সমুদ্র রক্ষায় ঐতিহাসিক চুক্তি

দীর্ঘদিনের আলোচনার পর সমুদ্র চুক্তিতে সম্মত হয়েছে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো
ছবি : এএফপি

এক দশকের বেশি সময় ধরে আলোচনা ও দর-কষাকষির পর অবশেষে পৃথিবীর সব সাগর-মহাসাগর রক্ষায় ‘ঐতিহাসিক’ চুক্তিতে উপনীত হয়েছে জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলো। চুক্তির আওতায় সমুদ্রের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ২০৩০ সালের মধ্যে সাগর-মহাসাগরের ৩০ শতাংশ এলাকা সংরক্ষিত ঘোষণার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

টানা ৩৮ ঘণ্টা আলোচনার পর শনিবার সন্ধ্যায় নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ‘হাই সিজ ট্রিটি’ নামের চুক্তিটির ব্যাপারে সবার সম্মতি মেলে। সম্মেলনের সভাপতি রেনা লি নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে প্রতিনিধিদের সামনে দীর্ঘ করতালির মধ্যে উচ্চ স্বরে ঘোষণা করেন, ‘আমাদের প্রচেষ্টা অবশেষে লক্ষ্যে পৌঁছেছে।’
খসড়াটি তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। তবে ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে আলোচনার পর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত হিসেবে পরিবেশবাদীরা এটিকে স্বাগত জানিয়েছেন।

২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৩০ শতাংশ ভূমি এবং মহাসাগর সংরক্ষণে চুক্তিটিকে অপরিহার্য হিসেবে দেখা হয়। এর আগে গত ডিসেম্বরে মন্ট্রিলে স্বাক্ষরিত একটি ঐতিহাসিক চুক্তিতে বিশ্বের সরকারগুলো এ বিষয়ে সম্মত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংস্থা গ্রিন পিসের পরামর্শক লরা মেলার বলেন, প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক দিন। এই বিভক্ত বিশ্বে প্রকৃতি সুরক্ষা ও ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে মানুষ যে জয়ী হতে পারে, তার চিহ্ন এটি।

লরা বলেন, চুক্তিটি পরবর্তী সময়ে আইনজীবীরা পরীক্ষা করে দেখবেন। এ ছাড়া জাতিসংঘের ছয়টি সরকারি ভাষায় অনুবাদ করার পর এটি আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হবে। তবে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা আলোচনার পর প্রতিনিধিরা যে চুক্তি চূড়ান্ত করেছেন, তাতে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন আনা যাবে না।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস চুক্তি সই করায় প্রতিনিধিদের প্রশংসা করেন। জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র বলেছেন, এটি বহুপক্ষীয় মতের একটি বিজয়। সমুদ্রের স্বাস্থ্য এখন ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের মুখে পড়েছে, তা ঠেকানোর প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে একটি বড় অর্জন।

পৃথিবীর মোট পৃষ্ঠভাগের অর্ধেকের বেশি ও সমুদ্রের ৬০ শতাংশের বেশি এই হাই সির অন্তর্ভুক্ত। হাই সি হচ্ছে আন্তর্জাতিক জলসীমা, যেখানে সব দেশের অধিকার, জাহাজ চালানো ও গবেষণার অধিকার রয়েছে। উপকূলীয় সীমা ও কয়েকটি আইকনিক প্রজাতি প্রাণী সংরক্ষণ ছাড়া সমুদ্র রক্ষায় এত দিন খুব বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়নি। অথচ মানুষের প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের অর্ধেকের বেশি তৈরি হয় সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের মাধ্যমে। এ ছাড়া মানবসৃষ্ট কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে বৈশ্বিক উষ্ণতা সীমিত রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ আর অতিরিক্ত মৎস্য আহরণের ফলে সমুদ্র ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। বর্তমানে হাই সি এলাকার মাত্র ১ শতাংশ সংরক্ষিত। নতুন এই চুক্তি যখন কার্যকর হবে, তখন আন্তর্জাতিক জলসীমায় সামুদ্রিক প্রাণী সুরক্ষার জন্য নির্দিষ্ট এলাকা গড়ে তোলা যাবে।

পিউ চ্যারিটেবল ট্রাস্টের কর্মী লিজ কারান বলেন, আন্তর্জাতিক জলসীমায় সুরক্ষিত এলাকা তৈরির বিষয়টি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিপরীতে টেকসই ভূমিকা নিতে পারে। এ ছাড়া চুক্তির ফলে সমুদ্রে প্রস্তাবিত কার্যক্রমের পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নে দেশগুলো বাধ্য হবে।

চুক্তির সুবিধা

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সমুদ্র রক্ষায় সর্বশেষ যে আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়েছিল, তা হলো ইউএন কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য সি, যা প্রায় ৪০ বছর আগে ১৯৮২ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ওই চুক্তি হাই সি ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করলেও তার মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ সুরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, অত্যধিক মাছ ধরা ও জাহাজ চলাচলের কারণে সংরক্ষিত এলাকার বাইরে থাকা সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে আছে। আইইউসিএন বলছে, এর মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার মুখে রয়েছে।

নতুন চুক্তিতে আন্তর্জাতিক সমুদ্রে নতুন সুরক্ষিত অঞ্চল গড়া হলে মাছ ধরা, গভীর সমুদ্রে খননসহ জাহাজ চলাচলের পথ নির্ধারণের বিষয়গুলো সীমিত করা যাবে। এ ছাড়া গভীর সমুদ্রে যেকোনো কার্যক্রম কঠোর পরিবেশগত নীতিমালার আওতায় আনা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সিবেড কর্তৃপক্ষ।

আইইউসিএন ওশেন দলের পরিচালক মিন্না এপস বলেন, আলোচনার মূল বিষয় ছিল আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় পাওয়া জিনগত সম্পদ ভাগাভাগি নিয়ে। সামুদ্রিক জিনগত সম্পদ হলো সমুদ্রের উদ্ভিদ এবং প্রাণীর জৈবিক উপাদান, যা ওষুধ, শিল্পপ্রক্রিয়া এবং খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। ধনী দেশগুলোর কাছে বর্তমানে গভীর সমুদ্রে অন্বেষণ করার জন্য সম্পদ এবং তহবিল রয়েছে, তবে দরিদ্র দেশগুলো সমুদ্রে পাওয়া সুবিধা সমানভাবে ভাগের বিষয়টি নিশ্চিত করতে চায়।

লিজ কারান বলেন, চুক্তিটি কার্যকর হতে এখনো বেশ খানিকটা সময় লাগবে। এটি কার্যকর হওয়ার আগে দেশগুলোকে চুক্তিটিতে অনুসমর্থন দিতে হবে। এরপর বিজ্ঞান ও কারিগরি কমিটির মতো অনেকগুলো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ঠিক করতে হবে।