মমতার সলতে পাকানো পণ্ডশ্রম হবে, যদি না...

বৈঠকের পর সোনিয়া গান্ধী ও রাহুল গান্ধীর কাছ থেকে বিদায় নেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নয়াদিল্লি, ভারত, ২৮ জুলাই।
ছবি: এএনআই

বিজেপিবিরোধী সর্বভারতীয় জোটের জমি প্রস্তুতের জন্য মাটি খোঁড়া শুরু করলেও তিন দিনের দিল্লি সফরে সবচেয়ে বড় প্রশ্নের উত্তর অনুচ্চারিত রাখলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং সম্ভবত সেটাই হতে চলেছে সম্ভাব্য এই জোট গঠন প্রক্রিয়ার প্রধান জট। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের কত কাছাকাছি এসে সেই জট খুলবে, কতটা মসৃণ ও অবিতর্কিতভাবে, তার ওপর নির্ভর করবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদিকে কতটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।

এখন পর্যন্ত তিন–চারটি দল বাদ দিলে বিজেপিবিরোধিতায় অন্যান্য আঞ্চলিক দল মোটামুটি সহমত। ওডিশার বিজু জনতা দল (বিজেডি), অন্ধ্র প্রদেশের ওয়াই এস আর কংগ্রেস, তেলেঙ্গানার শাসক দল তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি (টিআরএস) অধিকাংশ সময় বিজেপিকে খুশি রেখে চলতে পছন্দ করেছে। রাজ্যসভায় গুরুত্বপূর্ণ বিল পাসে সাহায্য করেছে। উত্তর প্রদেশের বিরোধী দলনেত্রী মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টিকেও (বিএসপি) অনেক সময় সেই ভূমিকায় নামতে দেখা গেছে। তামিলনাড়ুর এআইএডিএমকের আচরণও তথৈবচ। নির্বিবাদ রাজ্য চালনা নাকি দুর্নীতির অভিযোগ, বিজেপিকে সমর্থনের কোন তাগিদ এই দলগুলোকে তাড়া করে ফিরছে, সেই বিতর্ক রাজনৈতিক পরিসরে বারবার উঠেছে। কারণ যা–ই হোক, ঘটনা হলো রাজ্যসভায় কমজোরি হয়েও এদের সাহচর্যে মোদির বিজেপিকে গুরুত্বপূর্ণ বিল পাসের ক্ষেত্রে হতাশ হতে হয়নি। সংসদীয় গণতন্ত্রে অবশ্যই তা মোদির কৃতিত্ব।

এই দলগুলো এবং দেশের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় ছোট ছোট দল, যারা চিরকালই দিল্লির ক্ষমতাসীনের অঙ্গ হিসেবে রাজ্য পরিচালনায় আগ্রহী, তাদের বাদ দিলে আসমুদ্রহিমাচলের প্রায় সবাই নীতিগতভাবে ২০২৪–এর ভোটের আগে বিজেপিবিরোধী জোট গড়তে ব্যগ্র। এত দিন সেই দায়িত্ব পালন করে এসেছে কংগ্রেস। কিন্তু গত সাত বছরে ক্রমশ হীনবল হয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন এই দল। রাহুল গান্ধীর দোলাচলের কারণে সভাপতিত্বের প্রশ্নটিও তারা এখনো অমীমাংসিত রেখেছে। এই অবস্থায় জোট বাঁধার সলতে পাকানোর কাজ হাতে নিয়ে প্রবলভাবে উঠে এসেছেন মমতা। অমিত শক্তিধর বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে রুখে রাজ্যের হাল আরও একবার হাতে নিয়ে নিজের ভাবমূর্তিকে যেভাবে উজ্জ্বলতর করেছেন, তাতে মনে করছেন, সর্বভারতীয় নেতৃত্বের শূন্যতা মেটাতে তিনি উপযুক্ত। লোহা গরম থাকতে থাকতেই হাতুড়ির ঘা মারা নিয়ম। নির্বাচনী সাফল্যের রেশ জারি থাকতে থাকতে তাই তিনি আসরে অবতীর্ণ।

সেই দিক থেকে দেখলে এবারের দিল্লি সফর মমতাকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রাখল।
কিন্তু তা সত্ত্বেও খচখচ করছে সেই মূল প্রশ্ন। জোট গঠিত হলেও নেতৃত্বে কে?
দুটো বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। এক. বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে গেলে জোটবদ্ধ হতে হবে এবং সেই জোটের একটা মুখ দরকার। কেননা, মুখহীন জোট ও অ–জমাট দুই সমার্থক। দুই. নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে কোনো মুখ না থাকায় পরপর দুবার দেশের মানুষ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁকেই বেছে নিয়েছেন। তাঁর প্রতি আস্থা রেখেছেন। মুখ ছিল না বলেই পশ্চিমবঙ্গে মমতার মোকাবিলায় বিজেপিও মুখ থুবড়ে পড়েছে।

সম্ভাব্য জোটের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী দল হিসেবে কংগ্রেসের স্বাভাবিক পছন্দ রাহুল গান্ধী। কিন্তু এত দিনেও তিনি দল ও অন্যত্র নিজের গ্রহণযোগ্যতাকে সর্বজনীন করে তুলতে পারেননি। ‘সিরিয়াস পলিটিশিয়ান’ পরিচয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠাও করতে পারেননি।

তাই মোদির বিকল্প কে, সেটা স্থির করেই বিরোধী জোটকে আসরে নামতে হবে। ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এই মুহূর্তে যা, তাতে এই দুই উপলব্ধি নিয়ে বিরোধীদের কারও মনে কোনো সংশয় বা দ্বিমত নেই। মমতা নিজেও তা জানেন। বোঝেনও। তাই উত্তরটি অনুচ্চারিত রেখে বলেছেন, ‘সবাইকে একসঙ্গে বসে এই প্রশ্নের মীমাংসা করতে হবে। আমি শুধু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কাজটুকু করছি।’

বলছেন বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন, জোটের নেতৃত্ব দিতে, মোদির বিরুদ্ধে ‘মুখ’ হতে তিনি কতটা আগ্রহী। বলতে গেলে এই সফরের শুরু থেকে দেশের মিডিয়াকে এই প্রশ্নটাই তাড়িয়ে বেরিয়েছে। বুধবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে মুখোমুখি হয়ে এর জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি জ্যোতিষী নই। পরিস্থিতি কোন দিকে এগোবে, তার ওপরেই সবকিছু নির্ভর করবে।’ এই উত্তরের মধ্য দিয়ে তিনি যেমন আগ্রহের কথা প্রকাশ করলেন না, তেমনই অনাগ্রহী যে তা–ও বললেন না। নেতৃত্ব ও জোটের মুখ হওয়ার বিষয়টি নিয়ে এভাবেই তৈরি করে রাখলেন এক সাসপেন্স। যদিও তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যরা সরাসরিই দাবি করেছেন, পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মমতাকেই তাঁরা দেখতে চান। মমতার উপস্থিতিতে বুধবার দলীয় সাংসদদের বৈঠকের পর সেই দাবি প্রকাশ্যে তোলাও হয়। সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘দিদিকেই আমরা প্রধানমন্ত্রী চাই।’

সবাইকে একসঙ্গে বসে এই প্রশ্নের মীমাংসা করতে হবে। আমি শুধু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কাজটুকু করছি।
—মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজেপিবিরোধী জোট গঠন প্রসঙ্গে

তবে এই চাওয়া–পাওয়ার মধ্যবর্তী ব্যবধান যে দুস্তর, মমতা তা বিলক্ষণ জানেন। কিন্তু এটাও বিশ্বাস করেন, বিজেপিকে রুখে দেওয়ার পর সারা দেশের সর্বজনগ্রাহ্য মুখ হওয়ার যোগ্যতা তাঁর রয়েছে।

এই ক্ষেত্রে মমতা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বলে যাঁদের মনে করেন, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতার নিরিখে সেই তালিকার প্রথম নাম শারদ পাওয়ার। জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস দলের (এনসিপি) এই নেতা জীবনের সেরা অংশ কংগ্রেসে অতিবাহিত করে আঞ্চলিক দলের প্রতিষ্ঠা করলেও সর্বভারতীয় স্তরে এখনো সর্বগ্রাহ্য। কিন্তু বিপক্ষে যাচ্ছে তাঁর বয়স ও কর্মক্ষমতা। ক্যানসার তাঁর বাচনভঙ্গির ওপরেও মারাত্মক থাবা বসিয়েছে। পাওয়ারের মতোই রয়েছেন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী। সম্ভাব্য জোট শরিকদের মধ্যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নাতীত। ইউপিএর নেতৃত্ব তার প্রমাণ। কিন্তু তাঁরও বিপক্ষে যাচ্ছে শারীরিক অসুস্থতা। দুরারোগ্য ব্যাধি তাঁকেও কাবু করেছে। তবে স্বাস্থ্যসম্পর্কিত কারণ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ তাঁর মানসিকতা। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য ২০০৪ সালে তৎকালীন জোট শরিকদের সম্মিলিত দাবিকে অগ্রাহ্য করে তিনি মনমোহন সিংকে বেছে নিয়েছিলেন। তখন যে যুক্তিতে তিনি তাড়িত হয়েছিলেন, এখন তা অস্বীকার করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। মা হিসেবে তিনি তো বটেই, জোটের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী দল হিসেবে কংগ্রেসের স্বাভাবিক পছন্দ রাহুল গান্ধী। কিন্তু এত দিনেও তিনি দল ও অন্যত্র নিজের গ্রহণযোগ্যতাকে সর্বজনীন করে তুলতে পারেননি।

‘সিরিয়াস পলিটিশিয়ান’ পরিচয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠাও করতে পারেননি। পরপর দুটি নির্বাচনে কংগ্রেসের জন্য বিরোধী দলের মর্যাদা আদায়ে তিনি ব্যর্থ। সবচেয়ে বড় কথা, দলের নেতৃত্ব দিতে যিনি এখনো ‘তৈরি’ নন, সভাপতিত্বের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি, তাঁকে জোটের মুখ হিসেবে গ্রহণ করতে শরিকেরা কতটা প্রস্তুত, সেই প্রশ্ন জিইয়ে রয়েছে। এই শূন্যতা ভরাট করতেই মমতা এগিয়েছেন সবার আগে।

প্রধানমন্ত্রিত্বের আগ্রহ অনুচ্চারিত অথচ জিইয়ে রেখে মমতা এখন জোটবদ্ধতার দিকে বেশি নজর দিচ্ছেন এবং সেই সঙ্গে জল মাপতে শুরু করেছেন। তাঁর ফর্মুলা খুবই সাধারণ। যে রাজ্যে যে দল শক্তিশালী, যেখানে যার আধিপত্য, যেখানে যাদের জয়ের সম্ভাবনা বেশি, সেই রাজ্যের জোটের প্রধান দায়িত্ব তাদেরই দেওয়া হোক।

রাহুলকে নিয়ে মমতার আড়ষ্টতা গোপন নয়। প্রথমত, তিনি বয়সে বড়। দ্বিতীয়ত, রাজনীতিতে অভিজ্ঞতা তাঁর বেশি। তৃতীয়ত, রাহুলের চেয়ে রাজনীতিতে অনেক বেশি সফলও তিনি। চতুর্থত, কারও বদান্যতা বা আনুকূল্যে তিনি নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাননি। যা করেছেন, যত সাফল্য অর্জন করেছেন, পুরোটাই নিজের দক্ষতায়। ফলে রাহুলকে নেতা মেনে নেওয়া মমতার পক্ষে এখনো কঠিন। কিন্তু এটাও তিনি জানেন ও বোঝেন, কংগ্রেসকে বাইরে রেখে বিজেপিবিরোধী জোট গঠন হাস্যকর ও অবাস্তব। সে জন্য গতকাল বুধবার সোনিয়ার সঙ্গে তিনি বৈঠক করেন রাহুলের উপস্থিতিকে আপত্তি না জানিয়ে।

দিল্লি সফরে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সঙ্গে দেখা করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নয়াদিল্লি, ভারত, ২৮ জুলাই।
ছবি: এএনআই

প্রধানমন্ত্রিত্বের আগ্রহ অনুচ্চারিত অথচ জিইয়ে রেখে মমতা এখন জোটবদ্ধতার দিকে বেশি নজর দিচ্ছেন এবং সেই সঙ্গে জল মাপতে শুরু করেছেন। তাঁর ফর্মুলা খুবই সাধারণ। যে রাজ্যে যে দল শক্তিশালী, যেখানে যার আধিপত্য, যেখানে যাদের জয়ের সম্ভাবনা বেশি, সেই রাজ্যের জোটের প্রধান দায়িত্ব তাদেরই দেওয়া হোক। যেমন পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস, বিহারে রাষ্ট্রীয় জনতা দল কিংবা তামিলনাড়ুতে ডিএমকে এবং পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ের মতো রাজ্যে কংগ্রেস। মহারাষ্ট্র, ত্রিপুরা, আসাম, ঝাড়খন্ডের মতো রাজ্যে যেখানে জোট শরিকের শক্তির ফারাক অল্প–বিস্তর, সেখানে জোট হিসেবেই তারা সিদ্ধান্ত নিক। নেতৃত্বের প্রশ্ন পরে বিবেচনা করলেও চলবে।

কিন্তু মুশকিলটা হলো জোটের মুখকে ঘিরে। ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার ঠিক করা না গেলে সেটা যে নরেন্দ্র মোদির পোয়াবারো, সেই উপলব্ধি কমবেশি সবারই সমান। সবকিছু আটকে যাচ্ছে ওখানেই। আর সেটাই এই মুহূর্তে বিজেপির স্বস্তি।
সময় রয়েছে বিস্তর। কিন্তু সময় থাকতে থাকতেই মমতা–পাওয়ার–সোনিয়াদের এই কঠিন কাজটুকু সেরে ফেলতে হবে। না হলে মমতার সলতে পাকানোর পুরোটাই হবে পণ্ডশ্রম।