ইসরায়েল স্থল আক্রমণ করলে, ইরানের সঙ্গে পেরে ওঠা সহজ হবে না

তেহরানে ইসরায়েলি হামলার পর ধোঁয়ার কুন্ডলী দেখা যায়। ইরান, ১৫ জুন ২০২৫ছবি: এএফপি
ইরানে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. শামীম আহসান
ছবি: লেখকের কাছ থেকে সংগৃহীত

আমার মতে, ইরানের শত্রুরা চাইবে না এত সহজে স্থলযুদ্ধে নামতে। তারা চাইবে, ক্রমাগত বিমান হামলা করে ইরানকে কাবু করে ফেলতে। কারণ, স্থলযুদ্ধের ব্যাপ্তি বিশাল। সামরিক কৌশলগত কারণে বাধ্য হয়ে যদি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর স্থলযুদ্ধের মাধ্যমে ইরানের ওপর আঘাত হানে, তাহলে ইরান হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। তারাও ইসরায়েলি বাহিনীর ওপর পাল্টা আঘাত করবে। শুধু তা–ই নয়, আমার মনে হয়, ইরান গেরিলাযুদ্ধের দিকে চলে যাবে। তবে এতে ইরানের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতিও হবে। কারণ, ইসরায়েল সামরিক দিক দিয়ে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা অর্জন করেছে। ইরান তুলনামূলকভাবে এদিক থেকে পিছিয়ে আছে।

দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ হলে জনসংখ্যা, ভৌগোলিক অবস্থান ও বৈচিত্র্যের কারণে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে টিকে থাকা ইসরায়েলের জন্য কঠিন হবে। ইসরায়েলের তুলনায় ইরান ৮০ গুণ বড় দেশ। সুতরাং ইসরায়েল স্থল আক্রমণ করলে, ইরানের সঙ্গে তাদের পেরে ওঠা সহজ হবে না।

ইরানের জনগণ দেশটিতে বহিঃশত্রুর আক্রমণের ঘোর বিরোধী। ইরানের ওপর ইসরায়েলি ও যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলা অযৌক্তিকভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে মনে করি। এ কারণে ইরানের জনগণ সর্বাত্মকভাবে প্রতিরোধ চালিয়ে যাবে।
আরও পড়ুন
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ওয়ার স্ট্র্যাটেজি যদি দেখি, তাহলে দেখব যে যুদ্ধে মূলত ইরান একাই লড়াই করছে। চীন, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার দেশটির পাশে থাকার কথা থাকলেও তারা সরাসরি এখনো ইরানের পাশে দাঁড়ায়নি। আর তুরস্ক ও মিসর বিবৃতি দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করে ফেলেছে বলে মনে হচ্ছে।

ইরানের শক্তি হলো তার দেশের জনগণ, যারা জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ। বহিঃশত্রুর আক্রমণ হলে নিজেদের বিভেদ ভুলে ইরানিরা এক হয়; এটা তাদের জাতিগত ঐতিহ্য। বর্তমানে ইরানের সরকারের বিপক্ষে কিছু মানুষ থাকলেও তারা তেমন কিছু করতে পারবে না বলে মনে হচ্ছে।

আরও পড়ুন

ইরানের জনগণ দেশটিতে বহিঃশত্রুর আক্রমণের ঘোর বিরোধী। ইরানের ওপর ইসরায়েলি ও যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলা অযৌক্তিকভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে মনে করি। এ কারণে ইরানের জনগণ সর্বাত্মকভাবে প্রতিরোধ চালিয়ে যাবে।

কেন যেন মনে হচ্ছে, হরমুজ প্রণালি হতে পারে ইরানের শেষ অস্ত্র। এটি বন্ধ করতে ২২ জুন ইরানের পার্লামেন্ট দেশটির সরকারকে অনুমোদন দিয়েছে। এখন ইরানের সর্বোচ্চ কাউন্সিল এটি চূড়ান্ত অনুমোদন করলেই হরমুজ প্রণালির নৌ–রুট ইরান বন্ধ করে দেবে। ইরান যদি হরমুজ প্রণালির এই রুট নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়, তাহলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম হু হু করে বাড়বে।
হরমুজ প্রণালি দিয়ে বিশ্বের মোট জ্বালানি তেলের প্রায় ২০ শতাংশ পরিবহন করা হয়
ফাইল ছবি: রয়টার্স

গোলাপের দেশ ইরানের অর্থনীতি প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্যাস ও তেলের মজুতদারদের মধ্যে ইরান অন্যতম। ২০২১ সালে গ্যাস মজুতের দিক দিয়ে ইরান ছিল দ্বিতীয় আর তেলে তৃতীয় বৃহৎত্তম। এই বিপুল সম্পদের একাংশের কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ ইরানের হাতে। দেশটি ঘেঁষেই রয়েছে হরমুজ প্রণালি, যা বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্যপথ। এই জলপথ দিয়েই প্রতিদিন বিশ্বে ব্যবহৃত তেলের ২১ শতাংশ সরবরাহ হয়। ইরান এটা বন্ধ করে দিলে অনেক দেশ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তখন তারা ইসরায়েলের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে বাধ্য হবে।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার জন্য ইরানের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তারা মূলত একাই নিজেদের সর্বশক্তি দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করছে। এই লড়াইয়ে ইরান খুব বেশি দেশকে পাশে পাবে না
মো. শামীম আহসান, ইরানে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত

কেন যেন মনে হচ্ছে, হরমুজ প্রণালি হতে পারে ইরানের শেষ অস্ত্র। এটি বন্ধ করতে ২২ জুন ইরানের পার্লামেন্ট দেশটির সরকারকে অনুমোদন দিয়েছে। এখন ইরানের সর্বোচ্চ কাউন্সিল এটি চূড়ান্ত অনুমোদন করলেই হরমুজ প্রণালির নৌ–রুট ইরান বন্ধ করে দেবে। ইরান যদি হরমুজ প্রণালির এই রুট নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়, তাহলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম হু হু করে বাড়বে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটবে এবং অস্থিরতা তৈরি হবে।

আরও পড়ুন
একটা কথা বলে রাখি, ইরানের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে আমেরিকার বেজস্টেশনে ৪০ হাজার সৈন্য আছে। আমার ধারণা, এদের ওপর ইরান হামলা চালাবে না। কারণ, আমেরিকার সৈন্যদের ওপর হামলা করলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হবে।

পারস্যের দেশ ইরানের মানুষ আমেরিকা ও ইসরায়েলের ষড়যন্ত্রে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ও তাঁর অনুগতদের সরিয়ে দেশটির শাসনভার রেজা পাহলভির কাছে ছেড়ে দেবে না; অর্থাৎ ইরানের মানুষ রেজা পাহলভির নেতৃত্ব মানবে না বলেই তাদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে। ইসরায়েলের হামলার পর ইরানি জনগণের রাজপথে স্বতস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ায় সেটাই প্রতিভাত হচ্ছে। তাই বিরোধীদের আশা এ যাত্রায় পূরণ হবে না বলে আমার বিশ্বাস। রেজিম পরিবর্তন হলেও হবে না। ইরানে অযৌক্তিক আক্রমণের কারণে ইরানিদের নিজেদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী মনোভাব শক্ত হয়েছে।

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলে ধসে পড়েছে একাধিক ভবন। সেখানে উদ্ধারকাজ চালাচ্ছেন জরুরি সেবা বিভাগের কর্মীরা। গতকাল তেল আবিব শহরে রামাত আবিব এলাকায়
ছবি: এএফপি

একটা কথা বলে রাখি, ইরানের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে আমেরিকার বেজস্টেশনে ৪০ হাজার সৈন্য আছে। আমার ধারণা, এদের ওপর ইরান হামলা চালাবে না। কারণ, আমেরিকার সৈন্যদের ওপর হামলা করলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হবে। তবে আমেরিকার মদদে ইসরায়েলি হামলার মুখে পড়ে ইরান ‘প্রপোরশনেট রেসপন্স’ করছে; অর্থাৎ যতটুকু ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, ঠিক ততটুকুই প্রতিরোধ করছে, এর বেশি নয়।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার জন্য ইরানের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তারা মূলত একাই নিজেদের সর্বশক্তি দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করছে। এই লড়াইয়ে ইরান খুব বেশি দেশকে পাশে পাবে না। আমি দীর্ঘদিন ইরানে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দেখেছি যে তাদের নিজেদের শক্তিই হলো আসল শক্তি। দৃঢ় মনোবলসমৃদ্ধ অসংখ্য নেতৃত্ব পাইপলাইনে থাকায় শীর্ষস্থানীয় বেশ কজন সামরিক নেতার মৃত্যুতে ইরানকে নেতৃত্বশূন্য মনে হচ্ছে না। তারা এটার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকে। দেশটি তার ঐতিহ্যগত রাজনৈতিক অবস্থান ধরে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং আমি মনে করি, তারা সফল হবে।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার জন্য ইরানের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তারা মূলত একাই নিজেদের সর্বশক্তি দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করছে। এই লড়াইয়ে ইরান খুব বেশি দেশকে পাশে পাবে না।
ইরানের হামলার পর ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের বন্দরনগরী হাইফায় আগুন জ্বলতে দেখা যায়। ১৬ জুন
ছবি: এএফপি

সবশেষে বলব, ইসরায়েল ও আমেরিকার পরিকল্পনায় একটা অন্যায় ও অযৌক্তিক যুদ্ধ ইরানের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য অঞ্চলে এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষা করতে কূটনৈতিক সমাধান জরুরি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইরান এখনো কূটনৈতিক সমাধানের পথেই হাঁটছে। সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির আস্থাভাজন সরকার, সামরিক নেতৃত্ব এবং দেশটির জনগণ অপেক্ষা করছে ধ্বংস, হত্যা আর রক্তপাত এড়াতে যুদ্ধ বন্ধে বিশ্ব মোড়লরা খুব দ্রুত কূটনৈতিক উদ্যোগ নেবে।

ইরানে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. শামীম আহসানের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি বায়েজিদ আহমেদ