আমাদের পূর্বপুরুষেরা এসেছে আফ্রিকা থেকে, কিন্তু কবে

শিল্পীর চোখে পাহাড়ের গুহায় আদিম মানুষের বসবাস। ক্রোয়েশিয়ার নিয়েনদেরথাল জাদুঘরে ২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তোলাছবি: রয়টার্স

মানুষ সবার আগে থাকতো আফ্রিকায়। একসময় আমাদের বা আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষেরা আফ্রিকার ভূখণ্ড ছাড়তে শুরু করে। ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিশ্বে। তবে এ প্রক্রিয়া কবে শুরু হয়েছিল, কবে নাগাদ মানুষ বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল, এসব নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা আজও একমত হতে পারেননি।

দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশ লাওসের তাম পা লিং গুহা থেকে দুটি ফসিল উদ্ধার হয়েছে। এসব ফসিল হোমো সেপিয়েন্স বা মানুষের। নতুন এক গবেষণায় বলা হয়েছে, এসব ফসিল প্রায় ৮৬ হাজার বছর আগের। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৮৬ হাজার বছর আগে এ অঞ্চলে মানুষের উপস্থিতি ছিল।

গবেষণালব্ধ এই তথ্য প্রচলিত একটি মতকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। তা হলো, মানুষ রৈখিক পথে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। আর আজ থেকে ৫০–৬০ হাজার বছর আগে একটি একক তরঙ্গে সংঘটিত হয়েছিল। সহজ করে বললে, ওই সময় একক কোনো ঘটনায়, একযোগে মানুষ বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল।

ওই দুই ফসিল নিয়ে গবেষণায় সম্পৃক্ত অস্ট্রেলিয়ার ম্যাকুরি ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক কিরা ওয়েস্টঅ্যাওয়ে বলেন, হয়তোবা প্রথম দিককার এই অভিবাসন ব্যর্থ হয়েছিল। তবে ওই সময়ে এ অঞ্চলে মানুষের পা পড়েছিল, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্জন।

আফ্রিকা থেকে ৫০–৬০ হাজার বছর আগে মানুষের বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার ধারণাটি পোক্ত করেছে আধুনিক মানুষের ডিএনএ বিশ্লেষণ। এর ভিত্তিতে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা মনে করছেন, আমাদের পূর্বপুরুষেরা আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে উপকূল ঘেঁষে অগ্রসর হয়েছিল। এরপর এখনকার দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দ্বীপগুলো ছাড়িয়ে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল।

৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার বছর আগে মানুষের অভিবাসনের বিষয়টি ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেছে। তবে এর আগেও এমন কিছু ঘটে থাকতে পারে। হয়তো সেসব প্রচেষ্টা সফল হয়নি।
কিরা ওয়েস্টঅ্যাওয়ে, অস্ট্রেলিয়ার ম্যাকুরি ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক।

তবে এই ধারণা এত সহজ–সরল নয়। বিশেষ করে বিভিন্ন সময় চীনে আবিষ্কৃত হওয়া মানবফসিল থেকে পাওয়া তথ্য এই বিষয়ে জটিলতার কথা জানান দেয়।

কিরা ওয়েস্টঅ্যাওয়ে বলেন, ৫০ থেকে ৬০ হাজার বছর আগে মানুষের অভিবাসনের বিষয়টি ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেছে। তবে এর আগেও এমন কিছু ঘটে থাকতে পারে। হয়তো সেসব প্রচেষ্টা সফল হয়নি। ওই সময়ের মানুষের ডিএনএ আমাদের জেনেটিকসে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।

লাওসের তাম পা লিং গুহায় সন্ধান পাওয়া ফসিল দুটির মধ্যে পায়ের হাড়ের একটি টুকরো ও একটি খুলির সামনের অংশও রয়েছে। ২০০৯ সালে এটা আবিষ্কার করা হয়। ওই সময় সেখানে আরেকটি মাথার খুলির অংশ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল।

সাম্প্রতিক আবিষ্কারগুলো ছাড়াও লাওসের এই এলাকা থেকে প্রাচীন দুটি চোয়ালের হাড়, একটি পাঁজর ও একটি আঙুলের হাড় খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। খুঁজে পাওয়া এসব দেহাবশেষ এটাই প্রমাণ করে যে আমাদের ধারণার আগেও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দ্বীপে মানুষের উপস্থিতি ছিল।

প্রত্নতত্ত্ববিদেরা মনে করছেন, আমাদের পূর্বপুরুষেরা আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে উপকূল ঘেঁষে অগ্রসর হয়েছিল। এরপর এখনকার দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দ্বীপগুলো ছাড়িয়ে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল।

এসবের বয়স নির্ধারণে ‘রেডিওকার্বন ডেটিং’ পদ্ধতি বেশ কার্যকর। তবে এই পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা হলো, এটা ৪৬ হাজার বছরের বেশি পুরোনো জিনিসের ক্ষেত্রে কার্যকর নয়। এ ছাড়া তাম পা লিং গুহা ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্গত একটি স্থাপনা। কিরা ওয়েস্টঅ্যাওয়ের মতে, যেহেতু এই এলাকা লাওসের আইনের দ্বারা সুরক্ষিত, তাই এখানে খুঁজে পাওয়া মানবফসিলের বয়স উল্লেখ করা আইনসম্মত নয়।

এ–সংক্রান্ত গবেষণাপত্র গত মঙ্গলবার বিশ্বখ্যাত নেচার কমিউনিকেশনস সাময়িকীতে প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, খুঁজে পাওয়া ফসিলের প্রকৃত বয়স নির্ধারণে দুটি কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে। এসব বৈজ্ঞানিক কৌশলের ফল দেখে অনুমান করা যায় যে খুঁজে পাওয়া ফসিলগুলো ৬৮ হাজার থেকে ৮৬ হাজার বছর আগের। এর মধ্যে পায়ের হারের টুকরাটি সবচেয়ে বেশি পুরানো।

কিরা ওয়েস্টঅ্যাওয়ের মতে, এই গবেষণাকাজে সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ তাম পা লিং গুহার অবস্থান। গুহাটি সমুদ্র থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার ওপরে। ছিল গভীর বনে আবৃত। সাধারণত আমরা ধারণা করি যে আদিম মানুষেরা নদী কিংবা সাগরের তীর ধরে এক জায়গা থেকে অন্যত্র যেত। কিন্তু এ গুহায় ফসিল খুঁজে পাওয়ার ঘটনা বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবাবে। আমরা বুঝতে পারব, আদিম মানুষেরা উচ্চভূমি ও বনের ভেতর দিয়েও অনায়াসে অভিবাসন করতে সক্ষম ছিলেন।

প্রত্নতত্ত্ববিদেরা লাওসের ওই অঞ্চলের অপর গুহাগুলো থেকেও আরও ফসিল খুঁজে পাওয়ার আশা করছেন। কিরা ওয়েস্টঅ্যাওয়ে বলেন, লাওসের তাম পা লিং গুহা কার্স্ট পর্বতে আবিষ্কৃত হওয়া পাঁচটি জায়গার একটি, যেখানে মানুষের উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে।