নেতানিয়াহু সরকারের উগ্রপন্থী চেহারা ফুটে উঠছে

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুফাইল ছবি: রয়টার্স

দায়িত্ব গ্রহণের তিন সপ্তাহের মধ্যেরই রূপ দেখাতে শুরু করেছে ইসরায়েলের নতুন দায়িত্ব গ্রহণের তিন সপ্তাহের মধ্যেই রূপ দেখাতে শুরু করেছে ইসরায়েলের নতুন সরকার। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন কট্টর ডানপন্থী এই জোট সরকার তাদের নীতি জনগণের ওপর চাপাতে শুরু করেছে। তবে জনগণও বসে নেই। শুরু হয়েছে বিক্ষোভ।

প্রস্তাবিত এসব পরিবর্তন ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। পাশাপাশি ইসরায়েল ও অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে থাকা ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলের নীতিতেও গুরুতর প্রভাব ফেলবে।

নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টি ও তাদের মিত্র অতি-ডানপন্থী জোট গত ১ নভেম্বর সংসদীয় নির্বাচনে সর্বাধিক আসন জয় পায়। এর মধ্য দিয়ে তারা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী সরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, যাকে ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে ডানপন্থী বলা হয়।

চলতি মাসের শুরুর দিকে ইসরায়েলের বিতর্কিত উগ্র–ডানপন্থী জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির আল–আকসা মসজিদ চত্বর পরিদর্শন করেন। এ নিয়ে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। এর ফলে অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমের পবিত্র স্থানটিতে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছিল। যদিও সেই আশঙ্কা কেটে গেছে।

এরই মধ্যে নতুন সরকারের আলোচ্যসূচির শীর্ষে থাকা বেশ কিছু বিষয় নিয়ে ইসরায়েলিদের মধ্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তারা বিচারকি ব্যবস্থার পরিবর্তন ও সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতাকে দুর্বল করতে চায়। পাশাপাশি অধিকৃত পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের মধ্যে একীভূত করারও প্রস্তাব দিয়েছে, যেখানে পরিস্থিতি এমনিতেই উত্তেজনাপূর্ণ।

যেসব ফিলিস্তিনির হামলায় ইহুদি নিহত হয়, তাদের বিরুদ্ধে ‘ কঠিনতম কৌশল’ প্রয়োগ করতে হবে
লিকুদ পার্টির রাজনীতিবিদ হ্যানোচ মিলউইডস্কি

বিচারব্যবস্থায় পরিবর্তনের পরিকল্পনা

লিকুদ পার্টির সদস্য ইয়ারিভ লেভিন বিচারবিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার এক সপ্তাহ পর বিচারব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ পেতে ও সুপ্রিম কোর্টকে দুর্বল করতে একটি বিতর্কিত প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।

গত সপ্তাহে প্রস্তাবটি খসড়া আকারে প্রকাশ পায়। সেখানে আইন বাতিল করতে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতাকে সীমিত করা এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে সরকারকে বড় ধরনের ভূমিকা রাখার সুযোগের কথা বলা হয়েছে।

আরও পড়ুন
ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে এক স্বাধীনতাকামী
এএফপি

প্রস্তাবিত আইনে আরও বলা হয়, স্বাধীন পেশাদার কৌঁসুলি ব্যবহারের পরিবর্তে মন্ত্রীরা নিজেরা নিজেদের আইনি উপদেষ্টা নিয়োগ দিতে পারবেন।

সমালোচকেরা এই প্রস্তাবের নিন্দা জানিয়েছে  এটিকে ‘শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন’ এবং ‘রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’ বলে মন্তব্য করেছেন। গত সপ্তাহে তেল আবিবে ১০ হাজারের বেশি ইসরায়েলি এই প্রস্তাবিত আইনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন।

বিরোধীরা বলছেন, এই পরিকল্পনা ইসরায়েলের ক্ষমতার ভারসাম্যকে গুরুতর ঝুঁকির মুখে ফেলবে এবং সরকারকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দিয়ে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে খাটো করবে।

এ ধরনের আইন হলে বিচারব্যবস্থার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরও বাড়বে। যেমন নেতানিয়াহু নিজেই তাঁর বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির মামলায় আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। দুর্নীতির মামলায় ২০১০ সাল থেকে তাঁর বিচার চলছে।

উন্মুক্ত স্থানে ফিলিস্তিনের পতাকা নিষিদ্ধ

৯ জানুয়ারি দেশটির নতুন নিরাপত্তামন্ত্রী বেন-গভির অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেম এবং ইসরায়েলের অভ্যন্তরে সব ফিলিস্তিনি পতাকা সরিয়ে নিতে পুলিশকে নির্দেশ দেন। তিনি ফিলিস্তিনি জাতীয় প্রতীকটিকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ বলে অভিহিত করেন।

ইসরায়েলের দেওয়ানি আইন ফিলিস্তিনি পতাকাকে বেআইনি হিসেবে না দেখলেও ‘জনস্বার্থের প্রতি হুমকি বিবেচনায়’ পুলিশ ও সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনি পতাকা বাজেয়াপ্ত করার অধিকার রাখে। নতুন আইন হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

ইতিমধ্যে জেরুজালেম থেকে ফিলিস্তিনি পতাকা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কারণ, ইসরায়েলের কথা হলো তারা পূর্ব ও পশ্চিম অংশ দখল করেছে।

আরও পড়ুন

বেন–গভিরের এই পদক্ষেপ ইসরায়েলে ফিলিস্তিনিদের আত্মপরিচয়, বিক্ষোভ এবং বাক্‌স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ বাড়ানোর বার্তা দিচ্ছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক অধিকারবিষয়ক সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইসরায়েলের এই নিষেধাজ্ঞাকে ‘ফিলিস্তিনিদের চুপ করিয়ে দেওয়ার সর্বশেষ চেষ্টা’ বলে উল্লেখ করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করতে দিন দিন যে নির্মম হয়ে উঠছে, প্রহসনমূলক এসব অজুহাত দাঁড় করিয়ে তা আড়াল করা যাবে না।

অধিকৃত পশ্চিম তীরকে যুক্ত করার অঙ্গীকার

পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড জবরদখল করে গড়ে তোলা ইসরায়েলের অবৈধ বসতি
ফাইল ছবি। রয়টার্স

সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগে যেসব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে নেতানিয়াহু তাঁর অন্যতম রাজনৈতিক জোট রিলিজিয়াস জায়ানিজম পার্টির কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, অধিকৃত পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। চুক্তিতে বলা হয়, ইসরায়েলের মাটিতে প্রকৃতিগতভাবে ইহুদিদের অধিকার আছে।  

শপথ গ্রহণের আগের দিন ২৮ ডিসেম্বর নেতৃত্বাধীন সম্ভাব্য সরকার ঘোষণা দিয়েছিল, তাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হবে ‘পুরো ইসরায়েল ভূখণ্ডে বসতি স্থাপনের অগ্রগতি ও উন্নয়ন’, যার মধ্যে রয়েছে গালিলি, নাকাব মরুভূমি (নেগেভ), অধিকৃত সিরিয়ার গোলান মালভূমি ও পশ্চিম তীর। মূলত এর আড়ালে তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হতে না দেওয়া।

ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই ফিলিস্তিনি নির্মাণের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা শুরু করেছে। এরই মধ্যে তারা পুরোপুরি ইসরায়েলি সামরিক–বেসামরিক নিয়ন্ত্রণে অধিকৃত পশ্চিম তীরের এলাকা সি-এর ৬০ শতাংশ বাড়িঘর ধ্বংসের কাজ এগিয়ে নিয়েছে।

আনুষ্ঠানিকভাবে অধিকৃত পশ্চিম তীরকে সংযুক্ত করা হলে তা হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়-সমর্থিত ‘দুই-রাষ্ট্র সমাধান’–এর কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার অবস্থা।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে বাধা হচ্ছে বিধিনিষেধের জালে

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার চেষ্টার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলি কর্মকর্তারা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে একাধিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতে এখন অধিকৃত পশ্চিম তীরের কিছু এলাকার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।

জানুয়ারির শুরুতে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস সরকারের তিনজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ফাতাহ ক্ষমতাসীন দলের ডেপুটি চেয়ারম্যান মাহমুদ আল-আলুল, সেই সঙ্গে আজাম আল-আহমাদ এবং রাহি ফাতুহর ইসরায়েলে প্রবেশের অনুমতি বাতিল করেছে দেশটি। সম্প্রতি ইসরায়েল ফিলিস্তিনি এক বন্দীকে মুক্তি দেয়। তাঁর বাড়ি ইসরায়েলি ভূখণ্ডে। তাঁকে দেখতে ওই তিনজন ইসরায়েল যেতে চাইছিলেন।
ফিলিস্তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিয়াদ মালিকির ভ্রমণের অনুমতিও স্থগিত করেছে ইসরায়েল।

৪ জানুয়ারি কট্টর-ডানপন্থী ইসরায়েলি অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের রাজস্ব আয় থেকে ৪ কোটি ডলার কেটে নিয়েছে।

‘আমি আরব খুনিদের চেয়ে ইহুদি খুনিদের পছন্দ করি’

আমি আরব খুনিদের চেয়ে ইহুদি খুনিদের পছন্দ করি—নেতানিয়াহুর পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের একজন সদস্যের করা এই মন্তব্য ইসরায়েলের ইহুদি এবং ফিলিস্তিনি নাগরিকদের জন্য আলাদা নীতি থাকার বিষয়টি প্রমাণ করে।

নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টির রাজনীতিবিদ হ্যানোচ মিলউইডস্কি বলেন, যেসব ফিলিস্তিনির হামলায় ইহুদি নিহত হয়, তাদের বিরুদ্ধে ‘ কঠিনতম কৌশল’ প্রয়োগ করতে হবে। এই কৌশলের মধ্যে রয়েছে মৃত্যুদণ্ডসহ তাদের ইসরায়েলি নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া এবং তাদের নির্বাসিত করা এবং সন্দেহভাজনদের পরিবারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া।

মিলউইডস্কির এই বক্তব্য নিয়ে তাঁর সঙ্গে ইসরায়েলের পার্লামেন্টের একজন ফিলিস্তিনি সদস্য আহমদ তিবির উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। আহমদ তিবি বলেন, মিলউইডস্কির অন্যায়ভাবে ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্য করে এই প্রস্তাব দিয়েছেন।

তিবি মিলউইডস্কির কাছে জানতে চেয়েছিলেন,  ইসরায়েল কি ইগাল আমিরের নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করবে, যিনি ১৯৯৫ সালে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইতজাক রবিনকে হত্যা করেছিলেন বা অ্যামি পপার, যিনি ১৯৯০ সালে সাত ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছিলেন।

মিলউইডস্কি জবাবে বলেন, ‘আমি ইহুদি রাষ্ট্রে ইহুদিদের পছন্দ করি, এ নিয়ে নিজেকে ন্যায্য প্রমাণ করার কোনো প্রয়োজন বোধ করি না। হ্যাঁ, আহমদ তিবি, আমি আরব খুনিদের চেয়ে ইহুদি খুনিদের পছন্দ করি।’

তখন সরকারের তৃতীয় বৃহত্তম ব্লক চরম–ডানপন্থী রিলিজিয়াস জায়নবাদ জোটের সদস্যরা মিলউইডস্কিকে সমর্থন করেন।

জিউশ পাওয়ার পার্টির লিমর সন হার–মেলেচ ইসারায়েলি গণমাধ্যমকে বলেন, যদি কোনো ইহুদি একজন আরবকে হত্যা করেন, তার অবশ্যই যাবজ্জীবন হওয়া উচিত। তবে একজন আরব যদি কোনো ইহুদিকে হত্যা করেন, তাঁর মৃত্যুই শ্রেয়।’