মাসিকের পাঁচ দিন থাকতে হয় গ্রামের কোনায় কুঁড়েঘরে

প্রথা অনুযায়ী গন্দ ও মাদিয়া উপজাতির নারীদের মাসিক হলে মাসের এই বিশেষ পাঁচ দিন ছাপরায় থাকতে হবে। গ্রামের শেষ প্রান্তে বনের ধারে ওই কুঁড়েঘরগুলো বানানো হয়, যা স্থানীয়ভাবে কুরমা ঘর বা গাওকর নামে পরিচিত

মেয়েদের ঋতুস্রাব, পিরিয়ড বা মাসিক নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে রয়েছে দীর্ঘদিনের ট্যাবু। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ সময় মেয়েদের ‘অপবিত্র’ মনে করা হয়। যেতে হয় বিভিন্ন বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে। পালন করতে পারেন না সামাজিক ও ধর্মীয় আচার। প্রার্থনালয় ও রান্নাঘরে থাকে না প্রবেশাধিকার।

এর মধ্যে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রের সবচেয়ে অনুন্নত ও দরিদ্র জেলা গাদচিরোলির গন্দ ও মাদিয়া উপজাতির নারীদের ক্ষেত্রে এ বিধিনিষেধের মাত্রা আরও অনেক বেশি বলে বিবিসির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

এই উপজাতিদের প্রথা হলো মাসিক হলে মাসের এই বিশেষ পাঁচ দিন কিশোরী, তরুণী বা নারীকে ছাপরায় থাকতে হবে। গ্রামের শেষ প্রান্তে বনের ধারে ওই কুঁড়েঘরগুলো বানানো হয়, যা স্থানীয়ভাবে কুরমা ঘর বা গাওকর নামে পরিচিত। ওই বিশেষ সময়ে নারীরা রান্না করতে পারেন না। গ্রামের কূপ থেকে পানিও আনতে পারেন না। খাবার আর পানি দিয়ে যান পরিবারের অপর নারী সদস্যরা। কোনো পুরুষ যদি ওই নারীকে স্পর্শ করে বসেন, তাহলে তাঁকে তাৎক্ষণিক গোসল করতে হবে। কারণ, ওই স্পর্শের কারণে তিনিও ‘অপবিত্র’ হয়ে যান বলে মনে করা হয়ে থাকে।

৩৫ বছর বয়সী সুরেখা হালামি নামের এক নারী বিবিসিকে বলেন, গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে মশার উপদ্রব থাকে। তেমনি শীতে প্রচণ্ড ঠান্ডায় জমে যেতে হয়। বৃষ্টিতে খড়ের ছাদ গড়িয়ে পানি পড়ে। কখনো কখনো বন্য প্রাণী এখানে চলে আসে।
বিরূপ অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে ২১ বছরের শীতল নারোতে বলেন, তাঁকে যখন একা ওই কুঁড়েঘরে থাকতে হয়, তখন ভয়ে তাঁর ঘুম আসে না। তিনি বলেন, ‘ঘরের ভেতর-বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমি বাড়ি থাকতে চাই, কিন্তু আমার কোনো বিকল্প নেই।’

গ্রামবাসী এই প্রথার বিরুদ্ধে যেতে ভয় পান। তাঁদের বিশ্বাস, প্রথা ভাঙলে অকল্যাণ হবে। এতে তাঁদের পরিবারের লোকজন অসুস্থ, এমনকি মারাও যেতে পারে।

১০ বছর আগে মাসিকের সময় কুঁড়েঘরে সাপের কামড়ে ২১ বছরের এক তরুণীর মৃত্যুর কথা জানান প্রতিবেশী ৪৫ বছরের দুরপাতা উসেনদি। তিনি বলেন, ওই তরুণী কুঁড়েঘর থেকে বের হয়ে চিৎকার করতে করতে ছুটে এলেন, তখন মধ্যরাত। তাঁর পরিবারের নারীরা তাঁকে ভেষজ ও স্থানীয় ওষুধ দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর ঘরের পুরুষ সদস্যরা দূর থেকে সেই দৃশ্য শুধু দেখেছেন। যেহেতু মাসিক হওয়ায় ওই নারী ‘অপবিত্র’, তাই তাঁকে সাহায্য করতে কোনো পুরুষ স্বজন এগিয়ে আসেননি। ধীরে ধীরে বিষ তাঁর পুরো গায়ে ছড়িয়ে পড়লে তিনি নেতিয়ে পড়েন এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়।

এমন অবস্থায় তুকুম গ্রামের এই নারীদের জন্য নিরাপদ আবাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছে মুম্বাইভিত্তিক দাতব্য সংস্থা খেরওয়াদি সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন।

মাসিকের সময় নারীদের একটি নিরাপদ স্থান ও স্বস্তি দিতে গত বছর নতুন ঘর তৈরি করে দিয়েছে সংস্থাটি। সেখানে রয়েছে বিছানা, শৌচাগার, পানির ব্যবস্থা ও সোলার প্যানেলের বিদ্যুৎ। সেখানে এখন গ্রামের ৯০ জন নারী সেই বিশেষ সময়ে থাকেন। তাঁদের ভাষ্য, আগে তাঁরা ভাঙাচোরা কুঁড়েঘরে থাকতেন। মাটি ও বাঁশের তৈরি কুঁড়েঘরে ছিল খড়ের ছাদ, তবে ছিল না দরজা, জানালা। ছিল না মৌলিক সুযোগ-সুবিধা। গোসল ও কাপড় ধোয়ার জন্য তাঁদের এক কিলোমিটার হেঁটে নদীতে যেতে হয়।

নতুন ঘরটি তৈরিতে ইটের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের পানির বোতল। সেগুলোয় বালু ভর্তি করে ব্যবহার করা হয়েছে। দেয়ালগুলো নানা রঙের বোতলের ছিপি দিয়ে সাজানো। ঘরে রাখা হয়েছে আটটি শয্যা। আর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যেটি, তা হলো ঘরের ভেতর শৌচাগার এবং দরজা আছে, যা তাঁরা তালাবদ্ধ করতে পারবেন।

গ্রামবাসীর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, অন্তত ২১ জন নারী ওই সব কুঁড়েঘরে থেকে মারা গেছেন। তাঁদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয় সাপের কামড়ে। একজনকে ভালুক ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আর আরেকজন প্রচণ্ড জ্বরে ভুগে মারা যান।

খেরওয়াদি সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের নিকোলা মন্তেরিও বলেন, এই ঘর বানাতে আড়াই মাস লেগেছে। খরচ হয়েছে সাড়ে ছয় লাখ রুপি। বেসরকারি এই উন্নয়ন সংস্থা এখন পর্যন্ত এমন চারটি ঘর তৈরি করেছে। জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে আরও ১০টি আছে চালু হওয়ার অপেক্ষায়।

কিন্তু এই ঘরের চেয়ে যেটা বেশি প্রয়োজন তা হলো এই কুসংস্কারের বাধা অতিক্রম করা। সমালোচকেরা বলছেন, সবচেয়ে ভালো হতো কোরমা ঘর বা গাওকর নামের এই কুঁড়েঘরগুলো একসঙ্গে উচ্ছেদ করে দিতে পারলে। কিন্তু দাতা সংস্থার কর্মীরা মনে করছেন, মাসিক নিয়ে লোকলজ্জা থাকলেও নারীদের জন্য সবার আগে একটি নিরাপদ আশ্রয় দরকার।

স্থানীয় দাতব্য সংস্থা স্পর্শের প্রেসিডেন্ট দিলীপ বারসাগাদে বলেন, এই এলাকায় তিনি ১৫ বছর ধরে কাজ করছেন। কয়েক বছর আগে তিনি ২২৩টি মাসিক কুঁড়েঘর ঘুরে দেখেছেন। এর মধ্যে ৯৮ শতাংশই ছিল অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদ। গ্রামবাসীর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, অন্তত ২১ জন নারী ওই সব কুঁড়েঘরে থেকে মারা গেছেন। তাঁদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয় সাপের কামড়ে। একজনকে ভালুক ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আর আরেকজন প্রচণ্ড জ্বরে ভুগে মারা যান।

দিলীপ এসব ঘটনা তুলে ধরার পর ভারতের মানবাধিকার কমিশন এই প্রথাকে ‘নারীদের মানবাধিকার, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যবিধি ও মর্যাদার লঙ্ঘন’ বলে উল্লেখ করে। পরে রাজ্য সরকারকে প্রথাটি ‘বাতিল করার’ ব্যবস্থা নিতেও নির্দেশ দেয় ভারতের মানবাধিকার কমিশন। কিন্তু এখনো সেই প্রথা আগের মতোই বহাল আছে।

গ্রামবাসী এই প্রথার বিরুদ্ধে যেতে ভয় পান। তাঁদের বিশ্বাস, প্রথা ভাঙলে অকল্যাণ হবে। এতে তাঁদের পরিবারের লোকজন অসুস্থ, এমনকি মারাও যেতে পারে। সুরেখা হালামি বলেন,‘আমার দাদি ও মা কুরমা ঘরে গেছে। আমিও প্রতি মাসে যাই। আমার মেয়েকেও একদিন সেখানে পাঠাব।’

এই প্রথা ভাঙা যাবে না। এর পেছনে আছে ধর্মীয় কারণ। যে এ নিয়ম ভাঙবে, তাকে শাস্তি পেতে হবে। আর্থিক জরিমানা গুনতে হতে পারে।
বিবিসিকে চেন্দো উসেন্দি নামের এক গ্রামপ্রধান

নিকোলা মন্তেরিও বলেন, ‘এলাকাটি খুবই প্রত্যন্ত। এখানে যেকোনো পরিবর্তনই খুবই ধীরে ধীরে হয়। নতুন এই ঘর নারীদের নিরাপদ আশ্রয় দেবে। আমাদের পরের কাজ হলো এই সম্প্রদায়কে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা, যাতে তারা নিজেরাই কুসংস্কারমুক্ত হতে পারে।’

এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা নারীরা নিজেরাই এটা তাঁদের অধিকারের কত বড় লঙ্ঘন তা বোঝেন না বলে মনে করেন দিলীপ। তিনি বলেন, ‘আমরা জানি, উন্নত ঘরগুলো এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান নয়। নারীদের এ সময় শারীরিক ও মানসিক সমর্থন প্রয়োজন হয়, যা কেবল নিজের বাড়িতেই পাওয়া সম্ভব। কিন্তু আমরা দেখলাম, এই প্রথার বিরোধিতা করা খুব সহজ নয়। পরিস্থিতি পাল্টে দেওয়ার মতো কোনো জাদুর কাঠি আমাদের হাতে নেই।’

তবে আশার কথাও শুনিয়েছেন দিলীপ। তিনি জানান, অনেক শিক্ষিত নারীর মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে। তাঁরা এই প্রথা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। পরিবর্তন আসতে সময় নেবে, তবে একদিন আসবেই।