ইরানে হামলা চালাতে কতটা সক্ষম ইসরায়েল
গতকাল শুক্রবার ভোররাতে ইরানের মধ্যাঞ্চলীয় প্রদেশ ইস্পাহানের রাজধানী শহর ইস্পাহানে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে তিনটি ড্রোন ভূপাতিত করে দেশটির সামরিক বাহিনী। এ ঘটনা তদন্ত করছে ইরানের কর্তৃপক্ষ। তদন্তের ফলাফল এখনো জানা যায়নি। কিন্ত যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ইরানের এ হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। তবে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এ ঘটনা নিয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
সামরিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকদের মতে, ইরানের ভূখণ্ডে ইসরায়েলের হামলা মানে বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাতের নতুন একটি পর্বের সূচনা। ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের দূতাবাসে হামলায় ইরানের শীর্ষস্থানীয় একাধিক সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে এ সংঘাতের সূত্রপাত। এ হামলা ইসরায়েল করেছে বলে দাবি করে আসছে ইরান। তবে ইসরায়েল কিছু বলেনি।
এরপর ১৩ এপ্রিল রাতে ইসরায়েলের বিভিন্ন অঞ্চল নিশানা করে ৩৩১টি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান। তেহরানের এ হামলা ছিল খুবই পূর্বপরিকল্পিত। এর মাধ্যমে ইরান আশঙ্কা করেছিল পাল্টা হামলা চালাবে ইসরায়েল। কথা হলো ইসরায়েল যদি ইরানের ভূখণ্ডে হামলা চালায়, তাহলে কীভাবে এ হামলা করবে তারা।
কয়েক দশক ধরে ইরানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা করে আসছে ইসরায়েল। কিন্ত ইসরায়েলকে হামলা করতে হবে সীমিত পরিসরে, যার প্রভাব হবে কম। ইরানের এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ইসরায়েলের হামলা করা ঠিক হবে না, যাতে ইরান থেকে এর পাল্টা জবাব আসে এবং দুই পক্ষ সর্বাত্মক একটি সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে ইসরায়েলের সম্ভাব্য উপায় কেমন হবে, অর্থাৎ কোথায় ও কীভাবে হামলা চালাবে তারা?
বিমান হামলা
সবচেয়ে নিকটবর্তী সীমান্ত থেকেও ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে দূরত্ব ৯০০ কিলোমিটারের বেশি। আর ইরানের বেশির ভাগ সামরিক ঘাঁটি ও পারমাণবিক স্থাপনা ইসরায়েলের সীমান্ত থেকে দুই হাজার কিলোমিটারের বেশি দূরে। ফলে ইরানের ভূখণ্ডে ইসরায়েলকে হামলা করতে হলে এফ-১৫ ও এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান দিয়ে হামলা চালাতে হবে। এসব যুদ্ধবিমান প্রতিপক্ষের রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম।
যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এসব যুদ্ধবিমান মূলত দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার জন্য বিশেষভাবে তৈরি। কিন্ত সীমান্তবর্তী ইরানের স্থাপনায় হামলা চালানোর জন্য সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথে যেতে না পারলে এসব যুদ্ধবিমানকেও যাত্রাপথে আবার জ্বালানি নিতে হবে। আর এ পথে যেতে হলেও বিশেষ কৌশলের আশ্রয় নিতে হবে ইসরায়েলকে।
ইরানে হামলা করার জন্য সৌদি আরব ও জর্ডান তাদের আকাশসীমা ইসরায়েলকে ব্যবহার করতে দেবে না। কারণ, এটা করলে রিয়াদ ও আম্মানের সম্ভাব্য সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। একই সঙ্গে ইসরায়েলকে এ সুযোগ দিলে দেশের মধ্যেও তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হতে পারে দেশ দুটিকে। কারণ, গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা নিয়ে এসব দেশের মানুষ খুবই ক্ষুব্ধ।
ইসরায়েলের হাতে থাকা আরেকটা উপায় হচ্ছে লোহিত সাগর এবং ইয়েমেন ও ওমানের আকাশসীমা দিয়ে যুদ্ধবিমানের মাধ্যমে ইরানের দক্ষিণাঞ্চলে হামলা চালানো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ইরানের উপকূলে পৌঁছাতে ইসরায়েলের যুদ্ধবিমানকে ৪ হাজার ৭০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে।
ইরানের উত্তরাঞ্চলে ইসরায়েল যদি হামলা করতে চায়, তাহলে এর জন্য সহজ পথ হবে সিরিয়া ও ইরাকের আকাশসীমা দিয়ে ইরানে যুদ্ধবিমান পাঠানো। এ ক্ষেত্রে কারিগরি গোলযোগ ও সাইবার হামলা করে সিরিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে হবে ইসরায়েলের বিমানবাহিনীকে। ২০০৭ সালে এভাবে সিরিয়ায় হামলা করেছিল ইসরায়েল। তখন ইসরায়েল দাবি করেছিল, সিরিয়ায় একটি পারমাণবিক চুল্লি ধ্বংস করেছে তারা। এ হামলার আগে সিরিয়ায় আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার বেশির ভাগ রাডার অচল করে দিয়েছিল ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী।
তবে এ ধরনের কৌশল শুধু কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ব্যবহার করা হয়। যেমন বড় ধরনের কোনো বিমান হামলা অথবা কোনো সংঘাতের শুরুর দিকে প্রতিপক্ষের মনে ভীতি ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। ইসরায়েল যদিও এটা করার সক্ষমতা রাখে, কিন্তু এভাবে হামলা করে নিজেদের অবস্থান জানানো এবং এ ধরনের বড় হামলা চালানোর সক্ষমতার বিষয়টি উন্মোচন করতে চাইবে না তারা।
এ ক্ষেত্রে ইসরায়েলের জন্য আরেকটি উপায় হতে পারে যুদ্ধবিমানে বাড়তি জ্বালানি ট্যাংক যুক্ত করা। এটি করা হলে যুদ্ধবিমানের পথ পাড়ি দেওয়ার সক্ষমতা অনেকটাই বেড়ে যায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আবার প্রতিপক্ষের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার রাডারে যুদ্ধবিমানের ধরা পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ইসরায়েলের তৈরি এমন কিছু জ্বালানি ট্যাংক রয়েছে, যেগুলো এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের জন্য লাগসই। আর বাড়তি এই জ্বালানি ট্যাংক ব্যবহারের পরও এসব যুদ্ধবিমানের রাডার ফাঁকি দেওয়ার সক্ষমতা একেবারে ‘নাই’ হয়ে যায় না। একই সঙ্গে প্রতিপক্ষের রাডার থেকে অদৃশ্য হয়েও হামলা চালানোর সক্ষমতা রয়ে যায়।
কিন্তু এ ধরনের কৌশলও অনেক জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ। যদি ইরানের রাডারে ধরা পড়ে, তাহলে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের পরিণতি হবে ভূপাতিত হওয়া। কিন্তু এমন দুর্বল বার্তা দিতে চাইবে না ইসরায়েল।
নৌপথে হামলা
ইসরায়েলের কাছে আছে ডলফিন শ্রেণির পাঁচটি সাবমেরিন (ডুবোজাহাজ)। জার্মানির তৈরি ডিজেল ও বিদ্যুত–চালিত এসব সাবমেরিন চলে নীরবে; নৌপথে অভিযান চালানোর জন্য যা আদর্শ।
ইসরায়েলের জন্য তৈরি সর্বশেষ দুটি সাবমেরিনে রয়েছে এআইপি বা এয়ার ইনডিপেনডেন্ট প্রোপালশন ব্যবস্থা। এআইপি থাকা মানে এসব সাবমেরিন কয়েক সপ্তাহ ধরে ডুবন্ত অবস্থায় থাকতে পারে।
ইসরায়েল যদি নৌপথে হামলা চালায়, তাহলে তাদের প্রথম নিশানা হতে পারে বেহশাদ। এটি হলো ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) একটি যুদ্ধজাহাজ। এই যুদ্ধজাহাজ মূলত গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের কাজ করে থাকে। তিন বছর ধরে এ জাহাজ সাগরে আছে। সর্বশেষ পাওয়া তথ্যানুযায়ী বাব আল–মান্দেব প্রণালির অদূরে লোহিত সাগরে ছিল যুদ্ধজাহাজটির অবস্থান।
ডলফিন শ্রেণির সাবমেরিনে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যেগুলো ২০০ থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। ডুবন্ত অবস্থায় সাবমেরিন থেকে এসব ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া যায়।
আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা থেকে ইরানের উপকূলবর্তী বিভিন্ন স্থাপনায় ইসরায়েলের পক্ষে হামলা করাটা বেশ সহজ হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও এ ধরনের হামলা চালানোর জন্য বড় কোনো নিশানা থাকতে হবে ইসরায়েলের। তবে এমনটা করলে পাল্টা হামলার মুখোমুখি হওয়ার সক্ষমতা আছে কি না, সেটি ভেবে দেখতে হবে। কারণ, এতে বড় ধরনের সামরিক সংঘাত শুরু হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
এই দুটি ছাড়া অন্য কোনো সামরিক পদক্ষেপ, যেমন বিশেষ অভিযান চালাতে সক্ষম, এমন ইসরায়েলি সৈন্যদের ব্যবহার করা। অর্থাৎ ইরানের মাটিতে ইসরায়েলের সেনাদের পাঠিয়ে দেশটিতে হামলা চালানো। কিন্তু এটা করতে গেলেও ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে বড় ধরনের সংঘাত শুরু হবে। ইসরায়েল যেটা কখনো চাইবে না।
সবচেয়ে বড় কথা হলো ইসরায়েল ইরানের সঙ্গে সর্বাত্মক কোনো যুদ্ধে জড়াতে চায় কি না। কারণ, ইতিমধ্যে ইসরায়েলকে এখনই দুই দিকে লড়তে হচ্ছে। এর মধ্যে একটি হলো ফিলিস্তিনের গাজা। অন্যটি লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ।