প্রায় ১৪ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধের পর সিরিয়ায় নতুন সরকার আঞ্চলিক সম্পর্ক পুনর্গঠনের পথে এগোচ্ছে। তাদের অনেকটা মনোযোগ এখন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্ভাব্য সম্পর্কের দিকে।
নানা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, নিজেদের মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়েছে। এমনকি দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সম্ভাব্য সময়সীমা নিয়েও নানান কথা শোনা যাচ্ছে।
১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় থেকে সিরিয়া ও ইসরায়েল কার্যত এখনো যুদ্ধাবস্থায় রয়েছে। ১৯৭৪ সালে দুই দেশের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলেও পরে তা ভেঙে যায়।
এখন পর্যন্ত যা ঘটেছে
ইসরায়েলি গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিরিয়া ও ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের বিষয়ে সম্ভাব্য চুক্তি নিয়ে সরাসরি আলোচনা শুরু করেছে।
দুই দেশের মধ্যে এই যোগাযোগে মধ্যস্থতা করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। দেশটি গোপন যোগাযোগের মাধ্যমে আলোচনা সহজ করেছে বলে জানা গেছে।
যদি কোনো চুক্তি হয়, তাহলে তা সম্ভবত আব্রাহাম চুক্তির একটি সম্প্রসারণ হবে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় কয়েকটি আরব দেশ ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি ‘আব্রাহাম চুক্তি’ নামে পরিচিত।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উল্লেখযোগ্য উদ্যোগের একটি ছিল ‘আব্রাহাম চুক্তি’। এ উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল আরব দেশগুলোকে ইসরায়েলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপনে রাজি করানো।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উল্লেখযোগ্য উদ্যোগের একটি ছিল ‘আব্রাহাম চুক্তি’। এ উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল আরব দেশগুলোকে ইসরায়েলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপনে রাজি করানো।
২০২০ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন আব্রাহাম চুক্তিতে সই করে। পরে সুদান ও মরক্কো চুক্তির অংশ হয়।
ট্রাম্প এই চুক্তির পরিসর আরও বাড়াতে চাইছেন এবং নতুন নতুন দেশকে চুক্তির অংশ করার চেষ্টা করছেন।
গত মে মাসে ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যের তিনটি দেশ সফর করেন। সৌদি আরবে অবস্থানকালে রিয়াদে তিনি সিরিয়ার নতুন অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তিনি আল-শারাকে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে উৎসাহ দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ কি সম্ভব
বিশ্লেষকদের মতে, ভবিষ্যতে এমনটি সম্ভব হলেও হতে পারে। তবে সিরিয়ার লেখক রবিন ইয়াসিন-কাসাব মনে করেন, এই মুহূর্তে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ প্রায় অসম্ভব।
সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে শত্রুতা দীর্ঘদিনের। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ এবং ইসরায়েল সে সময়ে সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখলে নেওয়ার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে শত্রুতা আরও তীব্র হয়।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদেওন সার বলেছেন, সিরিয়ার সঙ্গে যেকোনো চুক্তিতে তাঁর দেশ গোলান মালভূমির ওপর দখল বজায় রাখার ব্যাপারে অনড় থাকবে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গোলান মালভূমির আরও ভেতরে ঢুকে বসতবাড়ি দখল ও সেখান থেকে লোকজনকে উচ্ছেদ করছে।
এই মুহূর্তে [সিরিয়া-ইসরায়েল] সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ প্রায় অসম্ভব।রবিন ইয়াসিন-কাসাব, সিরিয়ার লেখক ও বিশ্লেষক
বিশ্লেষকদের মতে, বহু সিরীয় গোলান মালভূমি ইসরায়েলের হাতে তুলে দেওয়ার বিপক্ষে অবস্থান নেবেন। অবশ্য, এরপরও অনেকে বাস্তবভিত্তিক আলোচনাকে স্বাগত জানাতে পারেন।
এ নিয়ে ইয়াসিন-কাসাব বলেন, ‘সিরীয়দের মধ্যে বিভক্তি রয়েছে…তবে সেখানে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সবাই বুঝে গেছেন, সিরিয়া নিজেকে রক্ষা করতে বা ইসরায়েলের বিরুদ্ধ যুদ্ধ করতে সক্ষম নয়…তাই এখন [আল-শারার] আলোচনায় বসাই বরং ভালো।’
এ পরিস্থিতিতে ১৯৭৪ সালের যুদ্ধবিরতির মতো কোনো সমঝোতায় ফিরে যাওয়াই এখন সবচেয়ে বাস্তবসম্মত পথ হতে পারে বলে যোগ করেন ইয়াসিন।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সিরিয়া ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর, ইসরায়েলের পার্লামেন্ট সিরিয়ায় বসতি সম্প্রসারণের একটি পরিকল্পনায় ভোট দেয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, সিরিয়ায় ইসরায়েলের বসতি স্থাপন সম্পূর্ণরূপে অবৈধ।
বর্তমানে গোলান মালভূমির দখল করা অংশে ৩১ হাজারের বেশি ইসরায়েলি বসতি স্থাপন করেছেন।
সিরিয়ার বর্তমান অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আল-শারা বলেছেন, তাঁর দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি স্থাপনে আগ্রহী এবং ১৯৭৪ সালে দুই দেশের মধ্যে যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছিল, তা বজায় রাখবে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সিরিয়া ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর, ইসরায়েলের পার্লামেন্ট সিরিয়ায় বসতি সম্প্রসারণের একটি পরিকল্পনায় ভোট দেয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সিরিয়ায় ইসরায়েলের বসতি স্থাপন সম্পূর্ণরূপে অবৈধ।
গত ৮ ডিসেম্বর বাশার আল-আসাদের সিরিয়া ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার দিন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছিলেন, তিনি ওই চুক্তিকে বাতিল বলে বিবেচনা করছেন।
ইসরায়েল বারবার সিরিয়ায় হামলা চালিয়ে দেশটির সামরিক অবকাঠামোর একটি বড় অংশ ধ্বংস করে ফেলেছে এবং সিরিয়ার গোলান মালভূমি সীমান্তবর্তী অঞ্চলের নতুন কিছু অংশ দখলে নিয়েছে।
সিরিয়া সম্ভবত একটি নতুন অনাক্রমণ চুক্তির আওতায় ইসরায়েলের কাছ থেকে গোলান মালভূমির নতুন করে দখল করা অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহার চাইবে। যদিও বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গোলান মালভূমি বিষয়টি এখনো আলোচনায় আসেনি।
সম্প্রতি কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলেছেন, তাঁরা সিরিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তি করতে আগ্রহী। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সিরিয়া বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত টম ব্যারাককে এ বিষয়ে মধ্যস্থতার অনুরোধ করেছেন। ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান সাখি হানেগবি সিরীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার দায়িত্ব পালন করছেন।
ইসরায়েলের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বরাতে টাইমস অব ইসরায়েলের খবরে বলা হয়েছে, এই আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত আছেন এবং আলোচনা অগ্রগতির পর্যায়ে রয়েছে।
সিরিয়ার সঙ্গে যেকোনো চুক্তিতে ইসরায়েল গোলান মালভূমির ওপর দখল বজায় রাখার ব্যাপারে অনড় থাকবে।গিদেওন সার, ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
লেবাননের দৈনিক আল-আকবরের খবরে বলা হয়, আল-শারার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা সিরিয়ার পক্ষ থেকে দুই দেশের সম্পর্ক সম্পূর্ণ স্বাভাবিকীকরণে না গিয়ে ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।
ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনায় সিরিয়ার চাওয়া কী হতে পারে
সিরিয়া চায়, তাদের ভূখণ্ডে ইসরায়েলের হামলা বন্ধ হোক।
গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক বিস্তার নিয়ে অনেক সিরীয়র মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে; তবে আল-শারা সরকার গোলানের দখলকৃত অংশগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানাবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
তবে সিরিয়া চায়, ইসরায়েল যেন গোলান মালভূমির মূল অংশ এবং গত এক বছরে দখল করা অংশগুলো থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয়।
ইসরায়েল সিরিয়ার নতুন সরকারকে হুমকি দিয়ে বলেছে, তারা যেন দামেস্কের দক্ষিণাঞ্চলে সেনা মোতায়েন না করে। এ অঞ্চল ইসরায়েলের সীমান্তবর্তী।
গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক বিস্তার নিয়ে অনেক সিরীয়র মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে; তবে আল-শারা সরকার গোলানের দখলকৃত অংশগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানাবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
অভিযোগ আছে, ইসরায়েল ওই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা উসকে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ইসরায়েল বলেছে, যদি সিরিয়ার নতুন সরকারের সহযোগী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সেখানকার সংখ্যালঘু ‘দ্রুজ’ সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়, তাহলে ইসরায়েল সিরীয় দ্রুজদের রক্ষায় হস্তক্ষেপ করবে।
দ্রুজ সম্প্রদায়ের অনেকে সিরিয়ার নতুন সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছেন বটে। তবে তাঁদের অনেকে আবার ইসরায়েলের হস্তক্ষেপের হুমকিকে উদ্দেশ্যমূলক নাটক হিসেবে দেখছেন। তাঁরা মনে করেন, এর মাধ্যমে ইসরায়েল সিরীয়দের মধ্যে আরও বিভেদ সৃষ্টি করতে চাইছে।
ইসরায়েল কী চায়
প্রতিবেদন অনুযায়ী, নেতানিয়াহু সিরিয়ার সঙ্গে একটি নিরাপত্তা চুক্তি চান, যেটি ১৯৭৪ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তির একটি হালনাগাদ সংস্করণ হবে। এর ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ শান্তিচুক্তির কাঠামো গড়ে তোলার পরিকল্পনা তাঁর রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দূত ব্যারাকের জোর দাবি, সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যকার বিরোধ সমাধানযোগ্য। একটি অনাক্রমণ চুক্তির মাধ্যমে তিনি সামধান যাত্রার সূচনা করার প্রস্তাব দিয়েছেন।
তবে গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলের অব্যাহত দখল অনেক সিরীয়কে হতাশ করতে পারে।
সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যকার বিরোধ সমাধানযোগ্য।টম ব্যারাক, সিরিয়া বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত
ইয়াসিন-কাসাব বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ও ইসরায়েলের সহিংসতার অব্যাহত হুমকি থাকার পরও [আল-শারার জন্য] রাজনৈতিকভাবে এটি করা অত্যন্ত কঠিন।’
ইসরায়েলের আরও কিছু শর্ত রয়েছে বলে জানা গেছে। যেমন সিরিয়ায় তুরস্কের কোনো সামরিক ঘাঁটি থাকা যাবে না, ইরান বা ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠী যেমন হিজবুল্লাহর উপস্থিতি থাকতে পারবে না এবং সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলকে নিরস্ত্রীকরণ করতে হবে।