ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে আসল সমস্যা কোথায়

মাহমুদ আব্বাস ও বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুছবি: রয়টার্স

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি অঞ্চলে আবারও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। এ সহিংসতা বন্ধে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আরব দেশগুলোর সমর্থনে উচ্চাভিলাষী একটি পরিকল্পনা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র অনুভব করছে, বয়স্ক ও বিচ্ছিন্ন ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্টের কাজ এটি নয়। শান্তির জন্য নতুন রক্ত চাই। তাই যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনি নেতাকে নতুন একজন টেকনোক্র্যাট প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করতে চাপ দিয়েছেন, যিনি দুর্নীতিগ্রস্ত ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে পুনর্গঠন করে একটি রাষ্ট্র গঠনে কাজ করবেন।

এটা এখনকার কথা শোনালেও ২০০৩ সালেও একই ঘটনা ঘটেছিল। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনের দ্বিতীয় ইন্তিফাদা বা পুনর্জাগরণের সময় ইয়াসির আরাফাতের ওপর ধৈর্য হারিয়েছিল। তাঁর পছন্দের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মাহমুদ আব্বাস, যিনি ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট হন। এখন তিনি চতুর্থ মেয়াদে গত ১৯ বছর ধরে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু ফিলিস্তিন এখনো দুর্নীতিগ্রস্ত। রাষ্ট্র গঠন এখনো সুদূরপরাহত।

এখন গাজায় ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞের মধ্যে উত্তেজিত যুক্তরাষ্ট্র চাইছে মাহমুদ আব্বাস যেন নিজের সংস্কারমনা প্রধানমন্ত্রী বেছে নেন। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ এশতায়েহে পদত্যাগপত্র জমা দেন। প্রেসিডেন্ট তা গ্রহণ করেন। তবে তিনি নতুন সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত এশতায়েহেকে কাজ চালিয়ে যেতে বলেন। আব্বাসের প্রতিনিধিদল হামাস ও ফিলিস্তিনের অন্য উপদলগুলোর কাছে সমর্থন চাওয়ার পরিকল্পনা করছে।

এশতায়েহে বলেছেন, গাজার উদীয়মান বাস্তবতা বিবেচনা করার জন্য নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রয়োজন। ইতিমধ্যে ইসরায়েলের হামলায় গাজায় প্রায় ৩১ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, যাঁদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।

ফিলিস্তিনের দায়িত্ব যাঁর কাঁধেই আসুক না কেন, তাঁকে বড় তিনটি বাধা পেরোতে হবে। প্রথমটি হলো, ভেঙে পড়া ফিলিস্তিনের পুনর্গঠন।

এশতায়েহের জায়গায় যিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন, তাঁর নাম মোহাম্মদ মুস্তাফা। তিনি একজন অর্থনীতিবিদ। প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করার দরুন তাঁর সঙ্গে সম্পর্কও ঘনিষ্ঠ। মোহাম্মদ মুস্তাফা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও ফিলিস্তিনি জনগণের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কম। তাঁকে ঘিরে প্রত্যাশা, তিনি ফিলিস্তিনের দীর্ঘদিনের দুর্নীতি ও অচলাবস্থা পরিষ্কার করবেন। পশ্চিমা ও উপসাগরীয় অঞ্চলে তাঁর সমর্থনের প্রধান দাবি এটি। এর বিনিময়ে তিনি তাঁদের কাছ থেকে আর্থিক সমর্থন পাবেন। কিন্তু বাস্তবতা সম্ভবত ভিন্ন কথাই বলছে।

ফিলিস্তিনের দায়িত্ব যাঁর কাঁধেই আসুক না কেন, তাঁকে বড় তিনটি বাধা পেরোতে হবে। প্রথমটি হলো, ভেঙে পড়া ফিলিস্তিনের পুনর্গঠন। ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে তাদের হয়ে কর সংগ্রহ করে ইসরায়েল। তাই করের ওপর ইসরায়েলের ওপর নির্ভরশীল তারা। ফিলিস্তিনের আয়ের ৬৪ শতাংশ আসে কর থেকে।

গত অক্টোবর থেকে ডানপন্থী ইসরায়েলি অর্থমন্ত্রী বেজালের স্মোটরিচ ফিলিস্তিনের অর্থ আটকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এর পর থেকে ফিলিস্তিন কোনো কর্মকর্তার যথাসময়ে পুরো বেতন দিতে পারেনি। এই অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে ফিলিস্তিনি কর্মীদের তাদের অঞ্চলে ঢোকার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইসরায়েল। এতে পশ্চিম তীরের ২০ শতাংশ কর্মী বেকার হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া ইসরায়েলে কাজ করা ফিলিস্তিনিরা কোনো বেতন পাচ্ছেন না। আন্তর্জাতিক লেবার অর্গনাইজেশন এ তথ্য জানিয়েছে। অর্থ না থাকলে কোনো রাষ্ট্র গঠন করা যায় না।

দ্বিতীয় বাধা হচ্ছেন মাহমুদ আব্বাস নিজেই। তিনি নিজেই আরও বেশি স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছেন। তিনি একাধিকবার নির্বাচন বন্ধ করেছেন। তাঁর ভয়, নির্বাচনে তাঁর দল ফাত্তাহ হেরে যাবে। তিনি ডিক্রি জারি করে শাসন চালিয়েছেন। আদালতে নিজের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। বিচারক নিয়োগের কাউন্সিল বাতিল করে তিনি নিজ সমর্থনের বিচারক বাড়িয়েছেন। সুশীল সমাজ নিঃশেষ হয়ে গেছে।

আব্বাসের শাসনকে চ্যালেঞ্জ করায় অনেক নেতা-কর্মীকে কারাবরণ করতে হয়েছে বা তাঁদের গোপনে হত্যা করা হয়েছে। সর্বশেষ মাহমুদ আব্বাস টেকনোক্র্যাট হিসেবে যাঁকে নিয়োগ দিয়েছিলেন, তিনি হলেন সালাম ফাইয়াদ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা সালাম ফাইয়াদ ২০০৭ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। দুজনের মধ্যে প্রায়ই বনিবনা হতো না।

অন্যদিকে এশতায়েহে ছিলেন পেশাদার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তিনি দীর্ঘদিন ফাতাহ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি নির্বাচন কমিশনের প্রধান ও আবাসনমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যে বিবাদ প্রকট হয়ে উঠেছিল। তাঁর অর্থমন্ত্রী কোনো অর্থপূর্ণ পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে দুজনের একই কক্ষে বসাও হতো না। তাঁর আমলে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শহরের নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ হারায়। সেখানে ধর্মঘট লেগেই থাকত।

এশতাহেয়ের পূর্বসূরি রামি হামদাল্লাহ ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ। তবে তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। পরামর্শকেরা বলেন, নাবলুসের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের কর্মকাণ্ড চালাতেন তিনি। সেখানেই বিকেলটাও কাটাতেন।

এশতায়েহে ও রামি হামদাল্লাহ ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে অজনপ্রিয় থেকেই তাঁদের মেয়াদ পার করেছেন। অবশ্য তাঁদের বলির পাঠাও বলা যেতে পারে। আসলে প্রকৃত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ও প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন উপদেষ্টার হাতে। এর মধ্যে রয়েছে আব্বাসের গোয়েন্দা প্রধান মজিদ ফারাজ ও উপদেষ্টা হুসেইন আল-শেখ। আব্বাসের উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট হিসেবে হুসেইন আল-শেখের নামটি এখন সামনে আসছে। তবে নতুন সরকার এলে কী পরিবর্তন আসবে, তার কোনো ইঙ্গিত এখন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না।

ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের কাছে নিজের পদত্যাগপত্র হস্তান্তর করছেন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ এশতায়েহে (বাঁয়ে)। রামাল্লা, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪
ফাইল ছবি: এএফপি

নতুন সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি চ্যালেঞ্জের নাম ইসরায়েল। পরবর্তী ফিলিস্তিনি প্রধানমন্ত্রীর জন্য অর্থ ও ক্ষমতার চেয়ে বেশি জরুরি ইসরায়েলের আগ্রাসন থামানো। ১৯৬৭ সালের পর থেকে ফিলিস্তিনে আগ্রাসন চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। এই আগ্রাসন বন্ধ না হলে অধিকাংশ ফিলিস্তিনবাসীকে একটি অপেক্ষমাণ রাষ্ট্র হিসেবেই দেখে যেতে হবে, যা কখনো রাষ্ট্রের রূপ নিতে পারেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কাছে গাজায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের শাসন পুনর্বহালের প্রতিশ্রুতি দিতে আহ্বান জানানো হয়েছে। ২০০৭ সালে হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আগপর্যন্ত সেখানে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের শাসন ছিল। এ ছাড়া দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের জন্য যুদ্ধ-পরবর্তী কূটনীতি চালিয়ে যেতে বলেছে। কয়েক মাস ধরে এ নিয়ে কথা বলতে রাজি ছিলেন না নেতানিয়াহু। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২২ ফেব্রুয়ারি নেতানিয়াহু তাঁর যুদ্ধ-পরবর্তী পরিকল্পনা সামনে আনেন।

নেতানিয়াহুর প্রস্তাবকে পরিকল্পনার চেয়ে অস্পষ্ট বা উন্মুক্ত লক্ষ্য হিসেবেও তুলে ধরা যায়। এতে গাজায় ইসরায়েলের ইচ্ছেমতো সীমাহীন কার্যক্রম চালানোর কথা বলা হয়েছে। গাজা থেকে সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহারের পরিকল্পনার পরিবর্তে সেখানে দীর্ঘ মেয়াদে সেনা রাখার কৌশল নিয়েছেন নেতানিয়াহু। তাঁর পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ভূমিকার উল্লেখ নেই। সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে এমন সত্তার ভূমিকাও বাতিল করা হয়েছে। এ পরিকল্পনায় দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের কোনো সমর্থনের কথাও উল্লেখ করা হয়নি।

নেতানিয়াহুর এ পরিকল্পনা এখনো মন্ত্রিসভায় আলোচনা ও অনুমোদন হয়নি। তবে এটি  নেতানিয়াহুর জোটের উগ্র ডানপন্থী দলগুলোকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটাই যদি ইসরায়েলের কৌশল হয়, তবে তা তাদের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে।

নতুন সরকার যে রূপই ধরুক না কেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের যে সংস্কার এবং পুনরুজ্জীবিত করার দাবি করেছে, তা সম্ভবত অনেক দূরে। তবে পশ্চিমা একজন কূটনীতিক মনে করছেন, মাহমুদ আব্বাস সবাইকে ছাপিয়ে যেতে পারেন। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের বিদেশি সমর্থকেরা সেখানে সহায়তা পাঠানোর চাপে রয়েছেন।

ওই কূটনীতিক বলেছেন, ‘আমরা বলেছি সরকার পুনর্গঠন করো, তবে আমরা তোমাদের প্রয়োজনীয় সমর্থন দেব। মাহমুদ আব্বাস এখন দাবি করতে পারেন, তিনি সরকার পুনর্গঠন করেছেন, এখন সহায়তা জোরদার করুন। প্রথমে ট্র্যাজেডি, পরে প্রহসন। পশ্চিমা দাতাদের শান্ত করতে তাঁকে ক্ষমতায় আনার দুই দশক পর মাহমুদ আব্বাসকে এখন নিজের ক্ষমতাকেই দুর্বল করতে হচ্ছে।

অনুবাদ: মো. মিন্টু হোসেন