মধ্যপ্রাচ্যে যেভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠছে চীন

বেইজিংয়ে বৈঠক শেষে সৌদি আরবের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মুসাদ বিন মোহাম্মদ আল আইবান এবং ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান আলী শামখানি। তাঁদের সঙ্গে চীনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমানে দেশটির সেন্ট্রাল ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিশনের পরিচালক ওয়াং ই
ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে প্রায়ই ‘নতুন বিশ্বব্যবস্থা’র কথা বলতে দেখা যায়। মনে হতে পারে, এই যুদ্ধে ইউক্রেনের হয়ে পশ্চিমারা যেভাবে লড়ছে, তাতে ক্ষুব্ধ পুতিন বুঝি ফাঁকা বুলি আওড়াচ্ছেন। কিন্তু গত মার্চে যখন পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর একই কথা বললেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং, তখন বিষয়টি দ্বিতীয়বার ভেবে দেখার দাবি রাখে। সাধারণত, চীনের নেতৃত্ব কথা বলার চেয়ে কাজ বেশি করে থাকেন। কিন্তু যখন তাঁরা কোনো বিষয়ে কথা বলতে শুরু করেন, তখন বুঝে নিতে হবে, ওই কাজ তাঁরা অনেক দূর এগিয়ে এনেছেন।

নতুন ব্যবস্থার দিকে যে বৈশ্বিক রাজনীতি গড়াচ্ছে, তার ইঙ্গিত মেলে মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক সম্পর্কের পালাবদলে। এ অঞ্চল নিয়ে চীন অনেক দূর এগিয়েছে। আর সেটা প্রকাশ পেয়েছে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তির মধ্য দিয়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা বিস্মিত কূটনৈতিক বোদ্ধারা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে কার্যত মধ্যপ্রাচ্যে নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হতে যাচ্ছে।

এক টেবিলে দুই চিরবৈরী

গত ৬ মার্চ চীনের মধ্যস্থতায় আয়োজিত সংলাপে অংশ নেন সৌদি আরব ও ইরানের প্রতিনিধিরা। চার দিন পর রিয়াদ ও তেহরান ঘোষণা দেয়, দুই দেশ সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খুলছে দুই দেশের বন্ধ থাকা দূতাবাসও। ২৪ মে ইরান জানিয়েছে, দীর্ঘ সাত বছর পর সৌদি আরবে রাষ্ট্রদূত হিসেবে আলী রেজা এনায়েতিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এই ঐতিহাসিক চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে বৃহৎ বৈশ্বিক শক্তিগুলোর ভূমিকায় পরিবর্তন আনতে পারে। এর মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে চীনের নেতৃত্বদানের যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সে পথ সুগম হলো। সৌদি আরব ও ইরানকে সমঝোতায় আনতে পারাটা ওয়াশিংটনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এ অঞ্চলে অনেকটাই এগিয়ে গেল বেইজিং।

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান
ছবি: রয়টার্স

কেন পূর্বমুখী মধ্যপ্রাচ্য

রিয়াদ ও তেহরান উভয়ে মনে করে, আঞ্চলিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে চীনের মাধ্যমে এগোলে তারা লাভবান হবে। দুই দেশের জন্য বেইজিংয়ের সঙ্গে কাজ করাটা একধরনের নতুন অগ্রগতিও বলা চলে।

২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে জোর দেয় ইরান। এরই ধারাবাহিকতায় বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি সই করে তেহরান। কিন্তু ২০১৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে একতরফা যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। অন্যদিকে সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। এ অবস্থায় প্রতিবেশী দেশ ও আঞ্চলিক বাণিজ্যিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে জোর দেয় ইরান।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক কয়েক বছর ধরে তলানিতে ঠেকেছে। ২০০৩ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের পর থেকে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি শুরু হয় রিয়াদের। কারণ, এই আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে সৌদি আরবের মিত্র সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। ইরানের সঙ্গে বিশ্বশক্তিগুলোর পারমাণবিক চুক্তিও ইতিবাচকভাবে নেয়নি সৌদি আরব। ইরান, সিরিয়া ও ইয়েমেনে রিয়াদের স্বার্থ রক্ষায় তেমন আগ্রহ দেখায়নি ওয়াশিংটন। ২০১৮ সালে সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যাকাণ্ড ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও খারাপ হয় সৌদি আরবের।

এ ছাড়া সৌদি আরব ২০৩০ সাল নাগাদ শিল্পোন্নত দেশের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হওয়ার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। এই লক্ষ্য অর্জনে সৌদি আরবের প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা, ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও প্রযুক্তি সরঞ্জাম, ইউরোপ ও চীনের সঙ্গে বাণিজ্য আর অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা। এ জন্য আপাতত প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনতে চায় রিয়াদ।

চীনকে যে কারণে বেছে নেওয়া

তেহরানের সঙ্গে সমঝোতায় তুলনামূলক ভালো মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে বেছে নেয় সৌদি আরব। রিয়াদ মনে করে, চীন যুক্ত হলে ইরানের সঙ্গে করা চুক্তি টিকবে। কারণ, চুক্তির লঙ্ঘন করে বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করার ঝুঁকি নেবে না তেহরান। সমঝোতার বিষয়টি নিয়ে সি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে রিয়াদ সফরকালে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে আলোচনা করেন। পরে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির সঙ্গে বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করেন চীনের প্রেসিডেন্ট।

দুই দেশই মনে করে, সির ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, উভয় দেশেরই বেইজিংয়ের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। ফলে চীনের প্রেসিডেন্ট দুই দেশের সমঝোতার ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত মধ্যস্থতাকারী হতে সক্ষম। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমাতে চীনের অধিকতর ভূমিকাকে স্বাগত জানায় ইরান।

কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের মিডলইস্ট স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ ফেলো স্টিভেন এ কুক নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, এই সময়ে এসে সৌদি যুবরাজ চীনের দিকেই ঝুঁকলেন। তিনি বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে কিছু গল্প চালু আছে—এই শতাব্দী চীনাদের। সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনে যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে সৌদি আরব। এটি চীনের বাজারে নিজেদের তেল রপ্তানির ভালো সুযোগ।’

সৌদি আরব সফরে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ফিস্ট বাম্প করতে দেখা যায়
ছবি: রয়টার্স

কেন সক্রিয় চীন

সৌদি আরব ও ইরানের সম্পর্ক জোড়া লাগানোর ক্ষেত্রে চীনের সম্পৃক্ততা বৈশ্বিক কূটনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। অতীতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে সতর্ক অবস্থান নিয়েছিল বেইজিং। কিন্তু নিজেদের বুর্জোয়া অর্থনীতির স্বার্থে এই কূটনৈতিক ভূমিকায় নেমেছে চীন।

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের জন্য এই অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ। আর সৌদি আরবের জ্বালানি খাতে নিজেদের বিনিয়োগ ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের ক্ষেপণাস্ত্রের কারণে যাতে বিঘ্নিত না হয়, সেটা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তাও দেখা দেয় বেইজিংয়ের জন্য।

এ ছাড়া ইরানের অর্থনীতিতে অবস্থান জোরদার করছে চীন। সুয়েজ খাল এড়িয়ে বৈশ্বিক বাজারে বাণিজ্যের জন্য মিত্র রাশিয়ার ট্রানজিট পরিকল্পনার প্রতি সমর্থনের কারণেও এ অঞ্চলে সক্রিয় হচ্ছে চীন। এই রুট বাস্তবায়িত হলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের শক্তিশালী নৌবহরের নিয়ন্ত্রণঝুঁকিতে থাকা মালাক্কা প্রণালির ওপরও নির্ভরতা কমাতে পারবে বেইজিং। এসব কৌশলগত কারণে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ জানাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে চীন।

আরও পড়ুন

কতটা বদলাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য

ইরানকে ঘিরে ফেলতে ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে কাজ করতে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কিন্তু তাঁর ডাকে সাড়া দেয়নি এই জোটের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরব। একই পথে হেঁটেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতও। বরং তারা ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে হেঁটেছে। সবচেয়ে বড় অগ্রগতি হলো ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধের সম্ভাবনা জেগেছে। বর্তমানে কয়েক দফায় যুদ্ধবিরতি চলছে। আশা করা হচ্ছে, শিগগিরই স্থায়ী শান্তি চুক্তি হবে। আর এ ক্ষেত্রে হুতি বিদ্রোহীদের ‘পৃষ্ঠপোষক’ ইরানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

আরব দেশগুলো তুরস্কের সঙ্গেও সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে হাঁটছে। সর্বশেষে যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি সত্ত্বেও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকেও আলিঙ্গন করেছেন বাকি আরব নেতারা। দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার পর আরব লিগে ফিরেছে সিরিয়া। ইউক্রেনে হামলা চালানোয় রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে বারবার চাপ দিয়েও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে পাশে পায়নি যুক্তরাষ্ট্র।

গত শতাব্দীর তিন-চতুর্থাংশ সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় ছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেখানকার শাসকগোষ্ঠীর অন্দরে কী ঘটছে, তা ছিল তাদের নখদর্পণে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই পরিবর্তনের সময়ে ওয়াশিংটনের সেই ভূমিকা আর নেই। বছরের পর বছর এই অঞ্চলে চীনের ভূমিকা ছিল গৌণ। আর সেই চীন এখন গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।

আরও পড়ুন

ইসরায়েল ও মিসরে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যানিয়েল সি কার্টজার নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা চীনের সঙ্গে ক্রমে সম্পর্কোন্নয়নের দিকে ঝুঁকছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সরাসরি হুমকির কি না, সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তবে এখানকার আঞ্চলিক (ভূরাজনৈতিক) ব্যবস্থা বদলে যাচ্ছে।’
সূত্র: ফরেন পলিসি ও নিউইয়র্ক টাইমস

আরও পড়ুন