গাজায় তীব্র শীত–বৃষ্টি: ‘আমার ছোট্ট বাচ্চা নিথর হয়ে গেল’

তীব্র শীতে গরম কাপড়ের অভাবে মারা গেছে নয় মাসের শিশুটি। তার মরদেহ কোলে নিয়ে মায়ের কান্নাছবি: রয়টার্স

শীতের রাত। এরপর আবার তুমুল বর্ষণ। ভেসে গেছে আরাফাত আল-গান্দুরের ছোট তাঁবুটি। পাঁচ সন্তান নিয়ে দিশাহারা অবস্থা আরাফাত ও তাঁর স্ত্রী নূরের। সকালের সূর্য ওঠার পর একটু স্বস্তির শ্বাস ফেলতে পারছেন তাঁরা। নূর বললেন, একসময় শীতকাল ভালোই লাগত। তবে এখন সেটিই দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।

দুর্বিষহ হবেই না কেন? এটা ফিলিস্তিনের গাজা। দুই বছর ধরে ইসরায়েলের জাতিগত নিধন আর ধ্বংসযজ্ঞের মুখে সেখানে বলতে গেলে আর কোনো ঘরবাড়িই অবশিষ্ট নেই। ছেঁড়া-ফাটা তাঁবু দিয়ে শীত আর কতটা আটকানো যায়। আর গতকাল বুধবার রাতে যে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে, তা আগামী শনিবার পর্যন্ত চলবে—এমনটাই পূর্বাভাস।

আরাফাতের পরিবার বাস্তুচ্যুত। থাকেন মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহে। ইসরায়েলি হামলার মুখে উত্তর গাজা থেকে পালিয়ে এসেছিলেন তাঁরা। গত বুধবার রাতের বৃষ্টিতে দেইর আল-বালাহর আল-বাসা ও আল-বারাকা এলাকা ভেসে গেছে। পানি জমে দেখা দিয়েছে বন্যা। একই অবস্থা খান ইউনিসে আল-মাওয়াসিসহ নুসেইরাত ও উত্তর গাজার বিভিন্ন এলাকায়।

এসব এলাকায় দেখা গেছে, ফিলিস্তিনিদের বহু তাঁবু ভেঙে পড়েছে। ভেতরে পানি-কাদায় একাকার। তীব্র শীতে ভেজা পোশাকে জবুথবু হয়ে আছে শিশুরা। তারা এখন কোথায় থাকবে, কী খাবে নেই তার কোনো ঠিকঠিকানা। রাস্তাঘাটে জমে গেছে পানি। বৃষ্টিপাতের পর গাজাবাসীর কাছ থেকে ২ হাজার ৫০০টির বেশি সাহায্যের আবেদন পেয়েছে স্থানীয় সিভিল ডিফেন্স।

তুমুল বর্ষণে তাঁবুর ভেতরে ঢুকে গেছে পানি। ভেতরে অসহায় ফিলিস্তিনি শিশুরা
ছবি: রয়টার্স

‘আমার ছোট্ট বাচ্চাটা নিথর হয়ে গেল’

দীর্ঘ সময় ধরে ইসরায়েলের অবরোধের ফলে তাঁবুর মতো শীতের কাপড়েরও সংকট রয়েছে গাজায়। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে শিশুরা। তীব্র শীতে বুধবার রাতেই ৯ মাস বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তার পরিবার থাকে খান ইউনিস এলাকায় একটি তাঁবুতে। শিশুটির মা আল-জাজিরাকে বললেন, সন্তানকে বাঁচাতে সব ধরনের চেষ্টা করেছেন, তারপর সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

অসহায় ওই মায়ের কথায়, ‘বৃষ্টি হচ্ছিল। তীব্র শীত। ওকে (শিশু) গরম রাখার জন্য খুব কম জিনিসই ছিল আমার কাছে। খাওয়ানোর পর ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। ভালোমতো কাপড়ে জড়িয়ে দিলাম। তবে শীত ঠেকানোর জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। বৃষ্টি বাড়ছিল, সঙ্গে শীতও। সারা রাত ভয় করছিল—কী হয় না হয়। একসময় দেখলাম আমার ছোট্ট বাচ্চাটা নিথর, প্রাণহীন।’

গাজায় এখন ১৫ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত। বর্তমানে যুদ্ধবিরতি চললেও অনেক ক্ষেত্রে এই মানুষগুলোর জন্য তাঁবু উপত্যকাটিতে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না ইসরায়েলি বাহিনী। এমন পরিস্থিতিতে সতর্ক করে জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ বলেছে, মানবিক সহায়তা প্রবেশ না করতে দিলে শীত-বৃষ্টিতে গাজায় অসুস্থতা ও সংক্রমণে ঝুঁকি বাড়বে।

বৃষ্টিতে তাঁবুর সামনে জমে গেছে পানি
ছবি: এএফপি

প্রয়োজন ৩ লাখ তাঁবু

গাজার বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ৩ লাখ তাঁবু প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন উপত্যকাটির গণমাধ্যম কার্যালয়ের পরিচালক ইসমাইল আল-তাওয়াবতা। তিনি বলেন, ইসরায়েলের হামলা ও ঝড়বাদলের কারণে হাজার হাজার তাঁবুর ক্ষতি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ৩ লাখ তাঁবুর দরকার হলেও এসেছে মাত্র ২০ হাজার। বৃষ্টিতে গাজার পানি সরবরাহ ব্যবস্থারও ক্ষতি হয়েছে।

নিজেদের দুর্দশার কথা আল-জাজিরাকে বলছিলেন ৬৬ বছর বয়সী বাসমা আল-শেখ খলিল। তাঁর সবচেয়ে দুশ্চিন্তা ছোট ছোট নাতি-নাতনিদের নিয়ে। তাদের কথা বলতে বলতে অশ্রু ধরে রাখতে পারলেন না তিনি। ভেজা চোখে বললেন, ‘গ্রীষ্ম কি শীত—সব ঋতুই এখন আমাদের জন্য দুর্বিষহ। আল্লাহ ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই।’