কর’–এ আয়কর হানা।

ইসরায়েলের এনএসও গ্রুপের তৈরি পেগাসাস স্পাইওয়্যার স্মার্টফোনে ব্যবহার করে নজরদারির ব্যবস্থা নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, বৃহস্পতিবার সংসদে তার বিরোধিতাই হয়ে ওঠে মুখ্য। ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’–এর সেই রিপোর্টের সত্যাসত্যের মধ্যে না গিয়ে ভারত সরকার আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলেছে, ওই রিপোর্টের লক্ষ্য ভারতের বদনাম করা। ভারতের অগ্রগতি রোধ করা। বিরোধীদের দাবি, সরকার যদি দোষীই না হয়ে থাকে, বিরোধীদের ওপর অহেতুক নজরদারিই যদি না চালায়, তাহলে বিচার বিভাগীয় তদন্তে বাধা কোথায়? সরকার এই দাবি মানতে নারাজ।

বৃহস্পতিবার এই বিষয়ে লিখিত কিছু পাঠ করতে তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণ রাজ্যসভায় উদ্যোগী হওয়ামাত্র তৃণমূল কংগ্রেসের সদস্যরা ওয়েলে নেমে আসেন। শান্তনু সেন মন্ত্রীর হাত থেকে কাগজ কেড়ে ছিঁড়ে উড়িয়ে দেন। আরজেডি সদস্য মনোজ ঝাকে বলতে শোনা যায়, মন্ত্রীর আচরণ দুর্ভাগ্যজনক।

রাজ্যসভার মতো লোকসভাও আজ বৃহস্পতিবার বারবার মুলতবি হয়। কখনো কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে, কখনো কোভিডকালে অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যু না হওয়ার সরকারি বক্তব্য ঘিরে। কখনো ‘দৈনিক ভাস্কর’–এ আয়কর হানাকে কেন্দ্র করে।

দৈনিক ভাস্কর উত্তর, মধ্য ও পশ্চিম ভারতের এক জনপ্রিয় ও বহুল প্রচারিত প্রভাতি হিন্দি পত্রিকা। বৃহস্পতিবার ওই পত্রিকার দিল্লি, মধ্যপ্রদেশের ভোপাল ও ইন্দোর, রাজস্থানের জয়পুর, গুজরাটের আহমেদাবাদসহ একাধিক রাজ্যের অফিসে একযোগে আয়কর বিভাগ তল্লাশি চালায়। একই সঙ্গে তল্লাশি চালানো হয় উত্তর প্রদেশের ‘ভারত সমাচার’ নামের এক টিভি চ্যানেলের অফিসেও। খবর পাওয়ামাত্র তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সাংসদ ডেরেক ওব্রায়ান, রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট, কংগ্রেস নেতা জয়রাম নরেশরা সরব হন। প্রত্যেকেরই এক কথা, সমালোচনা বন্ধ করতে সরকার সংবাদপত্রের কণ্ঠ রোধ করতে চাইছে। কারণ, কোভিড থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতার ছবি এই সব সংবাদমাধ্যম তুলে ধরছে।

কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় অরাজকতা ও অব্যবস্থার ছবি দৈনিক ভাস্কর তুলে ধরেছিল। অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুর মিছিলের কাহিনি লেখা হচ্ছিল। ভারত সমাচার গঙ্গায় লাশ ভাসিয়ে দেওয়ার ছবি প্রচার করেছিল। গঙ্গার পাড়ে গণহারে কবর দেওয়ার খবর দেখিয়েছিল। অভিযোগ, এই প্রচারে ক্ষুব্ধ হয়েই তাদের বিরুদ্ধে আয়কর হানা। সরকারের নিন্দা জানিয়ে মমতা বলেন, ‘এভাবে সত্য চাপা দেওয়ার চেষ্টা নিন্দনীয়।’ মিডিয়ার প্রতি তাঁর আহ্বান, ‘আপনারা শক্ত থাকুন। জোটবদ্ধ থাকুন। স্বৈরাচারী শক্তি জিততে পারবে না।’

এভাবে সত্য চাপা দেওয়ার চেষ্টা নিন্দনীয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
করোনার সংক্রমণে ভারতে মৃত্যু বেড়ে গেছে। শ্মশানে দিন-রাত জ্বলছে চিতা। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির একটি শ্মশানে।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

মোদি সরকারকে নাজেহাল হতে হচ্ছে কোভিডকালে অক্সিজেনের অভাবে কারও মৃত্যু হয়নি বলে বিবৃতি দেওয়া নিয়েও। মঙ্গলবার সংসদে সরকারের তরফ থেকে যে বিবৃতি দেওয়া হয়, তাতে বলা হয়, সরকারের কাছে সেই তথ্য নেই। কারণ, রাজ্য সরকার সেই তথ্য কেন্দ্রকে দেয়নি। সরকারের সেই বিবৃতি ছিল ঘৃতাহুতির শামিল। এপ্রিল–মে মাসে রাজ্যে রাজ্যে অক্সিজেনের হাহাকারের ছবি প্রকাশিত হয়েছে। শয়ে শয়ে মৃত্যুর হৃদয়বিদারক কাহিনি প্রকাশিত হয়েছে। অসহায় সরকারের প্রতিক্রিয়ার কথা জানাজানি হয়েছে। অক্সিজেনের জোগান নিয়ে মামলা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন। তারপরেও কোনো সংবেদনশীল সরকার কী করে জানায়, অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুর কোনো খবর তাদের কাছে নেই? এই প্রশ্নে দেশ উত্তাল। সরকারও নাজেহাল। কোভিড মোকাবিলায় পাহাড়প্রমাণ ব্যর্থতা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী কী করে উত্তর প্রদেশ সরকারের প্রশংসা করেন, সেই প্রশ্নও সংসদে উঠে আসছে।

শিবসেনা নেতা সঞ্জয় রাউত বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা উচিত। প্রায় সব বিরোধী দলের এক রায়, সুপ্রিম কোর্টের উচিত নিজে থেকে এই বিষয়ে সরকারকে কাঠগড়ায় তোলা। কংগ্রেসের প্রশ্ন, পি এম কেয়ার্স তহবিল থেকে দেশে দেড় হাজার মেডিকেল অক্সিজেন প্ল্যান্ট গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। অভাব না থাকলে এই সিদ্ধান্ত কেন? সরকারের বিড়ম্বনা বাড়িয়েছেন বিজেপির শীর্ষ নেতা নিতিন গড়কড়িও। তাঁর এক পুরোনো মন্তব্য বিরোধীরা তুলে ধরেছেন, যেখানে গড়কড়িকে বলতে শোনা যাচ্ছে, কোভিড–আক্রান্ত বহু মানুষকে কীভাবে অক্সিজেনের অভাবে মারা যেতে হয়েছে।

কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে যন্তর মন্তরে কৃকদের অবস্থান
ছবি: এএনআই

কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতেসরকারি বিড়ম্বনার বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়েছেন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে দিল্লি সীমান্তে অবস্থানকারী কৃষকেরাও। সংসদের অদূরে যন্তর মন্তরে প্রতিদিন ২০০ কৃষককে অবস্থানের অনুমতি দিয়েছে দিল্লি সরকার। সেই অবস্থান শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার থেকে। তাঁরা ঠিক করেছেন, সরকারি আদেশ মেনে সৃশৃঙ্খলভাবে প্রতিদিন তাঁরা সেখানে প্রতীকী সংসদীয় অধিবেশন চালাবেন। সেই প্রতীকী সংসদীয় অধিবেশনে স্পিকার থাকবেন, সরকারপক্ষ থাকবে, বিরোধীপক্ষও থাকবে। কৃষি আইন কী, সরকারি যুক্তি কী, কৃষকদের আপত্তিই–বা কোথায়, তা তাঁরা প্রতিদিন আলোচনা করবেন। জনগণকে বোঝাবেন, ওই তিন আইন কেন কৃষকবিরোধী। সরকার কীভাবে গোটা কৃষিক্ষেত্রকে করপোরেটের হাতে তুলে দিতে চাইছে।