ইরানে পালাবদল: পারমাণবিক আলোচনার ভবিষ্যৎ কী

২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় বিশ্বশক্তির সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি করে ইরান। চুক্তি মেনে দেশটি পারমাণবিক কার্যক্রম থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয়। বিনিময়ে তেহরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা ধাপে ধাপে প্রত্যাহারের কথা জানায় পশ্চিমা দেশগুলো। ২০১৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একতরফাভাবে চুক্তি থেকে বেরিয়ে গিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করে

ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ইরানে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। শুক্রবারের নির্বাচনে প্রায় ৬২ শতাংশ ভোট পেয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট পদে বিজয়ী হন রক্ষণশীল নেতা ইব্রাহিম রাইসি। শনিবার ইরানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির উত্তরসূরি হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা করা হয়েছে।

তুলনামূলক উদারপন্থী রুহানি পরপর দুই মেয়াদে ইরানের প্রেসিডেন্ট পদে রয়েছেন। সংবিধান অনুযায়ী দেশটিতে দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন না। তাই এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি তিনি।

আগস্টে রুহানির কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা নেবেন রাইসি। তার আগেই পারমাণবিক চুক্তিতে ফেরা ও তেহরানের ওপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে ছয় বিশ্বশক্তির সঙ্গে ইরানের চলমান আলোচনার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে রক্ষণশীল রাইসির ভূমিকা, পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে রক্ষণশীল এই নেতার গ্রহণযোগ্যতা কেমন হবে, তা নিয়ে চলছে জল্পনা।

২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় বিশ্বশক্তির সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি করে ইরান। চুক্তি মেনে দেশটি পারমাণবিক কার্যক্রম থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয়। বিনিময়ে তেহরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা ধাপে ধাপে প্রত্যাহারের কথা জানায় পশ্চিমা দেশগুলো। এই চুক্তিকে ইরানের জন্য অন্যতম কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে দেখা হয়েছিল। যার অন্যতম রূপকার ছিলেন হাসান রুহানি। তিনি চাপের মুখে থাকা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের স্বার্থে পারমাণবিক কর্মসূচির চেয়ে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। সুফলও মিলতে শুরু করেছিল।

আরও পড়ুন

তবে পরিস্থিতি বদলে যায় ২০১৮ সালে। তখন ওয়াশিংটনে ক্ষমতায় ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী উল্লেখ করে তিনি এ চুক্তি থেকে নিজ দেশের নাম প্রত্যাহার করে নেন। ইরানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। যা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ঘিরে যাবতীয় কূটনৈতিক অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তেহরানও পারমাণবিক কর্মসূচিতে ফিরে যায়। ওই সময় ট্রাম্প চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলে অন্যান্য অতি কট্টরপন্থীর মতো রাইসিও রুহানি সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।

পারমাণবিক আলোচনা থেকে ইরান একটি ভালো চুক্তি চায়, যেটি দেশের স্বার্থ রক্ষা করবে।
আব্বাস আরঘচি, ইরানের জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক ও দেশটির উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী

ক্ষমতার পালাবদলে চলতি বছরের শুরুতে বিদায় নিয়েছেন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের এখনকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ট্রাম্পের ওই সিদ্ধান্ত বাতিল করেছেন। যার জেরে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে ইরান চাইছে আগে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে। এরপর তেহরান পুরোনো চুক্তিতে ফিরবে। রুহানির প্রশাসনের হাত ধরে এটা নিয়ে চলছে দর–কষাকষি।

আরও পড়ুন

২০১৫ সালের চুক্তিতে রুহানি ছিলেন অন্যতম স্থপতি। তেমনি এখনকার আলোচনা শুরুর ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। তিনি উপলব্ধি করেছেন, চাপের মুখে থাকা ইরানের অর্থনীতি রক্ষায় যেকোনো মূল্যে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা জরুরি। তা না হলে ধুঁকতে থাকা দেশটির রপ্তানিমুখী জ্বালানি খাত পুরোপুরি ধসে পড়তে পারে।

পারমাণবিক চুক্তিকে ইরানের জন্য অন্যতম কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে দেখা হয়েছিল। যার অন্যতম রূপকার ছিলেন হাসান রুহানি। তিনি চাপের মুখে থাকা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের স্বার্থে পারমাণবিক কর্মসূচির চেয়ে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। সুফলও মিলতে শুরু করেছিল।

এখন উদারপন্থী নেতা রুহানি বিদায় নিচ্ছেন। তেহরানের ক্ষমতার কেন্দ্রে আসছেন রক্ষণশীল রাইসি। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচনী প্রচারের সময় টেলিভিশন বিতর্কে অংশ নিয়ে রাইসি বলেছিলেন, তিনি পারমাণবিক চুক্তিতে ফেরার উদ্যোগকে সম্মান করবেন। মূলত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে মুক্তির জন্য ওই পারমাণবিক চুক্তি পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টার সমর্থন করছেন রাইসি। তবে তিনি এটাও বলেছিলেন, ‘সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমি একটি শক্তিশালী সরকার গঠন করব।’

আরও পড়ুন

এর মধ্য দিয়ে রাইসি উদারপন্থী রুহানি সরকারের সমালোচনা করেছিলেন, যা পারমাণবিক চুক্তির বিষয়ে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে কিছুটা অনিশ্চয়তার জন্ম দিয়েছিল।
ইরানের পররাষ্ট্র ও পারমাণবিক নীতি নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। দেশটিতে ৮২ বছরের খামেনির উত্তরসূরি হিসেবে দেখা হয় রাইসিকে। ২০১৯ সালে ইরানের বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে রাইসিকে নিয়োগ দিয়েছিলেন খামেনি। পারমাণবিক চুক্তির বিষয়ে চলমান আলোচনার বিষয়ে আয়াতুল্লাহ খামেনি বলেছেন, চুক্তির শর্ত পূরণে যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তরিক হতে হবে, এরপরই তেহরান চুক্তিতে ফিরবে।

ছয় বিশ্বশক্তির সঙ্গে করা চুক্তি মেনে ২০১৫ সালেই পারমাণবিক কার্যক্রম থেকে সরে আসতে রাজি হয়েছিল ইরান।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

অর্থাৎ এ বিষয়ে তেহরানের অবস্থান স্পষ্ট, আগে সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হোক। এরপর চুক্তিতে ফেরা যাবে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র এ চুক্তি ছেড়ে আবারও বেরিয়ে যাবে না, এমন নিশ্চয়তা চায় তেহরান। চলমান পারমাণবিক আলোচনায় ইরানের জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক ও দেশটির উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরঘচি গত সপ্তাহে বলেছেন, ‘আলোচনা থেকে ইরান একটি ভালো চুক্তি চায়, যেটি দেশের স্বার্থ রক্ষা করবে।’ রুহানি পরবর্তী জমানায় রাইসির হাত ধরে এ অবস্থানে অটল থেকে কূটনৈতিক দর–কষাকষি চালিয়ে যেতে পারে ইরান।

আরও পড়ুন

তবে যা কিছুই ঘটুক না কেন, ইরানের পক্ষ থেকে চলমান আলোচনা বর্জনের সুযোগ কার্যত নেই বলে মনে করছেন যুক্তরাজ্যভিত্তিক থিংকট্যাংক চাথাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাবিষয়ক প্রকল্পের উপপরিচালক ও জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো সানাম ভাকিল। আল–জাজিরাকে তিনি বলেন, ইরান চাইছে যেকোনো মূল্যে চলমান নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে। তাই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে প্রত্যাখ্যান করা না হলে চলমান ভিয়েনা আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ কম।

ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট রাইসির বিরুদ্ধে ওয়াশিংটন ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে আগে থেকেই মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তাদের ভাষ্য, ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব হওয়ার আগে যাঁরা সশস্ত্র বিরোধিতা করেছিলেন, পরে তাঁদের ওপর চরম নির্যাতন চালানো হয়েছিল।

রাজবন্দী করা হয়েছিল অনেককে। আশির দশকে ইরানে বিচারবহির্ভূতভাবে হাজারো রাজবন্দীকে হত্যার পেছনে রাইসির ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও রাইসি এ অভিযোগ নিয়ে কখনোই মুখ খোলেননি।

শনিবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরপরই মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল রাইসির বিরুদ্ধে পুরোনো এ অভিযোগ নতুন করে সামনে এনেছে। এক বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি রাইসির বিরুদ্ধে ওঠা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছে। আগামী দিনগুলোয় পশ্চিমাদের কাছে রাইসির এমন নেতিবাচক ভাবমূর্তি চলমান পারমাণবিক আলোচনা এগিয়ে নিতে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।