রাষ্ট্রহীন সিরীয় আল–কোনতার পেলেন কানাডার নাগরিকত্ব
দীর্ঘ অপেক্ষার পর সিরিয়ার শরণার্থী হাসান আল–কোনতার অবশেষে কানাডার নাগরিকত্ব পেয়েছেন। সাত মাস ধরে মালয়েশিয়া বিমানবন্দরে আটকা পড়াসহ বছরের পর বছর ধরে কোনো দেশে থিতু হতে মরিয়া আল–কোনতারের জন্য বুধবার ছিল একটি মাইলফলক।
নাগরিকত্বের শপথ নেওয়ার আগে তিনি কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল–জাজিরাকে বলেন, ‘এত বছর পর এটি আমার কাছে বিজয়ের মতো। আজ থেকে আমি আর রাষ্ট্রহীন নই।’ আর বিবিসিকে বলেন, ‘আমি আরও বেশি কানাডিয়ান। তবে প্রথম দিন থেকেই আমি নিজেকে কানাডিয়ান মনে করছি। এটি যেমন আনন্দের, তেমনি এর পেছনে অনেক বিষাদও রয়েছে। এর জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছে।’
কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার হুইসলার শহরে সাময়িক ঠাঁই পাওয়া আল-কোনতারকে থিতু হওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল।
২০১৭ সালে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ২০১১ সালের আগে থেকে কাজ করছিলেন। কিন্তু তাঁর ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় তাঁকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। সিরিয়ায়ও ফিরতে অক্ষম ছিলেন। কারণ, তাঁর ভয় ছিল সেখানে গেলে তাঁকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করা হবে বা গৃহযুদ্ধের কারণে বন্দী করা হবে। তাই তিনি মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন যেখানে সিরিয়ানদের ভিসা ছাড়াই ৯০ দিন থাকার অনুমতি দেয়। যখন সেই মেয়াদও শেষ হয়, তখন তিনি ইকুয়েডর এরপর কম্বোডিয়াতে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারেননি।
কম্বোডিয়ার কর্মকর্তারা তাঁর পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে এবং তাঁকে রাষ্ট্রহীন অবস্থায় মালয়েশিয়ায় ফেরত পাঠায়।
কোনো দেশই তাঁকে গ্রহণ করেনি। একপর্যায়ে আল-কোনতার মালয়েশিয়া বিমানবন্দর থেকে অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টায় হাল ছেড়ে দিয়ে সেখানে থাকতে শুরু করেন।
সাত মাসের বেশি সময় ধরে কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ছিলেন কোনতার। তিনি ভিডিও ডায়েরি টুইট করতে শুরু করেন, যা লাখো বাস্তুচ্যুত সিরীয় উদ্বাস্তু সংকটের সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত দুর্দশাকে সংযুক্ত করতে সহায়তা করে। ২০১১ সালের পর থেকে প্রায় ৬৮ লাখ মানুষ সিরিয়া ছেড়ে গেছেন। এই ভিডিওর কারণে তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি পান। তাঁর এই দুর্দশার গল্প তিনজন কানাডীয় নাগরিকের নজর কাড়ে। তাঁরা তাঁকে সহায়তার উদ্যোগ নেন।
কোনো শরণার্থীকে ব্যক্তি সংগঠন বা ব্যক্তিগতভাবে কেউ পৃষ্ঠপোষকতা করতে চাইলে কানাডা সরকার সেই অনুমতি দেয়। তহবিল গঠনের মধ্য দিয়ে ওই শরণার্থীদের কানাডায় থাকার প্রথম বছরের খরচ চালানো হয় ও সামাজিক সমর্থন দেওয়া হয়।
কানাডার ওই তিন নাগরিক কানাডা সরকার ও মালয়েশিয়ান কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর দ্য বিসি মুসলিম অ্যাসোসিয়েশন আল-কোনতারকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে রাজি হয়। ইতিমধ্যে তিনি মালয়েশিয়ার শরণার্থী বন্দিশিবিরে দুই মাস কাটিয়েছেন। তাঁর দাবি, তাঁকে সেখানে এক শ বারের বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
গত বছর কানাডা থেকে আল–কোনতারের সহায়তায় তাঁর পরিবার সিরিয়া থেকে মিসরে যেতে পেরেছে। তিনি বলেন, সিরিয়ায় ওষুধ নেই, খাবার নেই।
১৫ বছর পরিবার থেকে দূরে থাকা আল-কোনতার ২০১৬ সালে বাবার মৃত্যুর সময় পাশে থাকতে পারেননি। এমন নানা দুঃখ–সুখের ভাগীদার তিনি হতে পারেননি।
বুধবার আল-কোনতার বলেন, ‘এর মূল্য আমাকে বাবাকে হারিয়ে দিতে হয়েছে। আমি আমার বাবাকে শেষ দেখা দেখতে পাশে থাকতে পারিনি। অথচ তখন আমাকে তাঁর বেশি প্রয়োজন ছিল।’
এর আগে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, যখন প্রথম কানাডার মাটিতে নেমেছিলেন, তখনই তাঁর মনে হয়েছে এটাই তাঁর বাড়ি। তিনি বলেন, ‘ভ্যাঙ্কুভার বিমানবন্দরে যে–ই পা রাখলাম, তখনই আমি পরিবর্তনটা টের পেয়েছিলাম।’
সেখানে যাওয়ার পর তিনি সারা বিশ্বে উদ্বাস্তুদের দুর্দশা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর কঠিন সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে বই লিখেছেন। একই সঙ্গে কানাডিয়ান রেড ক্রসের সঙ্গে কাজ শুরু করে। কোভিডের সময় তিনি প্রদেশের মোবাইল টিকাকরণ প্রচেষ্টায় যুক্ত ছিলেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, নিজের উন্নয়নে তিনি কঠোর পরিশ্রম করছেন। অনলাইনে অনেকগুলো কোর্স করেছেন।
চার বছর তিনি রাষ্ট্রহীন অবস্থায় ছিলেন। যার কারণে তিনি কোথাও ভ্রমণ করতে পারেননি। এখন তিনি কানাডার পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে পারবেন। পাসপোর্ট পেয়ে তিনি অন্য দেশে গিয়ে সেখানে থাকা বাস্তুচ্যুত শরণার্থীদের সহায়তা করতে পারবেন বলে আশা করছেন।