‘ভালো ফলের’ আশা সংযুক্ত মোর্চার

বাম ফ্রন্ট-কংগ্রেস-ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট (আইএফএফ) নিয়ে গঠিত হয়েছে সংযুক্ত মোর্চা। আজ ৪৪ আসনে ভোট।

গত ১৪ মার্চ কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে আনুষ্ঠানিকভাবে সংযুক্ত মোর্চা গঠন করে বামফ্রন্ট, কংগ্রেস ও আইএসএফ
ছবি: সংগৃহীত

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এবারের বিধানসভা নির্বাচন নানান দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্নটি হলো, বাম ফ্রন্ট-কংগ্রেস-ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্টের (আইএফএফ) সংযুক্ত মোর্চা কেমন ফল করবে।

প্রশ্নটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। কারণ, এই মোর্চায় বাম ফ্রন্ট রয়েছে এবং তারাই শরিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। প্রশ্ন হলো, তারা হয়তো ভোট পাবে, কিন্তু আসন পাবে কি? যদি কোনো আসন তারা না পায়, তবে তা হবে একটা রেকর্ড। কারণ, ১৯৫১-৫২ সালে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম বিধানসভা নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বাম জোট পেয়েছিল ৪১টি আসন।

পরের অর্ধশতকে বাম ফ্রন্টের ভোট ও আসন পশ্চিমবঙ্গে উত্তরোত্তর বেড়ে ১৯৮৭-তে পৌঁছায় ২৫১টি। এর পরের ২০ বছরে তা দুই শতাধিক ছিল, কিন্তু কমতে শুরু করে ২০১১ থেকে। ওই বছর তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে হারার পর ধারাবাহিকভাবে বামেদের আসন ও ভোটের হার কমেছে। দেড় দশক আগে, ২০০৬ সালে ২৩৩টি আসন থেকে ২০১১ সালে বাম ফ্রন্ট নেমে আসে ৬২টিতে। সেখান থেকে ২০১৬ সালে ৩২টিতে। সেখান থেকে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে তারা কোনো আসনই পায়নি, ভোট পেয়েছিল সাড়ে ৭ শতাংশ।

বাম ফ্রন্ট অবশ্য মনে করছে, ২০২১ সালে হাওয়া ঘুরছে। সিপিআইএম দলের নেতা ও পলিটব্যুরোর সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেছেন, এখন যত দিন যাচ্ছে, সংযুক্ত মোর্চাই প্রথম শক্তি হিসেবে উঠে আসছে। মানুষ ছন্দে ফিরছেন। সারা রাজ্যে তা-ই। প্রতিটি দফায় সংযুক্ত মোর্চা এগোচ্ছে। ইতিমধ্যে সিপিআইএম দলের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র জানিয়েছেন, নির্বাচনে কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে বাম ফ্রন্ট কোনো অবস্থাতেই তৃণমূল কংগ্রেসকে সমর্থন করবে না। তাঁর মতে, তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

সিপিআইএম দলের সাধারণ কর্মীরা আশা করছেন, কয়েকটি আসনে তাঁদের ভালো ফল করার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য, বেশির ভাগ আসনে বাম ফ্রন্ট যদি জামানত বাঁচাতে পারে, তবে সেটা একটা বড় ঘটনা হবে। তবে আসনের থেকেও বড় কথা হলো, বামেদের ভোটের হার। তারা কত ভোট পাচ্ছে, তার ওপর অন্য দলের জেতা-হারা অনেকটাই নির্ভর করছে। এটা সবচেয়ে গুছিয়ে বললেন বাঁকুড়া জেলার গাড়ির চালক উত্তম রায়, ‘এবারের নির্বাচনটা খুব পরিষ্কার। বামেরা যদি হিন্দু ভোট বেশি পায়, তবে বিপদ বিজেপির। মুসলিম ভোট পেলে বিপদ তৃণমূলের।’ কথাটা হয়তো একেবারেই ঠিক।

বামেদের হিন্দু ভোট ২০১৪ থেকে ২০১৯-এ নেমে গেছে ২৯ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশে, জানিয়েছে নির্বাচন নিয়ে গবেষণাকারী দিল্লির একটি সংস্থা। আর বিজেপির ভোট বেড়েছে সমপরিমাণ। কিন্তু তৃণমূলের ভোট কমেনি। এক দশক ধরে ৪৩ থেকে ৪৫ শতাংশের মধ্যে রয়েছে তৃণমূলের ভোট। বামেদের হিন্দু ভোট বিজেপি থেকে বাম ফ্রন্টে ফিরে এলে বিপদ বিজেপির।

এবারের নির্বাচনে মাঠে রয়েছে এমন একটি দল আইএসএফ, যারা মূলত মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব করছে। সংযুক্ত মোর্চার এই শরিক যদি কিছু মুসলিম ভোট টানে, তবে তাতে বিপদে পড়বে তৃণমূল কংগ্রেস। কারণ, দক্ষিণবঙ্গে মুসলমান সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ ভোট এখনো পাচ্ছে তৃণমূল।

আইএসএফের প্রচার থেকে মোটামুটিভাবে বলা যেতে পারে, তারা যত জোরালো ভাষায় মমতাকে আক্রমণ করছে, তত জোরালো ভাষায় বিজেপিকে করছে না। দলের প্রধান আব্বাস সিদ্দিকী কয়েক মাস আগে এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারানোই তাঁদের প্রধান লক্ষ্য।

এর বাইরে রয়েছে কংগ্রেস

কংগ্রেসের ভোট লাগাতার কমছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও আসনের নিরিখে তাদের অবস্থা বাম ফ্রন্টের থেকে সামান্য ভালো। এর কারণ, তাদের যেটুকু ভোট রয়েছে, তা সারা রাজ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নেই, আছে মাত্র দুটি জেলায়—মালদহ ও মুর্শিদাবাদে। তাই ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে যখন বাম ফ্রন্ট পেয়েছিল ৩২টি আসন, তখন কংগ্রেস পেয়েছিল ৪৪টি। এবারের বিধানসভায় তারা কত আসন পেতে পারে—এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিলেও পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের অন্যতম ভাইস প্রেসিডেন্ট দীপ্তিমান ঘোষ বলেন, তাঁরা ফল ভালোই করবেন। তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থানের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলো বিজেপি হারিয়েছে। কোনোরকমে জিতেছে গুজরাটে, হারতে হারতে জিতেছে হরিয়ানায়, ঝাড়খন্ডে হেরে গেছে। শুধু বিজেপির প্রচার দেখে ওদের এগিয়ে রাখলে ঠিক হবে না। কংগ্রেস ও সংযুক্ত মোর্চা ভালোভাবেই লড়াইয়ে আছে, এটুকু বলতে পারি।’

পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সাধারণভাবে বর্তমানের রাজনীতি নিয়ে এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা নিয়ে যে তিতিবিরক্ত, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কয়েক বছর ধরে যে অঞ্চলে লাগাতার সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটেছে, উত্তর ২৪ পরগনার সেই কাঁকিনাড়া অঞ্চলের এক বয়স্ক নারী রেনুকা দেবী বলেন, ‘আমি বাম ফ্রন্টের আমলে জীবনেও এত গন্ডগোল দেখিনি। এত হিন্দু-মুসলমান…এত ভেদাভেদ দেখিনি। ওদেরই আসা উচিত।’ বাম ফ্রন্ট ও কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরাও আশা করছেন, প্রধান দুই দলকে নিয়ে বিরক্ত মানুষ শেষ পর্যন্ত তাদেরই জয়যুক্ত করবেন।

চতুর্থ দফায় ভোট আজ

পশ্চিমবঙ্গে চতুর্থ দফায় ভোট গ্রহণ আজ শনিবার। এই দফায় পাঁচটি জেলা কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া ও হুগলির ৪৪টি আসনে ভোট গ্রহণ করা হবে। এই পর্যায়ে ভোট শেষ হলে বিধানসভার মোট ২৯৪টি আসনের মধ্যে ৪৫ শতাংশে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হবে। এরপর আরও চারটি দফার নির্বাচন রয়েছে। ভোট গ্রহণ শেষ হবে ২৯ এপ্রিল এবং গণনা হবে আগামী ২ মে।