বাবাকে নজরবন্দী, ভাইদের আটক—সৌদি রাজতন্ত্রে যেভাবে ক্ষমতাধর হয়ে উঠলেন মোহাম্মদ বিন সালমান

সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ২০১৫ সালে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং পরে ২০১৭ সালের ২১ জুন ক্রাউন প্রিন্স হন। সৌদি আরবে এখন কার্যত বাদশাহ তিনি। কিন্তু তাঁর আগে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফকে যুবরাজ করা হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে, প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে প্রভাব খাটিয়ে তিনি সৌদি যুবরাজ পদে বসেছেন। সৌদি আরবে তাঁর ক্ষমতার কেন্দ্রে আসা নিয়ে পশ্চিমা লেখক ডেভিড বি ওটাওয়ে ও বান হার্ভাড বই লিখেছেন। দুজনের বইয়ে রয়েছে অনেক অজানা তথ্য। এসব নিয়ে বিবিসি হিন্দিতে লিখেছেন রেহান ফজল। আজ ৩ সেপ্টেম্বর লেখাটি বিবিসি বাংলার অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে।

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানফাইল ছবি: রয়টার্স

বাদশাহ আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর সৌদি সাম্রাজ্যের নতুন বাদশাহ হন সালমান বিন আবদুল আজিজ। ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন বাদশাহ আবদুল্লাহ।

শুরুতে যুবরাজ (ক্রাউন প্রিন্স) হিসেবে সৎভাই মুকরিন বিন আবদুল আজিজের নাম ঘোষণা করেছিলেন বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ। সে সময় মুকরিনের বয়স ছিল ৬৮ বছর।

কিন্তু মাত্র তিন মাস পরেই সালমান বিন আবদুল আজিজ বরখাস্ত করেন সৎভাইকে। পরিবর্তে ৫৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ বিন নায়েফকে ওই জায়গায় আনেন। সম্পর্কে তিনি বাদশাহর ভাইপো। পাশাপাশি ২৯ বছরের ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানকে ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেন তিনি।

প্রায় ৯ বছর আগে যখন একের পর এক এসব ঘটনা ঘটছিল, সে সময় মোহাম্মদ বিন সালমানের নাম সৌদি আরবের রাজনীতিতে কেউ শোনেননি। তাঁর সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানতেনও না কেউ।

অন্যদিকে মোহাম্মদ বিন নায়েফের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল মার্কিন প্রশাসন। তিনি প্রতিরক্ষা বিষয়ে এফবিআইয়ের (যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো) কোর্স করেছিলেন। নিয়েছিলেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে সন্ত্রাস দমন কৌশলের প্রশিক্ষণও; কিন্তু ২০০৯ সালের আগস্টে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে তাঁকে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা চালানো হয়। ওই হামলার জন্য সে সময় দায়ী করা হয়েছিল আল-কায়েদাকে।

সৌদি বাদশাহর ‘দ্বাররক্ষক’

মোহাম্মদ বিন সালমান এমবিএস নামে বহুল পরিচিত। লেখক ডেভিড বি ওটাওয়ে তাঁর বইয়ে মোহাম্মদ বিন সালমান সম্পর্কে লিখেছেন, ‘প্রতিরক্ষামন্ত্রী হওয়ার পরপরই তিনি (মোহাম্মদ বিন সালমান) বাদশাহর গেটকিপার (দ্বাররক্ষক) হওয়ার জন্য নিজের পদকে ব্যবহার করতে শুরু করেন।’ উদ্দেশ্য ছিল, বাবাকে নজরে রাখা।

বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দ্রুতই মোহাম্মদ বিন সালমান তাঁর বাবাকে পরিবার ও বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের থেকে আলাদা করে ফেলেন। এমনকি এ–ও বলা হয় যে বাদশাহকে তাঁর স্ত্রী, মানে এমবিএসের মায়ের সঙ্গেও দেখা করতে বাধা দেওয়া হয়।

লেখক বেন হাবার্ড তাঁর বই ‘দ্য রাইজ টু পাওয়ার, মোহাম্মদ বিন সালমান’-এ উল্লেখ করেছেন, ‘মোহাম্মদ বিন নায়েফ ও তাঁর দুই রক্ষী বাদশাহর সঙ্গে দেখা করার জন্য লিফটে উঠেছিলেন। দোতলায় লিফটের দরজা খুলতেই বাদশাহর সৈন্যরা এগিয়ে গিয়ে নায়েফের রক্ষীদের অস্ত্র ও মুঠোফোন ছিনিয়ে নেন।’

ডেভিড বি ওটাওয়ের বইয়ে দাবি করা হয়েছে, মোহাম্মদ বিন সালমান কার্যত তাঁর মা ও দুই বোনকে গৃহবন্দী করেন এবং বাবাকে এ সম্পর্কে ঘুণাক্ষরেও কিছু টের পেতে দেননি।

বাদশাহ নিজের স্ত্রীর কথা জিজ্ঞাসা করলেই বলা হতো চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছে তাঁকে।

ইয়েমেন আক্রমণ

প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দ্রুতই নিজের প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন মোহাম্মদ বিন সালমান। তাঁর তত্ত্বাবধানে সে বছরের ২৬ মার্চ (২০১৫ সাল) হুতি বিদ্রোহীদের কাছ থেকে ইয়েমেনের রাজধানী সানাকে মুক্ত করতে হামলা চালায় সৌদি বিমানবাহিনী।

মোহাম্মদ বিন সালমান ছোটবেলায় খুব দুষ্টু ছিলেন। ইংরেজি পড়ার চেয়ে ওয়াকিটকিতে প্রাসাদের নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে কথা বলতেই বেশি আগ্রহ ছিল তাঁর।
রশিদ সেকাই, সৌদি যুবরাজের ইংরেজি শিক্ষক

ওটাওয়ে তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘প্রাথমিকভাবে সৌদি জনগণ ওই হামলার প্রশংসা করেছিলেন। ভেবেছিলেন, শেষ পর্যন্ত ইরানের সম্প্রসারণবাদী প্রবণতার বিরোধিতা করার সাহস দেখিয়েছে তাঁদের দেশ।’

’কিন্তু কিছুদিন পর এ হামলা বাদশাহ, মোহাম্মদ বিন সালমান ও সৌদি আরবের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এটিকে মোহাম্মদ বিন সালমানের পররাষ্ট্রনীতির গাফিলতি হিসেবে বিবেচনা করা হতে থাকে।’

মোহাম্মদ বিন নায়েফকে আটক

কাছাকাছি সময়েই তৎকালীন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফকে অপসারণ করে ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানকে ক্রাউন প্রিন্স করার সিদ্ধান্ত নেন বাদশাহ সালমান।

পবিত্র রমজান মাসের শেষ দিকে ২০১৫ সালের ২০ জুন রাতে রাজপরিবারের একাধিক সদস্য পবিত্র মক্কায় জড়ো হন। সেই রাতে, রাজনৈতিক ও সুরক্ষাবিষয়ক কাউন্সিলের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, যার সভাপতিত্ব করার কথা ছিল মোহাম্মদ বিন নায়েফের; কিন্তু বৈঠক শুরুর কিছুক্ষণ আগেই তিনি একটি বার্তা পান। সেখানে বলা হয়েছিল, বাদশাহ সালমান তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান।

বলা হয়, সৌদি আরবে অন্তত ১০ হাজার প্রিন্স রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় ১০০ জন রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়। তাঁদের সবাইকে সরকারের পক্ষ থেকে মাসিক ভাতা দেওয়া হয়। সর্বনিম্ন ভাতা ৮০০ ডলার এবং সর্বোচ্চ পৌনে ৩ লাখ ডলার। ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করার পরই এ ভাতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেন মোহাম্মদ বিন সালমান।

তড়িঘড়ি হেলিকপ্টারে সওয়ার হয়ে বাদশাহর সঙ্গে দেখা করার জন্য সাফা মহলে পৌঁছান বিন নায়েফ। সঙ্গে ছিলেন তাঁর দুই দেহরক্ষী।

লেখক বেন হাবার্ড তাঁর বই ‘দ্য রাইজ টু পাওয়ার, মোহাম্মদ বিন সালমান’-এ উল্লেখ করেছেন, ‘মোহাম্মদ বিন নায়েফ ও তাঁর দুই রক্ষী বাদশাহর সঙ্গে দেখা করার জন্য লিফটে উঠেছিলেন। দোতলায় লিফটের দরজা খুলতেই বাদশাহর সৈন্যরা এগিয়ে গিয়ে নায়েফের রক্ষীদের অস্ত্র ও মুঠোফোন ছিনিয়ে নেন।’

‘পাশের একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয় নায়েফকে। তিনি চলে যেতে উদ্যত হলে, বাধা দেওয়া হয় এবং ক্রাউন প্রিন্স পদ থেকে পদত্যাগ করার জন্য চাপ দেওয়া হতে থাকে। কিন্তু তাঁদের কথা শুনতে নারাজ ছিলেন বিন নায়েফ।’

নায়েফের পদত্যাগ

ওই রাতেই বিন নায়েফকে গৃহবন্দী করা হয় এবং রয়্যাল কোর্টের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রয়্যাল কাউন্সিলের সদস্যদের ডেকে জানতে চান, তাঁরা মোহাম্মদ বিন সালমানকে যুবরাজ বানানোর সিদ্ধান্তের বিষয়ে একমত কি না।

কাউন্সিলের ৩৪ সদস্যের মধ্যে ৩১ জন সমর্থন জানান। তাঁদের ফোনকল রেকর্ড করা হয় এবং মোহাম্মদ বিন নায়েফকে জানানো হয়, তাঁর কতজন আত্মীয় বাদশাহর এ সিদ্ধান্তে সমর্থন করেছেন।

মোহাম্মদ বিন সালমান তখনো ক্রাউন প্রিন্স হননি। রিয়াদে একটি মূল্যবান জমির ওপর নজর পড়ে তাঁর বাবার; কিন্তু জমির মালিক সেটি বিক্রি করতে চাইছিলেন না। এ নিয়ে চাপ দিতে একজন বিচারকের কাছে যান মোহাম্মদ বিন সালমান। বিচারকও এ নিয়ে কথা বলতে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। তখন মোহাম্মদ বিন সালমান বিচারকের টেবিলে রিভলবারের একটি বুলেট রাখেন। ইঙ্গিত ছিল, বিচারক তাঁর কথা না মানলে হয়তো তাঁকে গুলি করা হবে।
রিচার্ড লেসি, সৌদি রাজপরিবারের ইতিহাস পর্যবেক্ষক

বেন হাবার্ড তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘বিন নায়েফ ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন। কিন্তু সে রাতে তাঁকে ওষুধ দেওয়া হয়নি। ফলে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত পরদিন সকালে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করার জন্য তৈরি হয়ে যান।’ তাঁকে পাশের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে বাদশাহ সালমান ও তাঁর নিরাপত্তারক্ষীরা ক্যামেরাসহ হাজির ছিলেন।

বিন নায়েফকে অভ্যর্থনা জানান বাদশাহ এবং তাঁর হাতে চুম্বন করেন। নায়েফ খুব নিচু স্বরে সালমানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। তাঁদের এই সাক্ষাতের ভিডিও সৌদি টিভি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সে সময় বারবার সম্প্রচার করা হয়।
‘এরপর মোহাম্মদ বিন নায়েফ কক্ষ থেকে বেরোনোর পর অবাক হয়ে দেখেন যে তাঁর রক্ষীরা সেখানে নেই। জেদ্দায় নিজের প্রাসাদে পৌঁছানোর পর তাঁকে সেখানে গৃহবন্দী করে রাখা হয়।’

বিন নায়েফের নীরবতা

নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রশ্নের জবাবে রয়্যাল কোর্টের একজন মুখপাত্র অবশ্য ওই রাত সম্পর্কে ভিন্ন কথা বলেছেন। তিনি বলেন, জাতীয় স্বার্থে ক্রাউন প্রিন্সের পদ থেকে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়েছিল রয়্যাল কাউন্সিল। রয়্যাল কোর্ট আরও জানায়, তাঁকে বরখাস্ত করার কারণগুলো গোপন রাখা হয়েছে এবং সেগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।

ঘটনার প্রায় এক মাস পর নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সৌদি কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানান, মরফিন ও কোকেনে আসক্ত থাকার কারণে বিন নায়েফকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাদশাহ।

ওই বছরের শেষের দিকে বিন নায়েফের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়। তাঁর প্রতি এমন আচরণ নিয়ে মোহাম্মদ বিন নায়েফ অবশ্য প্রকাশ্যে কোনো কথা বলেননি।
বর্তমানে পরিস্থিতি এমন যে ১৯৮৫ সালের ৩১ আগস্ট জন্ম নেওয়া মোহাম্মদ বিন সালমানের পোস্টার সৌদি আরবের সর্বত্র দেখা যায়। তিনি সৌদি রাজপরিবারের অন্যতম যুবরাজ, যিনি বিদেশে পড়াশোনা করেননি। তিনি কখনোই সৌদি সেনাবাহিনী বা বিমান বাহিনীর সদস্য ছিলেন না। রিয়াদের রয়্যাল অ্যান্ড সেকেন্ডারি স্কুলে পড়াশোনা করেন তিনি।

মোহাম্মদ বিন সালমানের ইংরেজি শিক্ষক রশিদ সেকাই বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘মোহাম্মদ বিন সালমান ছোটবেলায় খুব দুষ্টু ছিলেন। ইংরেজি পড়ার চেয়ে ওয়াকিটকিতে প্রাসাদের নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে কথা বলতেই বেশি আগ্রহ ছিল তাঁর।’
স্নাতক হওয়ার পর ২০০৭ সালে সারা বিনতে মাশুরকে বিয়ে করেন মোহাম্মদ বিন সালমান। এই যুগলের চারটি সন্তান রয়েছে।

পিয়ানোতে ধ্রুপদি সুর

মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় তাঁকে নিজের বাড়িতে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি।

বইয়ে সে প্রসঙ্গে বেন হাবার্ড লিখেছেন, পুরো সন্ধ্যাটাই কেরির সঙ্গে কথা বলে কাটান মোহাম্মদ বিন সালমান। সে সময় বিন সালমানের চোখ পড়ে সেখানে রাখা পিয়ানোর ওপর।

জন কেরি বিন সালমানের কাছ থেকে জানতে চান, ‘আপনি পিয়ানো বাজাতে জানেন? পিয়ানোতে ধ্রুপদি সুর বাজিয়ে তাক লাগিয়ে দেন মোহাম্মদ বিন সালমান।’
‘ঘরে উপস্থিত সবাই অবাক হয়েছিলেন। যেহেতু ‘‘ওয়াহাবি ঘরানার’’ মানুষেরা সংগীত অপছন্দ করে, ফলে জন কেরি আশা করেননি যে মোহাম্মদ বিন সালমান পিয়ানো বাজাবেন।’

বিচারকের টেবিলে বুলেট

শুরু থেকেই যুবরাজ বিন সালমানের ঝোঁক ছিল বিনিয়োগের মাধ্যমে নিজস্ব অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলার দিকে।

সৌদি রাজপরিবারের ইতিহাস পর্যবেক্ষক রিচার্ড লেসি লিখেছেন, ‘মোহাম্মদ বিন সালমান তখনো ক্রাউন প্রিন্স হননি। রিয়াদে একটি মূল্যবান জমির ওপর নজর পড়ে তাঁর বাবার। কিন্তু জমির মালিক সেটি বিক্রি করতে চাইছিলেন না।’

‘এ নিয়ে চাপ দিতে একজন বিচারকের কাছে যান মোহাম্মদ বিন সালমান। বিচারকও এ নিয়ে কথা বলতে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। তখন মোহাম্মদ বিন সালমান বিচারকের টেবিলে রিভলবারের একটি বুলেট রাখেন। ইঙ্গিত ছিল, বিচারক তাঁর কথা না মানলে হয়তো তাঁকে গুলি করা হবে।’

যুবরাজের এহেন আচরণ সম্পর্কে বাদশাহ আবদুল্লাহর কাছে অভিযোগ করেন বিচারক। এ খবর কখনো অস্বীকার করেননি সালমান। এরপর ২০১১ সালে বাদশাহ আবদুল্লাহ যখন মোহাম্মদ বিন সালমানের বাবাকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন, তখন শর্ত দিয়েছিলেন যে এমবিএস যেন কখনোই মন্ত্রণালয়ের ভবনে প্রবেশ না করে।

নারীদের গাড়ি চালানোর স্বাধীনতা

মোহাম্মদ বিন সালমানের বাবা যখন সৌদি আরবের বাদশাহ হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ৭৯ বছর। শোনা যায়, বেশ কয়েক বছর ধরেই আলঝেইমারে ভুগছিলেন তিনি। এই পরিস্থিতিতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ক্ষমতার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেন মোহাম্মদ বিন সালমান।

সৌদি আরবের যুবক ও নারীদের মন জয় করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন বিন সালমান। তিনি ২০১৮ সালে নারীদের জন্য প্রচলিত ড্রেস কোড (পোশাকবিধি) শিথিল করে বলেছিলেন, প্রকাশ্যে নারীদের ‘আবায়া’ পরার দরকার নেই।

সেই বছরই নারীদের ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়, যাতে তাঁরা নিজেরাই কাজে বা কেনাকাটার জন্য গাড়ি চালিয়ে যেতে পারেন। এ জন্য সঙ্গে পুরুষ অভিভাবক রাখার প্রয়োজন নেই।

লেখক মার্ক থম্পসন তাঁর ‘বিয়িং ইয়ং, মেল অ্যান্ড সৌদি’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, ‘অর্থনৈতিক কারণে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, নারীদের স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য নয়।’ তাঁর মতে, ‘নারীরা পুরুষের অনুমতি ছাড়াই যাতে কাজ করতে ও উপার্জন করা অর্থ ব্যয় করতে পারেন, সে কথা মাথায় রেখেই নেওয়া হয় এ পদক্ষেপ।’

‘শুরা’র সমাপ্তি

সৌদি আরববিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে ‘শুরা’ ও জ্যেষ্ঠ প্রিন্সদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঐতিহ্যে বিরাম টেনেছেন মোহাম্মদ বিন সালমান। ‘শুরা’ বলতে পরামর্শমূলক পরিষদকে বোঝায়। এর বদলে নিজেকে এক ও একমাত্র শাসক হিসেবে তুলে ধরেছেন তিনি।

নিজের সিদ্ধান্ত ও রাজনীতির বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রতিবাদ বা সমালোচনা যে বিন সালমান বরদাস্ত করবেন না, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি।

চেজ ফ্রিম্যান ১৯৯০-এর দশকের উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় সৌদি আরবে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর মতে, ‘সৌদি রাজপরিবারের ঐক্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হলো শুরার ধারণার প্রতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা।’

বিলাসবহুল সামগ্রীর প্রতি আকর্ষণ

ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার আগেও দামি সামগ্রীর প্রতি আকর্ষণের জন্য পরিচিত ছিলেন মোহাম্মদ বিন সালমান। তিনি ৪৪০ ফুট লম্বা বিলাসবহুল ইয়ট কিনতে ৫০ কোটি ডলার খরচ করেছিলেন। এর আগে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে লেওনার্দো দা ভিঞ্চির বিখ্যাত চিত্রকর্ম কেনার জন্য ৪৫ কোটি ডলার খরচ করেন।

সমালোচনা এড়াতে বিন সালমান প্রথমে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে ওই বিখ্যাত চিত্রকর্ম আবুধাবির জাদুঘরে দিয়ে দেবেন; কিন্তু তেমনটা হয়নি। এর কিছুদিন পরই তাঁর বিলাসবহুল নৌযান ‘সেরিন’-এ দেখা যায় ওই চিত্রকর্ম।

একের পর এক গ্রেপ্তার, হারিরির পদত্যাগ

বলা হয়, সৌদি আরবে অন্তত ১০ হাজার প্রিন্স রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় ১০০ জন রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়। তাঁদের সবাইকে সরকারের পক্ষ থেকে মাসিক ভাতা দেওয়া হয়। সর্বনিম্ন ভাতা ৮০০ ডলার এবং সর্বোচ্চ পৌনে ৩ লাখ ডলার।

ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করার পরই এ ভাতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেন মোহাম্মদ বিন সালমান।

২০১৭ সালের ৪ নভেম্বর মোহাম্মদ বিন সালমান সরকারি তহবিল তছরুপের অভিযোগে প্রিন্স, ব্যবসায়ী ও জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা মিলিয়ে ৩৮০ জনকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেন।

বেন হাবার্ড লিখেছেন, ‘তাঁদের মধ্যে কমপক্ষে ১১ জন প্রিন্স ছিলেন। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী আদিল ফিকিয়া এবং অর্থমন্ত্রী ইব্রাহিম আবদুল আজিজও ছিলেন।’

‘তাঁদের সবার মুঠোফোন কেড়ে নেওয়া হয় এবং পাঁচ তারকা রিটজ-কার্লটন হোটেলে নিয়ে গিয়ে গৃহবন্দী করা হয়। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করা অর্থ সরকারকে ফেরত দেওয়ার পর তাঁদের সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি তাঁরা মোট ১০০ কোটি ডলার জরিমানাও দেন।’

একই ভাবে সৌদি আরব সফরে যাওয়া লেবাননের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সাদ আল-হারিরিকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে বিন সালমানের বিরুদ্ধে। সে সময় ওই অভিযোগ ঘিরে তোলপাড় শুরু হয়।

বেন হাবার্ড লিখেছেন, ‘আল-হারিরি মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে দেখা করতে এলে তাঁকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর গাড়িবহরে থাকা ব্যক্তিদের বাইরে থাকতে বলা হয়। ওই কক্ষেই হারিরিকে পদত্যাগ করতে বলা হয়।’

‘আল-হারিরি লেবাননের পতাকার পাশে দাঁড়িয়ে পদত্যাগের ঘোষণা করেন এবং একটা বিবৃতি পাঠ করেন। সে বিবৃতি বিশ্বজুড়ে টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়েছিল।’

আল–হারিরিকে বলতে শোনা যায়, তাঁর পদত্যাগ লেবাননকে আরও শক্তিশালী ও স্বাধীন করে তুলবে। এই বিবৃতি পাঠের সময় তিনি বেশ কয়েকবার থামেন এবং এমন একটা ইঙ্গিত দেন যে ওই বিবৃতি তিনি নিজে লেখেননি।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ‘হারিরি যদি পদত্যাগই করতে চাইতেন, তবে বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে কেন পদত্যাগ করলেন?’

এর কয়েকদিন পর আল-হারিরি দেশে ফেরেন এবং তাঁর সেই পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নেন। এই অদ্ভুত ঘটনার নেপথ্যের কাহিনি অবশ্য কখনোই জানা যায়নি।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০১৮ সালের মে মাসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সৌদি সরকার ছয় মাসের বেশি সময় ধরে ২ হাজার ৩০৫ জনকে আটক করেছে, যাঁদের মধ্যে ২৫১ জন তিন বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারে রয়েছেন এবং তাঁদের কখনো বিচারকের সামনে হাজির করা হয়নি।

শুধু তা–ই নয়, নিউইয়র্কভিত্তিক ‘কমিটি ফর দ্য প্রটেকশন অব জার্নালিস্ট’ও তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, সৌদি আরবে ২৬ জন সাংবাদিক বন্দী রয়েছেন। এ সংখ্যা চীন ও তুরস্কের পর বিশ্বে সর্বোচ্চ। আবার ২০১৯ সালে এক হাজার সৌদি নাগরিকের ওপর ভ্রমণ–নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল।

জামাল খাসোগি হত্যা মামলা

মোহাম্মদ বিন সালমানের জন্য সবচেয়ে বিব্রতকর ব্যাপার ছিল, যখন তুরস্কের সৌদি দূতাবাসে গিয়ে এমবিএসের অন্যতম সমালোচক সাংবাদিক জামাল খাসোগি খুন হন।

খাসোগি আরব নিউজ ও আল-ওয়াতানের মতো সংবাদপত্রের সম্পাদক ছিলেন। সব প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও মোহাম্মদ বিন সালমান এক বছর ধরে ওই হত্যার দায় অস্বীকার করেন।

ডেভিড বি ওটাওয়ে লিখেছেন, ‘মোহাম্মদ বিন সালমানের দুই ঘনিষ্ঠ সহযোগীর তত্ত্বাবধানে এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তদন্ত শেষে সিআইএ এ সিদ্ধান্তে আসে যে এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ স্বয়ং যুবরাজই দিয়েছিলেন।’

‘যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসএ) মোহাম্মদ বিন সালমানের একটা পুরোনো রেকর্ডিং খুঁজে পায়, যেখানে সৌদি আরবে না ফিরলে খাসোগিকে গুলি করার কথা বলেছিলেন তিনি।’

প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সিবিএস নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উপস্থাপক নোরা ডোনেল যুবরাজকে সরাসরি প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কি খাসোগিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন?’

জবাবে মোহাম্মদ বিন সালমান বলেছিলেন, ‘একেবারেই না। এটি একটি জঘন্য অপরাধ। কিন্তু সৌদি আরবের নেতা হিসেবে আমি এর সম্পূর্ণ দায় নিচ্ছি। বিশেষত, যখন অপরাধীরা সৌদি সরকারের হয়ে কাজ করছিল।’

এরপর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সৌদি আরবের এক আদালত সাংবাদিক খাসোগিকে হত্যার দায়ে পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড ও তিনজনকে ২৪ বছরের কারাদণ্ড দেন। তবে ২০২০ সালের ২০ মে প্রয়াত সাংবাদিকের পুত্র সালেহ খাসোগি তাঁর বাবার হত্যাকারীদের ক্ষমা করে দেন।