ইসরায়েল কি ইরানের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় যুদ্ধের পরিকল্পনা করছে

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকোলাজ

ইরানের সঙ্গে গত মাসের ১২ দিনের যুদ্ধে নিজেদের বিজয়ী মনে করছে ইসরায়েল। যুদ্ধ চলাকালীন একাধিক ইরানি সামরিক কমান্ডার নিহত হন, ইরানের প্রতিরক্ষা সামরিক সক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং যুক্তরাষ্ট্র ফর্দোর পারমাণবিক স্থাপনায় হামলায় অংশ নিতে সম্মত হয়—এসবকে বড় সাফল্য বলে দেখছে তেল আবিব।

তবে জয়ের দাবি করলেও ইসরায়েলি নেতারা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, প্রয়োজন হলে তাঁরা আবার হামলা চালাতে প্রস্তুত। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা করেছেন, ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক চাপ ও আগ্রাসী নীতি থেকে একচুলও পিছিয়ে আসতে রাজি নন তিনি।

বিশ্লেষকেরা আল–জাজিরাকে জানিয়েছেন, ইসরায়েল ইতিমধ্যে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে আরও একটি বড় সংঘাতের উপযুক্ত সুযোগের সন্ধান করছে।

তবে এমন আরেকটি যুদ্ধ চালাতে হলে ইসরায়েলের যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। আর ওয়াশিংটন আদৌ সেই অনুমোদন দেবে কি না, তা অনিশ্চিত।

গত জুনের মাঝামাঝি ইরানে ইসরায়েলের এক আকস্মিক হামলা থেকে দুই দেশের মধ্যে প্রথম সরাসরি সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে। এতে এক হাজারের বেশি ইরানি ও ২৯ জন ইসরায়েলি নিহত হন।

ইসরায়েলের দাবি, তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করতে আত্মরক্ষামূলক হামলা চালিয়েছে। তবে তেহরান বহুদিন ধরেই দাবি করে আসছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শুধুই বেসামরিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত।

বিশ্লেষকেরা আল–জাজিরাকে জানিয়েছেন, ইসরায়েল ইতিমধ্যে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে আরেকটি বড় সংঘাতের উপযুক্ত সুযোগের সন্ধান করছে।

এ সপ্তাহের শুরুতে আল–জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেন, বর্তমান যুদ্ধবিরতি কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে, তা নিয়ে তিনি সন্দিহান।

পেজেশকিয়ান বলেন, ‘ইসরায়েলের যেকোনো নতুন সামরিক আগ্রাসনের জন্য আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। আমাদের সশস্ত্র বাহিনী আবারও ইসরায়েলের ভেতরে গভীরভাবে আঘাত হানতে সক্ষম।’

যুদ্ধের পেছনের উদ্দেশ্য

ইসরায়েল শুধু পারমাণবিক স্থাপনাগুলোই লক্ষ্যবস্তু করেছিল—এমন দাবি করলে বাস্তবে তারা ইরানের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে। ইরানকে দুর্বল করা ও দেশটিতে সরকার উৎখাতের চেষ্টা হিসেবেই এ হামলাকে স্পষ্টত দেখা হচ্ছে।

ইসরায়েলের যেকোনো নতুন সামরিক আগ্রাসনের জন্য আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। আমাদের সশস্ত্র বাহিনী আবারও ইসরায়েলের ভেতরে গভীরভাবে আঘাত হানতে সক্ষম।
—মাসুদ পেজেশকিয়ান, ইরানের প্রেসিডেন্ট

ইরানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও যুক্তরাষ্ট্রের বামঘেঁষা গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কুইন্সি ইনস্টিটিউটের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট ত্রিতা পারসি বলেন, নেতানিয়াহু আবারও সেই মিশনে নামার সুযোগ খুঁজছেন।

ত্রিতা বলেন, ইসরায়েলের আবার হামলা চালাতে চাওয়ার পেছনে কারণ হলো তারা চায় ইরানকে সিরিয়া বা লেবাননের মতো বানাতে, যেখানে ইসরায়েল যখন খুশি তখন হামলা চালাতে পারে কোনো রকম জবাবদিহি ছাড়াই।

নতুন অজুহাত তৈরির প্রস্তুতি

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইউরোপীয় দেশগুলো যদি আবার ইরানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তবে সেটি ইসরায়েলের জন্য আরেকটি যুদ্ধের ‘সুবর্ণ সুযোগ’ হতে পারে।

চলতি জুলাই মাসের শুরুতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে এক বৈঠকে বসেন। সেখানে তাঁরা একমত হন যে আগামী আগস্টের মধ্যে নতুন কোনো পারমাণবিক চুক্তি না হলে ইরানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞাগুলো পুনর্বহাল করা হবে।

২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য বিশ্বশক্তিগুলোর পারমাণবিক চুক্তি সই করার পর এ নিষেধাজ্ঞাগুলো প্রত্যাহার করা হয়েছিল। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে প্রথম দফায় ক্ষমতায় এসে যুক্তরাষ্ট্রকে ওই চুক্তি থেকে একতরফা সরিয়ে নেন এবং ‘সর্বোচ্চ চাপ’ নীতির আওতায় নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করেন।

ইসরায়েলের আরেকটি বড় আক্রমণ যদিও খুব শিগগির না-ও আসতে পারে, তবে নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল ইতিমধ্যে ইরানে নাশকতামূলক গোপন অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। তিনজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও এক ইউরোপীয় কূটনীতিকের ভাষ্য, ইরানের বিভিন্ন অ্যাপার্টমেন্ট ভবন, তেল শোধনাগার, বিমানবন্দরের পাশের এলাকা ও এক জুতা কারখানায় আকস্মিক বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের জন্য ইসরায়েল দায়ী।

এখন যদি ইউরোপীয় দেশগুলো একই পথ অনুসরণ করে, তবে ইরান পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধসংক্রান্ত চুক্তি (এনপিটি) থেকে সরে আসতে পারে—এমনটাই আশঙ্কা পারসির। তিনি বলেন, এটা হলে ইসরায়েলের সামনে আবার হামলা চালানোর রাজনৈতিক সুযোগ তৈরি হবে।

ইসরায়েলের রাইখম্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানবিষয়ক অধ্যাপক মেইর জাভেদানফার বলেন, পারমাণবিক কর্মসূচি পুনর্গঠনের (ইরানের) কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ হাজির না করলে দেশটিতে ইসরায়েলের পক্ষে হামলা চালানো কঠিন হবে।

এই অধ্যাপক সতর্ক করে বলেন, এমন একটি হামলা চালাতে ইসরায়েলের যুক্তরাষ্ট্র ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অনুমতি দরকার। তবে সিরিয়ায় ইসরায়েলের আগ্রাসন নিয়ে ওয়াশিংটনের উদ্বেগের কারণে সেই অনুমতির সম্ভাবনা কম।

আরও পড়ুন
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান
ফাইল ছবি: রয়টার্স

গোপন অভিযানের নেপথ্যে

ইসরায়েলের আরেকটি বড় আক্রমণ যদিও খুব শিগগির না-ও আসতে পারে, তবে গত বুধবার নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল ইতিমধ্যে ইরানে নাশকতামূলক গোপন অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, তিনজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও এক ইউরোপীয় কূটনীতিকের ভাষ্যমতে, ইরানের বিভিন্ন অ্যাপার্টমেন্ট ভবন, তেল শোধনাগার, বিমানবন্দরের পাশের এলাকা ও এক জুতা কারখানায় আকস্মিক বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের জন্য ইসরায়েল দায়ী।

নেতানিয়াহু আবারও সেই মিশনে নামার সুযোগ খুঁজছেন। ইসরায়েলের আবার হামলা চালাতে চাওয়ার পেছনে কারণ হলো তারা চায় ইরানকে সিরিয়া বা লেবাননের মতো বানাতে, যেখানে ইসরায়েল যখন খুশি তখন হামলা চালাতে পারে কোনো রকম জবাবদিহি ছাড়াই।
—ত্রিতা পারসি, ইরানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও কুইন্সি ইনস্টিটিউটের সহপ্রতিষ্ঠাতা

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির ইরানবিষয়ক বিশ্লেষক নেগার মরতাজাভি বলেন, ‘মনে হচ্ছে, নেতানিয়াহু এমন একটি ফর্মুলা খুঁজে পেয়েছেন, যার মাধ্যমে তিনি ট্রাম্পের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার পরও নির্বিঘ্নে ইরানে হামলা চালাতে সক্ষম।’

গত জুনের সংঘাত শুরুর সময়ই ইরানের নিরাপত্তা ও পরিকাঠামোয় ইসরায়েলের বিস্তৃত অনুপ্রবেশের প্রমাণ পাওয়া গেছে। স্থানীয় গোয়েন্দা সদস্য ও ইরানি ভূখণ্ড থেকেই ড্রোন হামলা চালিয়ে ইসরায়েল বহু ইরানি লক্ষ্যে আঘাত হানে।

তেল আবিব থেকে বিশ্লেষক ও ইরান বিশেষজ্ঞ ওরি গোল্ডবার্গ বলেন, যুদ্ধ শেষ হলেও ইরানে ইসরায়েলের সেই গুপ্ত নেটওয়ার্ক এখনো সক্রিয় আছে।

গোল্ডবার্গ বলেন, ইসরায়েল ইরানের ভেতরে একটি শক্তিশালী নিরাপত্তাকাঠামো তৈরি করেছে। আর এ ধরনের কাঠামোর কার্যকারিতা ধরে রাখতে মাঝেমধ্যেই কিছু না কিছু করতে হয়—হোক সেটা অগ্নিসংযোগ, হোক বিস্ফোরণ। এটি ইরানকে মনে করিয়ে দেওয়ার কৌশল যে তারা এখনো সেখানে আছে।

আরও পড়ুন

নতুন যুদ্ধের আশঙ্কা কতটা

নেতানিয়াহু আগে কিছুটা সংঘাতবিরোধী ছিলেন। এখন প্রতিবেশী সিরিয়া ও লেবানন, সেই সঙ্গে ইয়েমেন ও ইরানের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে আক্রমণ করে এবং গাজায় নৃশংস আক্রমণ অব্যাহত রেখে যেভাবে সংযমের সম্পূর্ণ অভাব দেখাচ্ছেন, তা খুব কম লোকই অনুমান করতে পেরেছিলেন।

ইরানের বিরুদ্ধে নেতানিয়াহুর আরেকটি অভিযান ইসরায়েলের অভ্যন্তরে সৃষ্ট বিভাজন থেকে ইসরায়েলিদের দৃষ্টি সরাতে সহায়ক হতে পারে। গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ নিয়ে দেশটির অভ্যন্তরে এমন বিভক্তি দেখা দিয়েছে। কিন্তু তাঁর প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসন কীভাবে এটি (সম্ভাব্য অভিযান) নেবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।

আরও পড়ুন

গোল্ডবার্গ বলেন, ট্রাম্পই এখন মূল চিন্তার জায়গা। ইসরায়েল এমন কিছু করতে চাইবে না, যা ট্রাম্পের দৃষ্টিতে সীমা লঙ্ঘন। তবে ইরান নিয়ে ইসরায়েলের মধ্যে রাজনৈতিক ঐকমত্য আছে। গাজা নিয়ে ভিন্নমত থাকতে পারে, কিন্তু ইরান নিয়ে নয়। তিনি আরও বলেন, নেতানিয়াহু যদি নিজেকে নিয়ে রাজনৈতিক চাপ অনুভব করেন, তবে ইরানকে সামনে টেনে এনে সবাইকে একতাবদ্ধ করার চেষ্টা করবেন।

অবশ্য বিশ্লেষকেরা বলছেন, এবার ইরান আর অসতর্ক থাকবে না। মরতাজাভি আল–জাজিরাকে বলেন, ইসরায়েল যে আগ্রাসন অব্যাহত রাখবে, তা ইরান ধরেই নিচ্ছে। তবে সেই সঙ্গে তারা এখনো কূটনৈতিকভাবে পারমাণবিক চুক্তিতে পৌঁছার আশাও করে যাচ্ছে।

এই বিশ্লেষক বলেন, তারা (ইরান) জানে, কোনো চুক্তি হলে ইসরায়েলের আক্রমণের আশঙ্কা অনেকটাই কমে যাবে।

আরও পড়ুন