বিশ্বের বড় ১০ লৌহখনির ৮টিই অস্ট্রেলিয়াতে

লোহা মানব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও বহুমুখী উপকারী ধাতু। শক্তিশালী কার্বন স্টিলের মতো উন্নত নির্মাণ উপকরণ থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত সাইকেলের চেইন বা বাসার পাইপ—সব জায়গায় লোহার ব্যবহার দেখা যায়। স্বাস্থ্যসেবা, নির্মাণকাজ, অটোমোবাইলসহ নানা শিল্পে লোহার ব্যবহার বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লৌহখনির খনন। ২০২৩ সালে বিশ্বে মানুষ ব্যবহারযোগ্য লোহার আকরিক উত্তোলন করেছে ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন টনেরও বেশি। খনিতে মূলত লোহার আকরিক পাথরের আকারে, অর্থাৎ অশোধিত অবস্থায় পাওয়া যায়। প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে ধাতব লোহা উৎপাদিত হয়। ২০২৪ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০ খনি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস। এর মধ্যে আট খনিরই অবস্থান অস্ট্রেলিয়ায়। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিশ্বের বড় ১০টি লোহার খনি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

সেরা নোর্তে মাইনিং কমপ্লেক্স

বিশ্বের সবচেয়ে বড় লোহার খনি সেরা নোর্তে মাইনিং কমপ্লেক্সের অবস্থান ব্রাজিলের পারা প্রদেশে। ১৯৮৪ সালে খনিটি চালু হয়। এটি গড়ে তোলে ব্রাজিলের অন্যতম বৃহৎ খনন সংস্থা ভেলে এসএ। শুরুতে ছোট পরিসরে চালু হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ খনি কমপ্লেক্স সম্প্রসারিত হয়েছে। ২০২৩ সালে খনিটি থেকে প্রায় ১০ কোটি ২৮ লাখ টন (২২৬ বিলিয়ন পাউন্ড) লোহার আকরিক উত্তোলন করা হয়েছে। বড় খনির তালিকায় স্থান পাওয়া অন্য খনিগুলোর তুলনায় সেরা নোর্তে বেশি পুরোনো।

কারাজাস সেরা সুল এস১১ডি

কারাজাস সেরা সুল এস১১ডি হলো আরেকটি বিশাল লৌহ আকরিক খনি। এর অবস্থানও ব্রাজিলের পারা অঞ্চলে। দেশটির বড় খনন সংস্থা ভেলে এসএ এটি পরিচালনা করছে। তবে খনিটি তুলনামূলক নতুন। ২০১৬ সালে এর খনন কার্যক্রম শুরু হয়। এতে ১ হাজার ৯৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হয়। বর্তমানে এটি শুধু ব্রাজিলেই নয়, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম লোহার আকরিক খনি হিসেবে স্বীকৃত।
২০২৩ সালে এ খনি থেকে ৭ কোটি ৬৬ লাখ ৭০ হাজার টন (১৫৩ বিলিয়ন পাউন্ড) লোহার আকরিক উত্তোলন করা হয়েছে।

মাউন্ট নিউম্যান জয়েন্টভেঞ্চার

নিউম্যান লৌহখনি
ছবি: বিএইচপির ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম লোহার খনি মাউন্ট নিউম্যান জয়েন্টভেঞ্চারের অবস্থান পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায়। চারটি প্রক্রিয়াকরণ ও পাঁচটি খনন কেন্দ্র নিয়ে এটি গঠিত। এ খনি একাধিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন। তবে সিংহভাগ মালিকানায় আছে বিএইচপি গ্রুপ লিমিটেড ও মিতসুই-ইটোচু আয়রন পিটি লিমিটেড। এ খনি থেকে বছরে ৬ কোটি ৬৯ লাখ ৯০ হাজার টন (১৩৪ বিলিয়ন পাউন্ড) লোহা উত্তোলন করা হয়। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার আয়রনসমৃদ্ধ অঞ্চল পিলবারায় খনিটির অবস্থান হওয়ায় আরও ২৫ বছর এখান থেকে উত্তোলনের কাজ চালিয়ে যাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

জিম্বলবার হাব

জিম্বলবার হাব খনি
ছবি: বিএইচপির ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার নিউম্যান থেকে প্রায় ৪০ মাইল দূরে অবস্থিত জিম্বলবার হাব আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খনি। এটি ১৯৮৯ সালে চালু হয়। এর পর থেকে ব্যাপক সম্প্রসারণকাজের কারণে এটি অনেক বড় খনি হয়ে ওঠে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই পুরোপুরি বিএইচপি গ্রুপ লিমিটেডের মালিকানায় আছে খনিটি। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম এ লোহার খনি থেকে বছরে ৬ কোটি ৬৮ লাখ (১৩৩ বিলিয়ন পাউন্ড) টন লোহা উত্তোলন করা হয়। নিজস্ব উৎপাদনের পাশাপাশি খনিটিতে অন্য জায়গা থেকে আনা আকরিক প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। বিশেষ করে, হুইলারা ডিপোজিটের লৌহ আকরিকগুলো প্রক্রিয়াকরণের জন্য জিম্বলবার হাবে পাঠানো হয়।

এরিয়া সি মাইন

এরিয়া সি খনি
ছবি: বিএইচপির ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পিলবারা অঞ্চলে এরিয়া সি মাইন খনির অবস্থান। এটি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম লৌহ খনি। ২০০৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ইস্পাত প্রতিষ্ঠান পিওএসসিও-এর সঙ্গে যৌথভাবে খনিটি চালু করে বিএইচপি। বর্তমানে এ খনির সিংহভাগের মালিক বিএইচপি গ্রুপ লিমিটেড। এরিয়া সি মাইন থেকে প্রতিবছর প্রায় ৫ কোটি ৮৪ লাখ ৭০ হাজার টন (১১৭ বিলিয়ন পাউন্ড) লৌহ আকরিক উত্তোলন করা হয়ে থাকে।

সাউথ ফ্ল্যাঙ্ক প্রজেক্ট

সাউথ ফ্ল্যাঙ্ক প্রজেক্ট
ছবি: বিএইচপির ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

এরিয়া সি খনি থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে পিলবারা অঞ্চলে সাউথ ফ্ল্যাঙ্ক প্রজেক্ট খনির অবস্থান। এ খনিরও মালিক বিএইচপি। ২০২১ সালে এ খনিতে প্রথম লোহা উত্তোলনের কাজ শুরু হয়। এর পর থেকে এর উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। বর্তমানে সাউথ ফ্ল্যাঙ্ক প্রজেক্ট খনি থেকে প্রতিবছর প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ টন (১১২ বিলিয়ন পাউন্ড) লোহার আকরিক উত্তোলন করা হয়। এটি বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম খনি।

গ্রেটার টম প্রাইস মাইন

পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পিলবারা অঞ্চলে গ্রেটার টম প্রাইস মাইন খনির অবস্থান। খনিটি সম্পূর্ণভাবে রিও টিন্টো কোম্পানির মালিকানাধীন। এটি একটি ওপেন-পিট বা উন্মুক্ত খনি প্রকল্প। গ্রেটার টম প্রাইস খনি থেকে প্রতিবছর প্রায় ৫ কোটি ১৬ লাখ ২০ হাজার টন (১০৩ বিলিয়ন পাউন্ড) লোহার আকরিক উত্তোলন করা হয়। এটি বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম লৌহ খনি। খনিটির খুব কাছেই টম প্রাইস শহরের অবস্থান। এ শহরের জনসংখ্যা প্রায় তিন হাজার। স্থানীয় লোকজনের বেশির ভাগই খনি ও এর আশপাশে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

কিংস ভ্যালি মাইন

অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় পিলবারা অঞ্চলে অবস্থিত কিংস ভ্যালি বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম লোহার খনি। এটি ফোর্টেস্কু মেটালস গ্রুপের মালিকানাধীন। কিংস ভ্যালি খনিটি ২০১৪ সালে চালু হয়। তবে খনিটির অবস্থান ইন্ডজিবার্নডি জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী ভূমিতে হওয়ায় এটি চালু করতে উদ্যোক্তাদের অনেক বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তবে অনুমোদন পাওয়ার পর দ্রুত খনির নির্মাণকাজ শেষ হয়। একটি নতুন ১২৭ কিলোমিটার (৭৯ মাইল) দীর্ঘ লাইন নির্মাণের মাধ্যমে বিদ্যমান ফোর্টেস্কু রেলওয়ের সঙ্গে খনিটিকে সংযুক্ত করা হয়েছে। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, খনিটি থেকে বছরে ৫ কোটি ১২ লাখ ৯০ হাজার টন (১০৩ বিলিয়ন পাউন্ড) লোহার আকরিক উত্তোলন করা হয়ে থাকে।

ইয়ান্ডিকুগিনা মাইন

অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় পিলবারা অঞ্চলে অবস্থিত ইয়ান্ডিকুগিনা খনিটি রিও টিন্টোর মালিকানাধীন আরেকটি বড় লোহার খনি। ১৯৯৮ সালে একটি উন্মুক্ত খনি হিসেবে এর কার্যক্রম শুরু হয় এবং তখন থেকে এটি ধারাবাহিকভাবে চালু আছে। খনি থেকে উত্তোলিত সব লোহা আকরিককে এ খনি এলাকাতেই প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এরপর তা হামার্সলি অ্যান্ড রোব রিভার রেলপথে উপকূলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকে জাহাজে করে বিভিন্ন জায়গায় নেওয়া হয়। ইয়ান্ডিকুগিনা খনিটি বিশ্বের নবম বৃহত্তম লোহার আকরিক খনি হিসেবে স্বীকৃত। এ খনি থেকে বছরে ৫ কোটি ১১ লাখ টন (১০২ বিলিয়ন পাউন্ড) লোহার আকরিক উত্তোলন করা হয়। ব্যাপক পরিমাণে লৌহ উৎপাদনের পাশাপাশি এটি রিও টিন্টোর সবচেয়ে কম খরচে পরিচালিত খনি হিসেবেও পরিচিত। ভবিষ্যৎ উন্নয়নের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এ খনিতে অন্তত ২০৩৯ সাল পর্যন্ত উত্তোলনের কাজ চলবে।

১০

ক্রিসমাস ক্রিক মাইন

ক্রিসমাস ক্রিক মাইন হলো ফোর্টেস্কু মেটালস গ্রুপ পরিচালিত একটি প্রকল্প। এটির অবস্থানও পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পিলবারায়। বৃহত্তম খনি হিসেবে তালিকায় স্থান পাওয়া খনিগুলোর মধ্যে এটি অপেক্ষাকৃত নতুন। এর কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৯ সালে। খনিটি চালু হওয়ার সময় তৎকালীন বিনিয়োগ ছিল ৩০ কোটি ডলারের বেশি। তবে খনিটি নিয়ে অনেক জটিলতা তৈরি হয়েছিল। অস্ট্রেলীয় জাতিগোষ্ঠীর পূণ্যভূমিতে খনির অবস্থান হওয়ায় জমির অধিকার নিয়ে বহু বছর ধরে আইনি ও সামাজিক বিরোধ দেখা দেয়। ক্রিসমাস ক্রিক মাইন বিশ্বের দশম বৃহত্তম লৌহ আকরিক খনি হিসেবে স্বীকৃত। এখানকার বার্ষিক উৎপাদন ৪ কোটি ৭০ লাখ ১০ হাজার টন (৯৪ বিলিয়ন পাউন্ড)। এটি একটি উন্মুক্ত খনি।