‘বাচ্চাটা বেঁচে থাকলে বলত, মা, ঈদের উপহারটা তৈরি রেখো কিন্তু’

সন্তানের কবরের পাশে বসে ছিলেন মা আমানি মনসুরছবি: রয়টার্স

‘আমার ছেলেটা বেঁচে থাকলে সকালে ঈদের নামাজ পড়তে মসজিদে যেত। বলে যেত, “মা, আমার উপহারটা তৈরি রেখো কিন্তু।” ও তো নেই। আমার জীবনের সব সুখ শেষ হয়ে গেছে।’ একবুক কষ্ট নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন আমানি মনসুর। ইসরায়েলে নিষ্ঠুর হামলা প্রাণ কেড়ে নিয়েছে তাঁর ছোট্ট সন্তানের।

ফিলিস্তিনের গাজায় ছেলের কবরের পাশেই ছিলেন আমানি মনসুর। পুরোনো দিনের সুখের স্মৃতিগুলো খুঁজে ফিরছিলেন সন্তানহারা এই মা। গত বছর জীবনের সেরা ঈদটা কাটিয়েছেন তিনি। বললেন, ‘গত ঈদে বাচ্চাটা আমার কাছেই ছিল। একেবারে কোলের ভেতরে। আমি ওকে সাজিয়ে-গুছিয়ে দিচ্ছিলাম। ওর সব আবদার পূরণ করেছিলাম।’

দেশে দেশে যখন মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন পবিত্র ঈদুল ফিতর উদ্‌যাপন করছেন, ভালো খাবার মুখে তুলছেন, আপন মানুষদের নিয়ে একাত্ম হচ্ছেন, তখন আমানি মনসুরকে দেখলেই গাজাবাসীর দুর্দশার চিত্রটা বোঝা যায়। গাজায় ঈদের উৎসবটা এবার নেই। ইসরায়েলের হামলা থেকে প্রাণ বাঁচাতে আর একমুঠো খাবার জোগাড় করতেই দিন পেরোচ্ছে তাঁদের।

গাজায় ইসরায়েলের হামলা চলছে ছয় মাস ধরে। কোনো বাছবিচার ছাড়াই হাজারে হাজারে ফেলা হচ্ছে বোমা। কাতারে কাতারে নিরপরাধ মানুষ মারা যাচ্ছেন। ঈদের সময়টাতেও এ হত্যাযজ্ঞ থামেনি। এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের হামলায় গাজার ৩৩ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু। রয়েছেন বহু নারী ও প্রবীণ ব্যক্তি।

‘ফেলে আসা দিনগুলো কাঁদায়’

দক্ষিণ গাজার রাফা এলাকার বাসিন্দা মাহমুদ আল-হামাইদা। একসময় ঈদের দিনগুলোতে পরিবার ও বন্ধুদের নিয়ে উৎসবে মেতে থাকতেন এই এলাকার বাসিন্দারা। ঈদ মানে ছিল মজাদার সব খাবারের আয়োজন। এবারের ঈদটা হামাইদার কাটছে হুইলচেয়ারে বসে। ইসরায়েলের হামলায় আহত হয়ে চলতে-ফিরতে পারেন না তিনি।

আমানি মনসুরের সঙ্গে ছিলেন তাঁর মা-ও
ছবি: রয়টার্স

হামাইদা বলছিলেন, ‘গত বছরের তুলনায়, এবারের ঈদটা মন ভেঙে দেওয়ার মতো। সন্তানদের দিকে তাকাই, আর বুকের ভেতরটা পুড়ে যায়। ঈদের দিন তাদের নিয়ে যখন বসেছিলাম, তখন কেঁদে ফেলেছিলাম। ফেলে আসা দিনগুলো এখন আমাকে কাঁদায়। গত ঈদে সন্তানদের মাঝে বসে থাকতাম। কত খুশি হয়ে তাদের দেখতাম! আজ তো চলতেও পারি না।’

আরও পড়ুন

গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে চলা ইসরায়েলের হামলায় গাজা পরিণত হয়েছে এক ধ্বংসের উপত্যকায়। সেখানকার ২৩ লাখ বাসিন্দার বেশির ভাগই হামলার মুখে ভিটেমাটি ছেড়েছেন। হাসপাতালগুলো বোমার আঘাতে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। খাবার-পানি জোগাড় করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে গাজাবাসীকে। জাতিসংঘের ভাষ্য, দুর্ভিক্ষ ধেয়ে আসছে।

এই হাহাকারের মধ্যেও ধ্বংস হওয়া মসজিদের বাইরে ঈদের নামাজ পড়েছেন গাজার ফিলিস্তিনিরা। বাড়িঘরের ধ্বংসস্তূপের ইট-পাথরের মধ্যে খেলাধুলা করতে দেখা গেছে শিশুদের। গাজার বাসিন্দা আবু শায়ের বলছিলেন, ‘আমরা চরম এক যন্ত্রণার মধ্যে রয়েছি। ছয় মাস ধরে হামলা চালানো হচ্ছে। তারপরও ঈদের দিনটা খুশি থাকতে হবে।’

মসজিদের ধ্বংসস্তূপের পাশেই ঈদের নামাজ আদায় করেন গাজাবাসী
ছবি: রয়টার্স

প্রার্থনা আর প্রতিবাদ

ইসরায়েলের হামলায় রাফার একটি মসজিদ ধ্বংস হয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে আছে শুধু মিনারটি। সেটির ছায়ায় ঈদের নামাজ পড়েছেন ফিলিস্তিনিরা। ইসরায়েলের হামলা থেকে বাঁচতে মিসর সীমান্তের এই এলাকাটিতে আশ্রয় নিয়েছেন ১০ লাখের বেশি ফিলিস্তিনি।

শুধু গাজা নয়, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক মানুষেরই দিন কাটছে যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যে। ঈদের দিনে তাঁদের সবার জন্য প্রার্থনা হয়েছে দেশে দেশে। ইরাকের রাজধানী বাগদাদের বাসিন্দা ওমর নিজার করিম বলছিলেন, ‘ফিলিস্তিনি ভাইদের বিজয় ও মুক্তি চেয়ে আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি।’ আর গাজাবাসীর প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে জর্ডানের রাজধানী আম্মানে। বিক্ষোভকারী আবদেল মাজিদ রানতিসি ভাষ্য, ‘গাজাকে যখন ধ্বংস করা হচ্ছে, তখন আমাদের জীবনের কোনো ঈদ নেই।’