প্রসববেদনা নিয়ে উটের পিঠে চড়ে ৭ ঘণ্টায় হাসপাতালে

উঁচু–নিচু পাহাড় আর পাথুরে রাস্তায় অন্তঃসত্ত্বা নারীদের একমাত্র ভরসা উট
ছবি: ইউএনএফপিএ

মোনার বয়স তখন ১৯। প্রসববেদনা ওঠার পর তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তাঁর স্বামী। কিন্তু বাড়ি থেকে হাসপাতালের দূরত্ব কম করে হলেও ৪০ কিলোমিটার। পাথুরে পাহাড় পার হয়ে স্বাভাবিক সময়ে সেখানে যেতে চার ঘণ্টা লেগে যায়। কিন্তু, দুর্গম পথ আর বাজে আবহাওয়া পেরিয়ে একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর সেখানে যেতে সময় লাগে কমপক্ষে সাত ঘণ্টা।

প্রসববেদনা নিয়ে এমন ভয়াবহ রাস্তা পার হওয়ার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে শিউরে ওঠেন মোনা। তিনি বলেন, ‘উট যখন এক পা দুপা করে এগোতে থাকে, তখন আমি ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। একপর্যায়ে রাস্তা এতই খারাপ ছিলো যে সে পথে উটও চলতে পারছিল না। তখন বাধ্য হয়ে আমাকে উটের পিঠ থেকে নামানো হয়। তখন দুপা–ই ভরসা। স্বামীর সঙ্গে হেঁটেই হাসপাতালের দিকে যেতে থাকি।’

ইয়েমেনের মাহউইত প্রদেশে মোনার বাড়ি। তাঁর মত এমন অসংখ্য অন্তঃসত্ত্বা নারী মা হতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়েন। তাঁদের একমাত্র ভরসা বানি সাদ হাসপাতাল। দুর্গম পাহাড়ি এলাকার হাজারো নারীর জীবন বাঁচিয়েছে হাসপাতালটি।

মোনার বাড়ি মাহউইত প্রদেশের আল-মাকারা গ্রামে। সেখান থেকে বানি সাদ হাসপাতালে যেতে দুর্গম পাহাড় ডিঙাতে হয়। এই পথ পাড়ি দিতে হয় উটের পিঠে চড়ে, নয়তো পায়ে হেঁটে।

হাসপাতালে যাওয়ার জন্য উটের পিঠে বসার পর অনাগত সন্তান আর নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে বুক দুরু দুরু করছিল মোনার। সেদিনের যাত্রার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘রাস্তার মধ্যে অসংখ্য পাথর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। এমন অবস্থায় চলতে গিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ি।’

অবস্থা বেগতিক দেখা আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা শুরু করেন মোনা। তিনি বলেন, ‘চলার পথে কখনো কখনো আমি দোয়া করছিলাম যে সৃষ্টিকর্তা আমাকে নিয়ে গিয়ে আমার শিশুকে রক্ষা করবেন। যাতে আমি ব্যথা থেকে রেহাই পাই।’

ছেলেসন্তানকে কোলে নিয়ে মোনা
ছবি: ইউএনএফপিএ

এইটুকু বলার পর মোনা একটু দম নিলেন। এরপর হাসপাতালে কীভাবে পৌঁছেছিলেন, সেই স্মৃতি মনে নেই তাঁর। নার্স ও চিকিৎসকের হাতে থাকা বাচ্চার কান্না শুনে আশার আলো খুঁজে পান তিনি। সন্তানের প্রাণ বাঁচানো চিকিৎসকের নামের সঙ্গে মিল রেখে ছেলের নাম রাখেন জাররাহ।

আশপাশের গ্রাম থেকে হাসপাতালে যাওয়ার রাস্তাটি খুবই সরু। আট বছর ধরে চলা হুতি বিদ্রোহী ও সরকারি বাহিনীর লড়াইয়ের কারণে কোথাও কোথাও রাস্তা ধ্বংস হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে।

এমন ভয়ংকর রাস্তা দিয়ে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের হাসপাতালে নেওয়ার পথে সঙ্গী হন তাঁদের স্বামী, পরিবারের সদস্য কিংবা অন্য কোনো নারী। সালমা আবদু (৩৩) নামের এক নারী অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের হাসপাতালে যেতে সাহায্য করেন। তিনি বলেন, একবার মাঝপথে একজন অন্তঃসত্ত্বা নারী দেখতে পান। ওই নারী হাসপাতালে যাওয়ার পথে রাতে মারা যান।

সালমা বলেন, ‘আমাদের রাস্তা, হাসপাতাল ও ফার্মেসি প্রয়োজন। এই উপত্যকার মধ্যে আমরা আটকা পড়ে আছি। যাঁদের কপাল ভালো, তাঁরা নিরাপদে সন্তান জন্ম দেন। অন্যরা মারা যান।’

অনেক পরিবারেরই হাসপাতালের খরচ বহন করার সামর্থ্য আছে। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর মতো আর্থিক সক্ষমতা নেই। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) হিশাম নাহরু বলেন, ইয়েমেনে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতি দুই ঘণ্টায় একজন নারীর মৃত্যু হয়।

নাহরু আরও বলেন, তীব্র ব্যথা কিংবা রক্তপাত না হওয়া পর্যন্ত ইয়েমেনের দুর্গম এলাকার নারীরা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে পারেন না। ইউএনএফপিএর তথ্য অনুযায়ী, ইয়েমেনে জন্ম নেওয়া অর্ধেকের কম শিশু দক্ষ চিকিৎসকের সেবা পায়। এ ছাড়া মাত্র এক-তৃতীয়াংশ শিশু জন্মের সময় স্বাস্থ্যসম্মত সেবা পায়।

দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অল্প কিছু হাসপাতাল আছে সেবা দেওয়ার মতো
ছবি: ইউএনএফপিএ

যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই ইয়েমেনের স্বাস্থ্য খাতের ভঙ্গুর অবস্থা। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। যুদ্ধের কারণে দেশটির হাসপাতাল ও রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ফলে ঝামেলা ছাড়া হাসপাতালে পৌঁছানো রীতিমতো অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাসপাতালগুলোতে যোগ্য কর্মী, সরঞ্জাম এবং ওষুধের অভাব রয়েছে। রাস্তা-ঘাট ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগও স্থবির হয়ে পড়েছে।

সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে ইয়েমেনে মোনার মতো আরও অনেক নারীকে এ ধরনের কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। ইয়েমেনের অধিকাংশ মানুষের ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার মতো সামর্থ্য নেই। দেশটির ৮০ শতাংশ মানুষ বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল।

মোনার মতো আরেক নারী হাইলা। তাঁর স্বামী সৌদি আরবে কাজ করতেন। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে ভাড়া করা মোটরসাইকেলে করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে অল্প কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছিলেন তিনি। একদিন হাইলার প্রসববেদনা ওঠার উপক্রম হলে তাঁর দেবর তাঁকে মোটরসাইকলের ওপর বসান। মোটরসাইকেলে করে হাসপাতালে যাওয়ার পথে একপর্যায়ে পড়ে যান তিনি।

এরপর হাইলাকে উত্তর ইয়েমেনের দামারের হাদাকা হেলথ সেন্টারে নেওয়া হয়। ত্বরিতগতিতে তাঁকে সার্জারি ওয়ার্ডে নেওয়া হয়। হাইলা বলেন, ‘মনে হচ্ছিল, আমি মারা গেছি। অনাগত সন্তান ও আমার বেঁচে থাকার কোনো সুযোগ ছিল না।’

একদম অন্তিত মুহূর্তে হেলথ সেন্টারের চিকিৎসকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে হাইলা বেঁচে যান এবং তাঁর সন্তান সুস্থ অবস্থায় জন্ম নেয়। সদ্যোজাত কন্যাশিশুর নাম রাখেন আমাল। আরবি ভাষার যার অর্থ ‘আশা’।

হাইলা বলেন, ‘অভিশপ্ত যুদ্ধের কারণে সন্তানসহ নিজের জীবন প্রায় হারাতে বসেছিলাম। কিন্তু শিশুটি আমাকে আশা জুগিয়েছে।’