শিশুদের নিয়ে উড়োজাহাজে দীর্ঘ সময়ের ভ্রমণ যেন অনেকের কাছে এক আতঙ্ক। ভ্রমণের ঝক্কি তো আছেই, সঙ্গে শিশুদের কান্নাকাটি আর চিৎকার-চেঁচামেচি। এত কিছু সামলাতে গিয়ে অনেকে দ্রুতগতির উড়োজাহাজের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে থাকেন। তবে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত কোন উড়োজাহাজগুলো দ্রুতগতিতে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে, তা জানেন না অনেকে।
যাত্রী বহন করে এমন উড়োজাহাজগুলোর সর্বোচ্চ গতি কত, তা নিয়ে পর্যালোচনা করেছে বিবিসি সায়েন্স ফোকাস। এর আলোকে দ্রুতগতির উড়োজাহাজগুলোর তথ্য জেনে নিন:
ভার্জিন গ্যালাক্টিকের স্পেসশিপ টু ‘ইউনিটি’ বা ভিএসএস ইউনিটি নামের রকেট বিমানটি বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির উড়োজাহাজ। গতি ঘণ্টায় ৩ হাজার ৭০৪ কিলোমিটার। এটি বাণিজ্যিকভাবে মহাশূন্যে যাত্রী পরিবহন করে থাকে। ২০২১ সালের জুলাইয়ে ৬ যাত্রী এ বিমানে করে নিউ মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ করেন।
ভিএসএস ইউনিটি রকেট ইঞ্জিনচালিত। তবে এটি একা উড্ডয়ন করতে পারে না। হোয়াইট নাইট টু নামের একটি পণ্যবাহী উড়োজাহাজে করে এটিকে উৎক্ষেপণস্থলে নেওয়া হয়। উৎক্ষেপণের পর ঘণ্টায় ৩ হাজার ৪০০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে ছুটতে পারে এটি। ভিএসএস ইউনিটি পৃথিবীর পৃষ্ঠভাগ থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার উঁচুতে উড়তে পারে। উড়োজাহাজটি তৈরির ২০ বছর পর এর বাণিজ্যিক ফ্লাইট শুরু হয়। এর খরচও অনেক চড়া। ৯০ মিনিটের ফ্লাইটের জন্য ৪ লাখ ডলার মূল্যের টিকিট কাটতে হয়।
গ্লোবাল ৮০০০ উড়োজাহাজটি ২০২৫ সালে চালু হবে। এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোম্বার্ডিয়ার। প্রতিষ্ঠানটির তৈরি গ্লোবাল ৭৫০০–এর স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে এটি।
গ্লোবাল ৮০০০-এর গতি ঘণ্টায় প্রায় ১ হাজার ১৬০ কিলোমিটার। এ উড়োজাহাজে ১৯ জন যাত্রী আরাম-আয়েশে ভ্রমণ করতে পারবেন। ধারণা করা হচ্ছে, এটি ১৪ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে পারবে।
সেসনা সাইটেশন এক্স প্লাস উড়োজাহাজটির যাত্রা শুরু হয় ২০১২ সালে। এটি দীর্ঘদিন ধরে চলা সাইটেশন এক্সেরই আধুনিক সংস্করণ। এর কেবিন অপেক্ষাকৃত বড়। গতিও বেশি। ঘণ্টায় ১ হাজার ১৫৪ দশমিক ৫৩৮ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে এটি। সেসনার তৈরি এ উড়োজাহাজ অত্যন্ত জনপ্রিয়। সাইটেশন এক্স প্লাস ৬ হাজার ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে পারে, যা তালিকার অন্য উড়োজাহাজগুলোর কয়েকটির সক্ষমতার তুলনায় কম। দ্রুতগতির এ মডেলের ২৯টি উড়োজাহাজ তৈরি হয়েছে। তবে ২০১৮ সালে এর উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
খুব সম্ভবত গালফস্ট্রিম জি৭০০ উড়োজাহাজটি উচ্চমূল্যের বেসরকারি জেটগুলোর একটি। এর মূল্য ৮ কোটি ডলার। গালফস্ট্রিম জি৭০০-এর গতি ঘণ্টায় ১ হাজার ১৪২ দশমিক ১৯ কিলোমিটার। এতে ১৯ জন যাত্রী আরামে ভ্রমণ করতে পারেন। ১৩ হাজার কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দেওয়ার সক্ষমতা আছে এটির। এই উড়োজাহাজ ১৫ হাজার মিটারের বেশি উঁচু দিয়ে উড়তে পারে। এর মানে, অন্য উড়োজাহাজের চেয়ে বেশি উঁচু দিয়ে ও বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে চলতে পারে এটি।
৭৪৭ ঘরানার উড়োজাহাজগুলোর মধ্যে এ উড়োজাহাজ সত্যিই অসাধারণ। এটি বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির বড় বাণিজ্যিক জেট বিমান। এটি প্রায় ৫০০ যাত্রী বহন করতে পারে। এর গতি ঘণ্টায় ১ হাজার ১৩৬ কিলোমিটার। ৭৪৭-৮ আই উড়োজাহাজ এতটাই আকর্ষণীয় যে বর্তমানে মার্কিন বিমানবাহিনী এ মডেলের দুটি উড়োজাহাজের আধুনিকায়ন করছে।
বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার একটি দীর্ঘপাল্লার উড়োজাহাজ। স্বাচ্ছন্দ্য ও নৈপুণ্যের দিক থেকে ইতিমধ্যে সুনাম কুড়িয়েছে এ উড়োজাহাজ। এটির সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১ হাজার ১১১ কিলোমিটার। এটিও অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি উড়োজাহাজ। বিশ্বজুড়ে এক হাজারের বেশি এমন উড়োজাহাজ সচল আছে। এর মানে, আপনি যখন কোনো দীর্ঘপাল্লার উড়োজাহাজে চড়বেন, তখন সেটি ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
দাসো ফ্যালকন সেভেন এক্স উড়োজাহাজের নির্মাতা ফরাসি প্রতিষ্ঠান দাসো। তিন ইঞ্জিনের এই বাণিজ্যিক জেটটি অত্যন্ত দ্রুতগতির। ১৬ জন যাত্রী খুব আরামে এ উড়োজাহাজে চড়তে পারেন। ফ্যালকন সেভেন এক্সের গতি ঘণ্টায় ১ হাজার ১০০ কিলোমিটারের বেশি। এ উড়োজাহাজের লেজের দিকের অংশের মাঝখানেও একটি ইঞ্জিন আছে। তিন ইঞ্জিনের উড়োজাহাজ বিরল। একমাত্র ওই ফরাসি প্রতিষ্ঠানই বর্তমানে এ ধরনের উড়োজাহাজ তৈরি করছে। এ উড়োজাহাজের প্রধান সুবিধা, এটি ডানাগুলো উঁচু করে আরও পেছনের দিকে নিতে পারে, মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র পরিবর্তন করতে পারে। সামনে দাসোর তৈরি ফ্যালকন এক্স ১০ উড়োজাহাজ আসতে যাচ্ছে। এর গতি আরও বেশি হবে।
বিশ্বের একমাত্র দ্বিতল উড়োজাহাজ এটি। এয়ারবাসের তৈরি করা এ উড়োজাহাজে ৮০০ জনের বেশি যাত্রী আরামে ভ্রমণ করতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে এযাবৎকালে তৈরি হওয়া সবচেয়ে বড় যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ এটি। এ৩৮০ উড়োজাহাজ ৩২টি দ্বিতল বাসের সমান চওড়া। অবিশ্বাস্য রকমের বড় হওয়ার পরও এ উড়োজাহাজ ঘণ্টায় ১ হাজার ৯৮ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে। ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্বজুড়ে ৩০ কোটির বেশি যাত্রী এ মডেলের উড়োজাহাজে চলাচল করেছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে এ উড়োজাহাজের উৎপাদন বন্ধ আছে। তবে উড়োজাহাজটি যে গতিতে চলে ও যাত্রীদের আরাম দেয়, তাতে সচল থাকা উড়োজাহাজগুলো আরও অনেক বছর টিকে থাকবে বলে আশা করাই যায়।
বোয়িং কোম্পানির তৈরি করা আরেকটি জনপ্রিয় ও দীর্ঘদিন ধরে টিকে থাকা উড়োজাহাজ বোয়িং ৭৭৭। এর গতি ঘণ্টায় ১ হাজার ৯৮ কিলোমিটার।
বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজ ৫০০-এর বেশি যাত্রী বহনে সক্ষম। এক ডেকের উড়োজাহাজটির ইঞ্জিনের সংখ্যা ২। প্রায় ৩০ বছর ধরে বিশ্বে এ উড়োজাহাজ টিকে আছে। এখনো এ উড়োজাহাজের চাহিদা আছে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে এখনো এ ধরনের উড়োজাহাজ তৈরি করে দিতে বলা হচ্ছে। আর সেদিক বিবেচনায় বলা যায়, অন্তত আরও কয়েক বছর আকাশে এ মডেলের উড়োজাহাজকে উড়তে দেখা যাবে।
দ্রুতগতির এ উড়োজাহাজও বোয়িংয়ের তৈরি। ৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে ৭৪৭-৪০০ উড়োজাহাজ সেবা দিচ্ছে। এটি বোয়িং ৭৪৭-এরই একটি ধরন। এয়ারলাইনস কোম্পানিগুলোর কাছে দীর্ঘপাল্লা ও উচ্চগতির এ উড়োজাহাজের বেশ জনপ্রিয়তা আছে। তবে দুঃখজনক বিষয়, আকর্ষণীয় গতি থাকলেও উড়োজাহাজটির নকশা ও কার্যক্ষমতা পুরোনো ধাঁচের। কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালে বিশ্বজুড়ে উড়োজাহাজে যাত্রী চলাচল কমে যাওয়ার বিষয়টিও এ উড়োজাহাজের পতন ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে আংশিক দায়ী। ২০০৭ সালে ৭৪৭-৪০০ উড়োজাহাজের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে এ মডেলের একটি উড়োজাহাজই বাণিজ্যিকভাবে সচল আছে।