মাহমুদ আব্বাসের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্ন কি অধরাই থেকে যাবে

ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস

ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে মাহমুদ আব্বাস জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন ইয়াসির আরাফাতের ছায়ায়, ফিলিস্তিনি জনগণের দাবি নিয়ে যিনি দীর্ঘসময় লড়াই চালিয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি কখনো ওই ভূমিকায় আরাফাতের মর্যাদা পাননি এবং জনগণকে একটি রাষ্ট্র দেওয়ার কাছাকাছি নিতে পারেননি।

পশ্চিম তীরের রামাল্লা শহরে থাকেন ৮৭ বছর বয়সী মাহমুদ। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে মাহমুদ আব্বাসের ভূমিকা আরও ক্ষয়িষ্ণু হয়েছে। ২০০৬ সাল থেকে গাজা সিটির নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে হামাসের কাছে। অন্যদিকে পশ্চিম তীরে দখলকৃত এলাকায় ইহুদি বসতি ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে।

ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল—দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের জন্য ওয়াশিংটনের সমর্থনের পুনরাবৃত্তি করার পর গত মঙ্গলবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু এর আগে আব্বাস বলেছেন, পশ্চিমা সরকারগুলো ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে ও ইসরায়েলকে জবাবদিহি করাতে ব্যর্থ হয়েছে। এতে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হচ্ছে না।

গত বছর থেকে পশ্চিম তীরে ক্রমবর্ধমান রক্তপাত বেড়ে যাওয়ায় দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান এখন দূরের আশা বলে মনে হচ্ছে। এর মধ্যেই ইসরায়েলে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে নতুন সরকার এসেছে। তারা পশ্চিম তীরে আরও বসতি স্থাপন করছে। গাজায় রকেট হামলার জবাবে ইসরায়েলি বাহিনী বিমান হামলা চালাচ্ছে।

ব্লিঙ্কেনের সফরের সময় ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেন, আজ যা ঘটছে, তার জন্য ইসরায়েল সরকার দায়ী। কারণ, ইসরায়েলের কার্যকলাপে দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানকে দুর্বল করছে। তারা বরাবর চুক্তির লঙ্ঘন করে চলেছে।

আব্বাস এ ধরনের অভিযোগ প্রায়ই করে থাকেন আর ইসরায়েল তা প্রত্যাখ্যান করে আসছে।

আব্বাস হলেন ফিলিস্তিনি নির্বাসিত মানুষের প্রথম প্রজন্ম। ঔপনিবেশিক শক্তি নতুন মধ্যপ্রাচ্যসীমানা আঁকার পর জন্ম তাঁর। ১৯৪৮ সালের প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের কথা তিনি স্মরণ করতে পারেন। ওই যুদ্ধে আব্বাসসহ ফিলিস্তিনের ১৪ লাখ মানুষ পালিয়ে যান এবং শরণার্থী হিসেবে নতুন জীবন শুরু করেন।

ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে কয়েক দশক ধরে নেতৃত্ব দেওয়া প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) উপদল ফাতাহর শুরুর দিককার সদস্য ছিলেন তিনি। ২০০৪ সালে ইয়াসির আরাফাত মারা গেলে তিনি নেতা হন। এর এক বছর পরই তিনি ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু ইসরায়েলের দখলে থাকা পশ্চিম তীরে তাঁদের সার্বভৌমত্ব সীমিত।

মাহমুদ আব্বাসের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ১৯৯৩ সালে হোয়াইট হাউসের এক অনুষ্ঠানে ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিমন পেরেজের সঙ্গে স্বাক্ষর করা একটি চুক্তি। অসলো চুক্তি নামের সেই চুক্তিতে ইসরায়েল-অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনি স্বায়ত্তশাসনের কথা ছিল।

এ চুক্তির পেছনে ছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন, ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইয়াতজিক রবিন। সহিংসতার বিরুদ্ধে আব্বাসের আলোচনার পক্ষে গুরুত্বারোপ ও ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘর্ষ ঠেকাতে আলোচনার মাধ্যমে তাঁর নিষ্পত্তির প্রস্তাব নতুন আশা জাগায়। কিন্তু ইয়াসির আরাফাত মারা গেলে দুই দশকের বেশি সময় পর ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কও একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। সমালোচকেরা এ জন্য আব্বাসের অভ্যন্তরীণ চক্রের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং কার্যকর পদক্ষেপের অভাবকে দায়ী করেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাহমুদ আব্বাসকে বাইরে খুব কমই দেখা গেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে তাঁর বারবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির বিষয়টি ফিলিস্তিনি সরকারকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে।

১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ-শাসিত ফিলিস্তিনের সাফেদ শহরে জন্ম আব্বাসের। ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের সময় যুদ্ধের কারণে তাঁকে শিশু অবস্থায় সিরিয়ায় পালিয়ে যেতে হয়। পরে তিনি কাজের জন্য কাতারে যান। সেখানে আরাফাতসহ অন্য ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ফাতাহ দলে যোগ দেন।

১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল পশ্চিম তীর ও গাজা দখল করে নেয়। আরাফাতের ফাতাহ পিলওর নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কয়েক দশকের গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয়। পরে পিএলওর নেতারা জর্ডান থেকে লেবানন ও পরে তিউনিসিয়ায় চলে যান। অসলো চুক্তির পর ফিলিস্তিনি নেতারা যখন নির্বাসিত জীবন থেকে গাজায় ফেরেন, আব্বাস তখন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ‘আমি ফিলিস্তিনেই বসবাস করব।’ কিন্তু এরপর শান্তি আলোচনা ভেস্তে যায়।

২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন আব্বাস। কিন্তু তাঁর ফাতাহ গ্রুপ ২০০৬ সালে প্রাথমিক নির্বাচনে হেরে যায়। গাজায় গৃহযুদ্ধে ফাতাহকে পরাজিত করে হামাস। ফলে আব্বাস পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি-শাসিত এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারান। এর পর থেকে সেখানে আর কোনো নির্বাচন হয়নি।

দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের উদ্যোগ পুনরুদ্ধার করার জন্য চেষ্টা চালান আব্বাস। জাতিসংঘে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের মর্যাদা পেতে একতরফা পদক্ষেপও নিয়েছিলেন তিনি। ২০১২ সালে ফিলিস্তিন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে স্বীকৃতিও পায়। তবে তা ছিল ‘নন মেম্বার স্টেটহুড’ হিসেবে। কিন্তু একটি রাষ্ট্রের লক্ষ্য অধরা থেকে গেছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে রদবদল হলেও আব্বাস তাঁদের ওপর খুব কম প্রভাব ফেলতে পেরেছেন। যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ইসরায়েল এখন সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মরক্কোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এতে আঞ্চলিক মিত্র হিসেবে আব্বাস আরও বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।

রয়টার্স ও বিবিসি অবলম্বনে মো. মিন্টু হোসেন