সদর দরজায় নড়ছে ভয়ের কড়া

পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরে প্রায় ৩০ লাখ ফিলিস্তিনি বাস করে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে এই এলাকা দখল করে নেয় ইসরায়েল
ছবি: রয়টার্স

মুহাম্মদ সানদোকা তাঁর দ্বিতীয় ছেলের জন্মের আগে আল-আকসা মসজিদের কাছে ঘর তৈরি করেছিলেন। তাঁর ছেলের বয়স এখন ১৫।

ঘরটি ভেঙে ফেললে তা পর্যটকদের কাছে ওল্ড সিটির সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তে নিজেদের গড়ে তোলা ঘর ভেঙে ফেলতে বাধ্য হয় সানদোকার পরিবার।

৪২ বছর বয়সী সানদোকা বাসাবাড়িতে কিচেন ক্যাবিনেট লাগানোর কাজ করেন। তাঁর বাড়িতে যখন একজন ইসরায়েলি পরিদর্শক এসেছিলেন, তখন তিনি কাজে ছিলেন। বাড়িতে ছিলেন তাঁর স্ত্রী। তাঁর স্ত্রীকে ইসরায়েলি পরিদর্শক দুটি বিকল্প দিয়েছিলেন। হয় নিজেরাই ঘরটি ভেঙে ফেলুক, নইলে ইসরায়েলের সরকার তা ভাঙবে। আর সরকার ঘর ভাঙলে তার জন্য সানদোকার কাছ থেকে ১০ হাজার ডলার খরচ আদায় করা হবে।

ইসরায়েলি দখলদারির অধীনে ফিলিস্তিনিদের জীবন কেমন, সানদোকার ঘটনা তার একটা উদাহরণ মাত্র। এই ঘটনা তুলে ধরে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস আজ রোববার একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ইসরায়েলি দখলদারির অধীনে ফিলিস্তিনিদের জীবন হলো সদর দরজায় সব সময় নড়ছে ভয়ের কড়া।

ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে সবশেষ সংঘাতের সূত্রপাতের ক্ষেত্রে পূর্ব জেরুজালেম থেকে কয়েকটি ফিলিস্তিন পরিবারকে উৎখাতের বিষয়টি ক্ষোভ সঞ্চারে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১১ দিনের সংঘাত শেষে গত শুক্রবার প্রথম প্রহরে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।

পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরে প্রায় ৩০ লাখ ফিলিস্তিনি বাস করে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে এই এলাকা দখল করে নেয় ইসরায়েল। এই এলাকা তারাই নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।

ইসরায়েলের দখল করা ভূখণ্ডে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিরা ভয়ভীতি, অপমান, অমর্যাদা, অবজ্ঞা, লাঞ্ছনা, হয়রানির মধ্যে বসবাস করে আসছেন। হতাশা, আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ, ভঙ্গুর অবস্থা, সেনাদের অধীনে জীবনের নির্মমতা—এমন সব রূঢ় অভিজ্ঞতা ফিলিস্তিনিদের রয়েছে।

ইসরায়েল-হামাসের মধ্যে সংঘাতের পেছনে উচ্ছেদ-দখলদারির বিষয়কে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করতে দেখা গেছে। নতুন করে উচ্ছেদ-দখলদারির প্রেক্ষাপটেই হামাসকে ইসরায়েল লক্ষ্য করে রকেট ছোড়া বা হামলা চালানোর ‘যৌক্তিকতা’ এনে দেয়। দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত শেষ হলেও উসকানি থামে না।

ইসরায়েলের দখল করা অংশে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ এলে তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কারণ, তাদের কাছে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ সব সময় স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে আসে না।

এই যেমন বদর আবু আলিয়ার অভিজ্ঞতার কথাই শোনা যাক। তাঁর বয়স ৫০। পশ্চিম তীরের একটি গ্রামে তাঁর ঘর। একদিন দিবাগত রাত দুইটার দিকে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। তাঁর পাশের ঘরে ইসরায়েলি সেনারা হানা দেয়। তারা ঘরের দরজা ভাঙতে থাকে। এই শব্দে ঘুম ভাঙে আবু আলিয়ার।

দরজায় গেলে সবাইকে ঘরের বাইরে বের করে জড়ো করে ইসরায়েলি সেনারা। সেনারা সবার কাছ থেকে পরিচয়পত্র নেয়। পরে তারা ঘরে ঢুকে তছনছ করে। সেনারা এসব কেন করছে, তার কোনো ব্যাখ্যা পর্যন্ত দেয়নি। প্রায় দুই ঘণ্টা পর সেনারা চলে যায়। যাওয়ার সময় তারা পাশের বাড়ি থেকে এক কিশোরকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। ওই কিশোর কয়েক দিন আগে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিল।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ভাষ্য, তারা রাতে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘরে অভিযান চালায়। কারণ, সেটা নিরাপদ। আর অস্ত্রের খোঁজেই বাড়িঘরে ঢুকে তছনছ করা হয়। নিয়মিত এমন অভিযান চালানোর উদ্দেশ্য হলো—সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করা।

তবে দখল করা ভূখণ্ডে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযান পাল্টা হামলা বা প্রতিশোধকে উৎসাহিত করে বলে জানায় নিউইয়র্ক টাইমস।

আবু আলিয়া বলেন, এগুলো প্রতিশোধ নিতে উৎসাহিত করে। ভুক্তভোগীদের আত্মরক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু নিজেদের আত্মরক্ষা করার মতো কোনো কিছু তাঁদের হাতে নেই।