মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার শিক্ষা: সবার ওপরে জনতা সত্য

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: এএফপি
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: এএফপি

হোঁচট খেলেও শেষ মুহূর্তে হরিয়ানাকে সামলে নিল বিজেপি। একত্রিশ বছরের দুষ্মন্ত চৌটালাকে বাগে এনে দ্বিতীয়বারের জন্য এই রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতাসীন হতে চলেছে। কিন্তু মহারাষ্ট্রের ‘বাঘ’কে (শিবসেনার দলীয় প্রতীক) বাগে আনতে তাদের আরও খানিকটা সময় দরকার। দীপাবলি কেটে গেলে সেদিকে তারা মন দেবে।

জননায়ক জনতা পার্টির (জেজেপি) নেতা দুষ্মন্তর দুই হাতেই লাড্ডু ছিল। কংগ্রেস তাঁর হাত ধরতে চেয়েছিল, বিজেপিও। দুষ্মন্ত দুই দলের সঙ্গেই প্রাথমিক কথা বলেছিলেন। শেষমেশ বিজেপির বাড়ানো হাতটাই তিনি ধরেছেন। তাঁর দিক থেকে ঠিকই করেছেন তিনি। পাউরুটির কোন দিকে মাখন লাগানো, সেই বোধশক্তি একত্রিশ বছরের এই তরুণের জন্মগত। ঠাকুরদা ওমপ্রকাশ চৌটালা ও তাঁর বাবা দেবীলাল দুজনেই এক সময় হরিয়ানা শাসন করেছেন। দেবীলাল তো ভারতের উপ প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। আদ্যন্ত রাজনৈতিক পরিবারে লালিত ও পালিত এই জাট তরুণ বুঝেছেন, ডুবন্ত কংগ্রেসের চেয়ে ছুটন্ত বিজেপি আপাতত তাঁর পক্ষে ‘বেস্ট বেট’। জীবনটা তিনি শুরুই করবেন উপমুখ্যমন্ত্রী হিসেবে। রাজ্যের ‘উপেক্ষিত’ জাট ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার কাজও তাঁর হাতে দিয়েই শুরু হবে। বিজেপির হাত ধরলে এই মুহূর্তে তাই লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই।

মহারাষ্ট্রের শরিক শিবসেনাকে কীভাবে বশ করা হবে, সেই ফর্মুলা এখনো পাওয়া যায়নি। উদ্ধব ঠাকরের দল গত ভোটে আলাদা লড়ে পরে জোট বেঁধেছিল। এবার শুরু থেকেই গাঁটছড়া বেঁধে তারা আসরে নেমেছে। এই দুই দলের সম্পর্কটা হলো সেই ঝগড়াটে দম্পতির মতো, যারা একে অন্যের বাপবাপান্ত করলেও দিনের শেষে এক ছাদের তলায় টিকে থাকে। ফল বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই বিজেপির ‘ঔদ্ধত্য’ ও দল ভাঙানোর খেলা নিয়ে গলা উঁচিয়ে শিবসেনা ‘সমানে সমানে’ সরকার গড়ার দাবি জানিয়েছে। ভোটের আগেই আদিত্য ঠাকরের জন্য উপ মুখ্যমন্ত্রীর আসনটা বিজেপি এগিয়ে দিয়েছে। এবার তাদের বাড়তি দাবি আড়াই বছর পর মুখ্যমন্ত্রিত্ব। কী করবে বিজেপি? দীপাবলি কাটলে উদ্ধবের সঙ্গে মুখোমুখি বসবেন অমিত শাহ।

বিজেপিকে চাপে রাখতে শিবসেনা তাদের মুখপত্র ‘সামনা’য় চমৎকার একটা কার্টুন ছাপিয়েছে। হলুদ বাঘ (শিবসেনার প্রতীক) গলায় এনসিপির প্রতীক ‘ঘড়ি’ লকেটের মতো ঝুলিয়ে হাতে ধরা বিজেপির প্রতীক পদ্ম ফুলের সুঘ্রাণ নিচ্ছে। বাঘের চোখ আবেশে বন্ধ! সরাসরি কোনো দল স্বীকার না করলেও হাওয়ায় খবর ভাসানো হয়েছে, বিজেপিকে রুখতে কংগ্রেস-এনসিপি জোট শিবসেনাকে সরকার গড়তে সাহায্য করার কথা ভাবছে। রাজনীতিতে সবকিছু সম্ভব হলেও এই সম্ভাবনা অসম্ভব। শিবসেনার দিক থেকে সমানে সমানে ক্ষমতা লাভের আরও একটা চাপ ছাড়া এটা অন্য কিছু নয়।

ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দুই পক্ষকেই এই দুই রাজ্যের ভোট অনেক শিক্ষা দিয়ে গেল। এবং তাও লোকসভা ভোটের মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে!

পাঁচ মাস আগে লোকসভা ভোটে যে হাতিয়ারে বিজেপি তার বিরোধীদের শরশয্যায় শুইয়েছিল, এবারও সেই ‘জাতীয়তাবাদ’ নামক অস্ত্রে তারা কেল্লা ফতে করতে চেয়েছিল। কৃষি সমস্যায় জর্জরিত গ্রামীণ ভারত যেখানে ধুঁকছে, বেকারত্বের জ্বালায় জ্বলছে মানুষ, ব্যবসা বাণিজ্য বেহাল, চৌপাট দেশের অর্থনীতি, মোদি-শাহ জুটির কণ্ঠে সেখানে শুধুই পাকিস্তান, সন্ত্রাসবাদ, রাফাল, কাশ্মীর, ৩৭০ অনুচ্ছেদ, এনআরসি, নাগরিকত্ব বিল এবং ৫৬ ইঞ্চি ছাতি! পাঁচ মাস আগে যারা মোদিকে দেখে সমর্থন উজাড় করে দিয়েছিল, তাদের অনেকেই এবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কেন্দ্র ও রাজ্যের নির্বাচন যে পৃথক, সেই শিক্ষা বিজেপিকে এবার এই দুই রাজ্য দিয়ে গেল।

অমিত শাহ। রয়টার্স ফাইল ছবি
অমিত শাহ। রয়টার্স ফাইল ছবি

বিজেপি আরও একটা মস্ত ভুল করেছে দুই রাজ্যেই। মহারাষ্ট্রে মোট জনসংখ্যার ৩৪ শতাংশ মারাঠা। রাজ্যে মোট মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন ১৮ জন, তাঁদের মধ্যে ১১ জনই মারাঠা। মারাঠা জাত্যভিমানের সবচেয়ে বড় প্রতীক আশি ছুঁইছুঁই শরদ পাওয়ারকে লাগামছাড়া আক্রমণ করে বিজেপি নেতারা বড় ভুল করেছেন। ভোটের আগে পাওয়ার ও তাঁর দক্ষিণ হস্ত প্রফুল্ল প্যাটেলের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। জেরা করা হয়। পাওয়ারের বিরুদ্ধে সমনও জারি করা হয়। প্রতিবাদে এনসিপি সমর্থকেরা রাস্তায় নেমে পড়ে। আইন শৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কায় প্রশাসন গুটিয়ে যায়। পাওয়ারও বলেন, মারাঠারা কোনো দিন ব্রিটিশ শাসকদের কাছে মাথা নোয়ায়নি। এবারও দিল্লির কাছে মাথা ঝোঁকাবে না। মোদি-শাহ জুটির বিরুদ্ধে সরাসরি রুখেও দাঁড়ান তিনি। বলেন, ভয় দেখিয়ে দল ভাঙিয়ে লাভ নেই। দল ভাঙিয়ে সাতারা কেন্দ্রে ছত্রপতি শিবাজির বংশধরকে বিজেপি প্রার্থী করেছিল। পাওয়ারের বিক্রমের মোকাবিলা তিনি করতে পারেননি। পশ্চিম মহারাষ্ট্রে বিজেপি মুখ থুবড়ে পড়েছে। জোটের জোয়াল একাই নিজের কাঁধে নিয়ে শরদ পাওয়ার শুধু বিজেপিকে হোঁচটই খাওয়াননি, কংগ্রেসকেও হারানো সম্মান কিছুটা হলেও ফিরিয়ে দিয়েছেন।

একই শিক্ষা বিজেপি পেয়েছে হরিয়ানাতেও। মারাঠা প্রধান রাজ্যের ভার যেখানে তারা তুলে দিয়েছিল মাত্র ৩ শতাংশের ব্রাহ্মণ প্রতিনিধি দেবেন্দ্র ফাডনবিশের হাতে, জাট প্রধান (জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ) হরিয়ানার শাসনভার তেমনই তারা দিয়েছিল ‘পাঞ্জাবি বানিয়া’ মনোহরলাল খাট্টারকে। জাটেরা কীভাবে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে তার প্রমাণ কংগ্রেসের আসন ১৫ থেকে ৩১-এ পৌঁছানো এবং জাট দুষ্মন্তের উত্থান। মহারাষ্ট্রের মতো হরিয়ানাতেও মোদি-শাহ জুটি জাতীয়তাবাদের বাইরে বেরোতে চাননি। মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর প্রতিশ্রুতি দেননি। জবাবদিহি করেননি। যে হরিয়ানার ঘরে ঘরে সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ান বছর বছর জন্ম নেয়, সেই হরিয়ানা বিজেপির মুখে পাকিস্তান, কাশ্মীর, ৩৭০ অনুচ্ছেদ, এনআরসি ও দেশপ্রেমের বুলিকে অগ্রাহ্য করল! বিজেপিকে এই দুই রাজ্য শেখাল, একই ফুলে সব দেবতার পুজো হয় না। একই ছাঁচে সব ধরনের পোশাকের কাপড় কাটা যায় না।

রাহুল গান্ধী । ফাইল ছবি
রাহুল গান্ধী । ফাইল ছবি

কংগ্রেস এবং রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বকেও কি এই ভোট কিছু শিক্ষা দিল না? রাহুল দায়িত্ব গ্রহণের পর দলে নিজের ‘টিম’ বেছে নিতে চেয়েছিলেন। কোথাও সফল হয়েছেন, কোথাও হননি। কিন্তু যাই হোক না কেন, নতুন ও পুরোনো মুখের মধ্যে দলে টেনশনের যে চোরা স্রোত বইছিল, রাহুল তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। হরিয়ানায় দুবারের মুখ্যমন্ত্রী জাট নেতা প্রবীণ ভূপিন্দর সিং হুডাকে সরিয়ে রাহুল দায়িত্ব দিয়েছিলেন যাঁকে, সেই নবীন বানিয়া অশোক তানওয়ারকে সরিয়ে সোনিয়া কাছে টেনে নেন হুডাকে। তাও কখন, না ভোটের মাত্র এক মাস আগে, হুডা যখন আলাদা দল গড়ার ইচ্ছার কথাটি বাতাসে ভাসিয়ে দিয়েছেন। সোনিয়া যে ভুল করেননি, ফলই তার প্রমাণ। হুডাও সাফ সাফ বলেছেন, আরও আগে দায়িত্ব পেলে কংগ্রেস একাই সরকার গড়ত। এই দুই রাজ্যে নবীনদের তুলনায় প্রবীণেরা যে এখনো কর্মক্ষম ও ফলদায়ী, কংগ্রেসের সেই বোধোদয় হওয়া উচিত। সোনিয়ার দায়িত্ব গ্রহণের পর কংগ্রেসের ‘ওল্ড গার্ডেরা’ আপাতত কিছুটা আশ্বস্ত বোধ করছেন।

কংগ্রেসের এই ঘুরে দাঁড়ানো বুঝিয়ে দিল মোদি-শাহ জুটি অজেয় নয়। বিজেপিও ধরাছোঁয়ার বাইরে নয়। দুই রাজ্যের কোথাও সোনিয়া একদিনের জন্যও প্রচারে যাননি। প্রিয়াঙ্কাও নন। দুই রাজ্য মিলিয়ে রাহুল সভা করেছেন মাত্র পাঁচটি। ঘুরে দাঁড়ানোর পর এখনো পর্যন্ত রাহুল মুখ খোলেননি! লোকসভার ভোটে ভরাডুবির পর দায়িত্ব ছেড়ে দলকে টানা তিন মাস পঙ্গু করে দেওয়াটা যে ঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না, এবারের ভোট সেই শিক্ষাও তাঁকে দিল। বোঝাল, নেতারা জন্মান নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। ময়দান ছেড়ে পালানোর জন্য নয়। শরদ পাওয়ার ও ভূপিন্দর সিং হুডা ফিনিক্স পাখির মতো মাথা তুলে বুঝিয়ে দিলেন, ‘যে সয় সে রয়’।

মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার ভোট ভারতীয় গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ও মাধুর্যকে আরও একবার নতুন ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলল। বোঝাল, সবার ওপরে জনগণই সত্য।