বিশ্বের কোন ধনকুবেররা জনকল্যাণে সবচেয়ে বেশি দান করেন

বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ের ধনকুবেরদের কেউ কেউ নিজেদের সম্পদকে শুধু নিজের জন্য নয়, সমাজের কল্যাণে ব্যবহার করছেন। জনসেবামূলক কাজে অর্থ বিলিয়ে দিচ্ছেন। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, পরিবেশ সংরক্ষণ, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের উন্নয়নে অবদান রাখছেন তাঁরা।

কেউ নিট সম্পদের বিশাল অংশ দান করেছেন। আবার কেউ কেউ এমন সব কর্মসূচিতে হাজার কোটি ডলার বিলিয়ে দিচ্ছেন, যা জনকল্যাণে ব্যয় করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী ফোর্বসের তালিকা অনুযায়ী ১০ দানশীল ধনকুবের সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

ওয়ারেন বাফেট ও পরিবার

ওয়ারেন বাফেট
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারী ওয়ারেন বাফেট বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ৯৫ বছর বয়সী এই ধনকুবেরের নিট সম্পদের পরিমাণ ১৪ হাজার ৬৭০ কোটি ডলার। তিনি এ পর্যন্ত ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলার দান করেছেন। এটি বাফেটের মোট সম্পদের ৩০ শতাংশের সমান।

মূলত স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন ও দারিদ্র্য দূর করার লক্ষ্যে বাফেট অনুদান দিয়ে থাকেন। গেটস ফাউন্ডেশন ও নিজ সন্তানদের পরিচালিত বিভিন্ন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বাফেট তাঁর অনুদানগুলো দিয়ে থাকেন।

বিল গেটস ও মেলিন্ডা ফ্রেঞ্চ গেটস

বিল গেটস ও তাঁর সাবেক স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস
ছবি: রয়টার্স  ফাইল ছবি

যুক্তরাষ্ট্রের আরেক ধনকুবের বিল গেটস ও তাঁর সাবেক স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস এ পর্যন্ত যৌথভাবে ৪ হাজার ৭৭০ কোটি ডলার দান করেছেন। যৌথভাবে সাবেক এই দম্পতির নিট সম্পদের পরিমাণ ১০ হাজার ৮৬০ কোটি ডলার। মূলত আন্তর্জাতিকভাবে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে তাঁরা অনুদান দিয়ে থাকেন।

বিশ্বের অন্যতম বড় দাতব্য প্রতিষ্ঠান বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এ সহায়তা দেওয়া হয়। বিল ও মেলিন্ডা অনেক বছর ধরেই টিকা কর্মসূচি, রোগ নির্মূল কর্মসূচি ও শিক্ষাবিষয়ক উদ্যোগগুলোতে অর্থায়ন করে আসছেন। বিবাহবিচ্ছেদের পরও দুজনই দানশীল কাজগুলো করে যাচ্ছেন।

জর্জ সরোস

জর্জ সরোস
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী ও বিনিয়োগকারী জর্জ সরোস এ পর্যন্ত ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার দান করেছেন। নিজের প্রতিষ্ঠিত ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে এ অনুদানগুলো দেওয়া হয়েছে।

বর্তমানে সরোসের নিট সম্পদের পরিমাণ ৭২০ কোটি ডলার। তিনি মূলত গণতন্ত্র, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ও নাগরিক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করতে অনুদান দিয়ে থাকেন। তাঁর অনুদানগুলো, বিশেষ করে ইউরোপের মধ্যাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলীয় দেশগুলোতে যায়। মুক্ত মতপ্রকাশ, শিক্ষা ও সরকারি স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার মতো ক্ষেত্রগুলোতেও সরোস অনুদান দিয়ে থাকেন।

মাইকেল ব্লুমবার্গ

মাইকেল ব্লুমবার্গ
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক নগরের সাবেক মেয়র ও ধনকুবের মাইকেল ব্লুমবার্গ। তিনি ব্লুমবার্গ এলপি নামের প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর নিট সম্পদের পরিমাণ ১০ হাজার ৪৭০ কোটি ডলার। তিনি এ পর্যন্ত ২ হাজার ১১০ কোটি ডলার দান করেছেন, যা তাঁর নিট সম্পদের ১৭ শতাংশ।

মাইকেল ব্লুমবার্গের দানের পরিধি বিস্তৃত। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থসহায়তা দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির মেডিকেল স্কুলে বিনা টিউশন ফিতে পড়াশোনার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছে।

ম্যাকেঞ্জি স্কট

ম্যাকেঞ্জি স্কট
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

মার্কিন ঔপন্যাসিক ও ধনকুবের ম্যাকেঞ্জি স্কট এ পর্যন্ত ১ হাজার ৯২৫ কোটি ডলার দান করেছেন, যা তাঁর নিট সম্পদের প্রায় ৩৬ শতাংশ। ম্যাকেঞ্জি স্কটের নিট সম্পদের পরিমাণ ৩ হাজার ৩৬০ কোটি ডলার। তিনি অ্যামাজনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসের সাবেক স্ত্রী।

স্কট মূলত শিক্ষা, বাসস্থান ও অর্থনৈতিক সমতার মতো ক্ষেত্রগুলোতে দান করে থাকেন। প্রান্তিক ও বঞ্চিত সম্প্রদায়ের সংগঠনগুলোসহ হাজার হাজার প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা দেন তিনি। সমাজের জরুরি প্রয়োজনগুলো দ্রুত পূরণ করার জন্য ম্যাকেঞ্জি স্কট প্রায়ই নিঃশর্ত অনুদান দেন।

ম্যারিলিন সিমন্স ও পরিবার

ম্যারিলিন সিমন্স
ছবি: সিমন্স ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইট

ম্যারিলিন সিমন্স ও তাঁর পরিবার এ পর্যন্ত ৯৪০ কোটি ডলার দান করেছে, যা তাদের নিট সম্পদের ২৩ শতাংশ। সিমন্স ও তাঁর পরিবারের নিট সম্পদের পরিমাণ ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলার। মূলত বিজ্ঞান, গণিত ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাসংক্রান্ত কর্মসূচিগুলোতে পরিবারটি দান করে থাকে।

ম্যারিলিন মূলত তাঁর স্বামী জিম সিমন্সের সঙ্গে মিলে দানশীল কাজগুলো শুরু করেছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পরও সে কাজগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। বিশেষ করে পরিবেশগত সুরক্ষা ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি–বিষয়ক ক্ষেত্রগুলোতে তিনি সহায়তা দিয়ে থাকেন। নিজস্ব মালিকানাধীন দ্য সিমন্স ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মসূচিতে তহবিল দেওয়া হয়।

মার্ক জাকারবার্গ ও প্রিসিলা চ্যান

মার্ক জাকারবার্গ ও প্রিসিলা চ্যান
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

প্রযুক্তি খাতের অন্যতম শীর্ষ ধনী মার্ক জাকারবার্গ ও প্রিসিলা চ্যান দম্পতি এ পর্যন্ত ৫১০ কোটি ডলার পরিমাণ অর্থ দান করেছেন, যা তাঁদের নিট সম্পদের ২ দশমিক ১ শতাংশ। যৌথভাবে তাঁদের নিট সম্পদের পরিমাণ ২৩ হাজার ২৮০ কোটি ডলার। তাঁদের অনুদানের ক্ষেত্র মূলত বিজ্ঞান ও শিক্ষা।

এর মধ্য দিয়ে মানবজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করা এবং শেখার সুযোগ আরও বিস্তৃত করতে চান এই দম্পতি। তাঁরা চ্যান জাকারবার্গ বায়োহাবের মতো গবেষণাকেন্দ্রও প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখানে বিজ্ঞানী জটিল স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান নিয়ে গবেষণা করেন। মার্ক জাকারবার্গ ও প্রিসিলা চ্যান বিভিন্ন স্কুলে উদ্ভাবনী কর্মসূচিতেও বিনিয়োগ করে থাকেন।

স্টিভ ও কনি বালমার

স্টিভ বালমার ও কনি বালমার
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

মাইক্রোসফটের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্টিভ বালমার এবং তাঁর স্ত্রী কনি বালমার এ পর্যন্ত ৪৯৯ কোটি ডলার দান করেছেন, যা তাঁদের নিট সম্পদের প্রায় ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। তাঁদের নিট সম্পদের পরিমাণ ১৩ হাজার ১০ কোটি ডলার।
জলবায়ুবিষয়ক বিভিন্ন উদ্যোগ ও দুর্যোগ মোকাবিলাবিষয়ক বিভিন্ন কর্মসূচিতে স্টিভ ও কনি অনুদান দিয়ে থাকেন। বালমার দম্পতি শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার ও বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে সহায়তা দেন। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের ক্ষমতায়নের জন্যও কাজ করেন তাঁরা।

জেফ বেজোস

জেফ বেজোস
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

ই-কমার্স জায়ান্ট অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস এ পর্যন্ত জনসেবামূলক কাজে ৪১০ কোটি ডলার দান করেছেন, যা তাঁর নিট সম্পদের ১ দশমিক ৬ শতাংশ। বেজোসের নিট সম্পদের পরিমাণ ২৫ হাজার ১০০ কোটি ডলার।
জলবায়ুপরিবর্তন মোকাবিলা, গৃহহীন মানুষদের সহায়তা ও শিক্ষামূলক কার্যক্রমে বেজোস অনুদান দিয়ে থাকেন। বেজোস আর্থ ফান্ড হল তাঁর বৃহত্তম উদ্যোগ।
জলবায়ু সমস্যার সমাধানে বেজোসের এই তহবিল ভূমিকা রাখে। নিম্ন আয়ের পরিবারের জন্য বাসস্থান ও শিক্ষাসংক্রান্ত সহায়তা দিয়ে থাকেন তিনি। বেজোস একাডেমির মতো প্রকল্পেও অর্থায়ন করেন এই ধনকুবের। এ ধরনের প্রকল্পের আওতায় বিনা টিউশন ফিতে প্রি-স্কুল পরিচালনা করা হয়।

১০

ফিল ও পেনি নাইট

ক্রীড়া সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান নাইকির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফিল নাইট ও তাঁর স্ত্রী পেনি নাইটও বিভিন্ন দাতব্য কাজ করে থাকেন। তাঁরা এ পর্যন্ত ৩৯৮ কোটি ডলার দান করেছেন, যা তাঁদের নিট সম্পদের ১০ শতাংশ। এই দম্পতির নিট সম্পদের পরিমাণ ৩ হাজার ৪১০ কোটি ডলার।

ফিল ও পেনির দাতব্য কার্যক্রমের মূল ক্ষেত্র হলো শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা। তাঁরা ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয় ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা দিয়ে আসছেন। তাঁরা গবেষণাকাজের জন্য ক্যাম্পাস নির্মাণ ও বৃত্তি কর্মসূচিতে অর্থায়ন করেছেন, যা উদ্ভাবন ও শিক্ষার সুযোগ বিস্তারে ভূমিকা রেখেছে।
তথ্যসূত্র: ফোর্বস, টাইমস অব ইন্ডিয়া