সিএনএনের অনুসন্ধান
গাজার ত্রাণপ্রত্যাশীদের গুলি করে বুলডোজার দিয়ে মাটিচাপা দিয়েছে ইসরায়েল
ফিলিস্তিনের গাজায় গত জুনে জিকিম ক্রসিংয়ের কাছে ত্রাণবাহী ট্রাক থেকে পরিবারের জন্য এক ব্যাগ আটা আনতে গিয়েছিলেন আম্মার ওয়াদি। তিনি জানতেন, এর মাধ্যমে তিনি নিজের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলছেন।
ওয়াদি তাঁর মোবাইলের স্ক্রিনে ‘মা, আমার কিছু হয়ে গেলে আমাকে ক্ষমা করো। যে আমার ফোনটি পাবেন, তিনি যেন আমার পরিবারকে বলে দেন, আমি তাদের খুব ভালোবাসি’—লিখে রেখেছিলেন।
গ্রীষ্মের ওই সময় ত্রাণ আনতে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনী নিয়মিতভাবে গুলিবর্ষণ করত। এর মধ্যেই একদিন ত্রাণ আনতে যান ওয়াদি। কিন্তু এরপর আর বাড়ি ফেরা হয়নি। কয়েক সপ্তাহ পর এক ব্যক্তি ওয়াদির মোবাইল ফোন পেয়ে তাঁর পরিবারের কাছে পৌঁছে দেন। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তাঁর কাছ থেকে পাওয়া শেষ বার্তাটি পায় পরিবার।
তখন অসংখ্য ফিলিস্তিনি জিকিমের কাছে নিখোঁজ হন। ওয়াদি ছিলেন তাঁদের একজন। এসব ফিলিস্তিনির ভাগ্যে কী জুটেছে, তা আজও অজানা।
তবে ওই ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তার কিছুটা আঁচ পাওয়া গেছে সিএনএনের এক অনুসন্ধানে। তাতে দেখা গেছে, ইসরায়েলি সেনারা জিকিম ক্রসিংয়ের কাছে কিছু ব্যক্তির মরদেহ বুলডোজার দিয়ে মাটিচাপা দিয়েছেন। তাঁদের এভাবে কবর দেওয়ার চিহ্নও রাখা হয়নি। এ ছাড়া কিছু মরদেহ সে সময় খোলা মাঠে ফেলে রাখা হয়। বিকৃত হয়ে যাওয়ায় সেগুলোও আর উদ্ধার করা যায়নি।
আইনবিশেষজ্ঞদের মতে, বুলডোজার দিয়ে অচিহ্নিত কবরে মরদেহ চাপা দেওয়া আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হতে পারে।
অসংখ্য ফিলিস্তিনি জিকিমের কাছে নিখোঁজ হন। ওয়াদি তাঁদের একজন। এসব ফিলিস্তিনির ভাগ্যে কী জুটেছে, আজও অজানা।
সিএনএনের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ক্রসিংয়ের কাছে থাকা ত্রাণপ্রত্যাশীরা ইসরায়েলি সেনাদের নির্বিচার ছোড়া গুলিতে নিহত হয়েছেন। জিকিমের আশপাশের শত শত ছবি ও ভিডিও এবং প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় ত্রাণবাহী ট্রাকের চালকদের সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে এ পর্যালোচনা করা হয়েছে।
কৃত্রিম উপগ্রহের ছবিতেও ত্রাণপ্রত্যাশীরা যে এলাকায় নিহত হয়েছেন, সেখানে বুলডোজারের তৎপরতা চোখে পড়েছে।
ইসরায়েলের দুজন সাবেক সেনাসদস্যের সঙ্গে কথা বলেছে সিএনএন। তাঁরা যুদ্ধের সময় গাজার অন্যত্র ঘটে যাওয়া এমন সব ঘটনা বর্ণনা করেছেন, যেখানে ফিলিস্তিনিদের মরদেহ অগভীর কবরের মধ্যে বুলডোজারের মাধ্যমে চাপা দেওয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে কথা বলার অনুমতি না থাকায় তাঁরা নাম–পরিচয় গোপন রাখতে চেয়েছেন।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) মরদেহ সরাতে বুলডোজার ব্যবহারের কথা অস্বীকার করেছে। তবে মাটিচাপা দেওয়ার সময় বুলডোজার ব্যবহার করা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে তারা কোনো মন্তব্য করেনি।
সেখানকার দৃশ্য দেখে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। যে মরদেহ উদ্ধার করেছি, তা পচে গেছে। মরদেহগুলো অনেক দিন পড়ে ছিল।
আইডিএফ সিএনএনকে জানিয়েছে, জিকিমের আশপাশে বুলডোজারের উপস্থিতি ‘নিয়মিত কার্যক্রমের’ অংশ ছিল, যা বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হতো।
‘অক্সফোর্ড ইনস্টিটিউট ফর এথিকস, ল অ্যান্ড আর্মড কনফ্লিক্ট’–এর সহপরিচালক জেনিনা ডিল বলেছেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, যুদ্ধে বিবদমান পক্ষগুলোকে মরদেহ এমনভাবে কবর দেওয়ার জন্য সহযোগিতা করা উচিত, যাতে সেগুলো শনাক্ত করা যায়।
ডিল আরও বলেন, মরদেহ নিখোঁজ হওয়া ঠেকানো এবং পরিবারের সদস্যরা যাতে তাঁদের স্মরণ করতে পারেন, সেটিই এ আইনের উদ্দেশ্য। এ ছাড়া মরদেহ বিকৃত কিংবা এর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হলে তা ‘ব্যক্তিগত মর্যাদার লঙ্ঘন’ হিসেবে গণ্য হতে পারে। এটি জেনেভা চুক্তির আওতায় যুদ্ধাপরাধ।
আইডিএফ মরদেহগুলো যেখানে চাপা দিয়েছে, সেখানে কোনো চিহ্ন রেখেছে কি না, এখনো তা একটি প্রশ্ন হিসেবে রয়ে গেছে। তবে আইডিএফের গোপন তথ্য ফাঁস করা সাবেক একজন সদস্য সিএনএনকে জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের শুরুর দিকে তাঁর ইউনিট নয়জনকে কবর দিয়েছিল কোনো চিহ্ন না রেখেই। আইডিএফ এ বিষয়ে সিএনএনের প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয়নি।
ওয়াদি নিখোঁজ হওয়ার প্রায় ছয় মাস পার হয়ে গেছে। তিনি কোথায় আছেন, তাঁর পরিবার এখনো সেই উত্তর পায়নি।
গত ১১ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুটি ভিডিও প্রকাশিত হয়। সেখানে দেখা গেছে, অনবরত গুলিবর্ষণের মধ্যে ফিলিস্তিনিরা দল বেঁধে জিকিম এলাকা থেকে পালাচ্ছেন।
‘এটা বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মতো’
১১ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুটি ভিডিও প্রকাশিত হয়। সিএনএন ভিডিও দুটি পর্যালোচনা করে ঘটনাস্থল জিকিম এলাকার বলে শনাক্ত করেছে। সেখানে দেখা গেছে, অনবরত গুলিবর্ষণের মধ্যে ফিলিস্তিনিরা দল বেঁধে এলাকা থেকে পালাচ্ছেন। এ সময় তাঁরা আটার বস্তা বহন করছিলেন।
ভিডিওতে অন্তত একজন আটা বহনকারীকে পেছন থেকে গুলি করতে দেখা যায়। দৃশ্যত, আইডিএফের একটি অবস্থান থেকে ওই গুলি করা হয়। কৃত্রিম উপগ্রহের চিত্রের মাধ্যমে সিএনএন এটি শনাক্ত করেছে।
মনটানা স্টেট ইউনিভার্সিটির অডিও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ রবার্ট মাহের সিএনএনের জন্য ভিডিওগুলো বিশ্লেষণ করেছেন। এতে দেখা গেছে, যে স্থান থেকে ভিডিও করা হয়েছে, তার প্রায় ৩৪০ মিটার (১ হাজার ১১৫ ফুট) দূর থেকে গুলির শব্দ এসেছে, যা আইডিএফের অবস্থানের সঙ্গে মিলে যায়।
দুজন প্রত্যক্ষদর্শী গত ১৫ জুন সিএনএনকে জানান, ক্রসিং থেকে যাওয়া একটি ত্রাণবাহী ট্রাকের চারপাশ ঘিরে ছিল ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের একটি দল।
কিছুক্ষণের মধ্যে ইসরায়েলি সেনারা ট্রাক লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, গুলিতে অনেক ত্রাণপ্রত্যাশী আহত হয়ে ট্রাকের নিচে পড়ে যান।
এ ঘটনার বেশ কিছু দিন পর গাজার জরুরি পরিষেবা বিভাগের কর্মীদের পরিচালিত একটি অ্যাম্বুলেন্সকে ওই এলাকায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মী সিএনএনকে বলেন, ‘সেখানকার দৃশ্য দেখে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমরা যেসব মরদেহ উদ্ধার করেছি, সেসব পচে গেছে। মরদেহগুলো সেখানে অনেক দিন পড়ে ছিল। মরদেহের কিছু অংশে কুকুরের খাওয়ার চিহ্নও চোখে পড়েছিল।’
এটা যেন বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। ওই এলাকায় কী হচ্ছে, কেউ জানে না। মনে হচ্ছে, মানুষ কখনোই তা জানতে পারবে না।
জিকিম রুটে কাজ করা অন্তত ছয়টি ত্রাণবাহী ট্রাকের চালকদের সঙ্গে সিএনএন কথা বলেছে। নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেছেন, পচে যাওয়া মরদেহ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকার দৃশ্য সেখানকার স্বাভাবিক ঘটনা। কখনো কখনো ইসরায়েলি বুলডোজার মরদেহগুলো বালুর মধ্যে চাপা দেয়।
কৃত্রিম উপগ্রহের চিত্র ও বিভিন্ন ছবির সঙ্গে ওই ট্রাকচালকদের বক্তব্যের মিল রয়েছে। ছবিতে জুলাই মাসের শেষ থেকে আগস্টের শুরু পর্যন্ত সেখানে ইসরায়েলি বুলডোজার দেখা গেছে। জুনের মাঝামাঝি সময়ে ত্রাণের রুট খোলার পর জিকিম ক্রসিংয়ের চারপাশে বুলডোজারের চিহ্ন স্পষ্ট দেখা গেছে। ১২ সেপ্টেম্বর ত্রাণ তৎপরতা বন্ধ হওয়ার আগপর্যন্ত এ চিহ্ন ছিল।
দুজন প্রত্যক্ষদর্শী সিএনএনকে বলেন, নিখোঁজ স্বজনদের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় কি না, তা খুঁজতে ৭ সেপ্টেম্বর জিকিমের আশপাশে যান ফিলিস্তিনিরা। তখন তাঁরা এমন কিছু দেখেন, যা বুলডোজারের মাধ্যমে চাপা দেওয়া মরদেহের মতো মনে হয়েছে।
১৭ বছর বয়সী ছেলেকে খুঁজতে গিয়েছিলেন আদিল মনসুরও। তিনি বলেন, ‘আমি সেখানে অনেক মরদেহ দেখি, যেগুলো (ত্রাণের) বাক্সের সঙ্গে বুলডোজার দিয়ে চাপা দেওয়া হয়েছে…। একটির ওপর আরেকটি স্তূপ করে রাখা হয়েছিল।’
জিকিম রুটে কাজ করা একটি ত্রাণবাহী ট্রাকের চালক সিএনএনকে বলেন, ‘এটা যেন বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। ওই এলাকায় কী হচ্ছে, কেউ জানে না। মনে হচ্ছে, মানুষ কখনোই তা জানতে পারবে না।’
আইডিএফের তথ্য ফাঁসকারীদের বক্তব্য
আইডিএফের একাধিক সদস্য ও দখলদারবিরোধী বিশিষ্ট নাগরিকদের সংগঠন ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’ গাজায় বুলডোজার দিয়ে মরদেহ কবর দেওয়ার বিষয় নিশ্চিত করেছেন। তথ্য ফাঁসকারী আইডিএফ সদস্যদের একজন আগে নেতজারিম করিডরের একটি সামরিক চৌকিতে দায়িত্ব পালন করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই সদস্য সিএনএনকে বলেন, ২০২৪ সালের শুরুর দিকে তাঁর ঘাঁটির আশপাশে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের নয়টি মরদেহ প্রায় দুই দিন ধরে পড়ে ছিল। এতে ওই এলাকায় ব্যাপক দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। আশপাশের কুকুরগুলো মরদেহের কাছে ঘোরাঘুরি করছিল।
ওই আইডিএফ সদস্য বলেন, ‘আমাদের কমান্ডার ডি-৯, অর্থাৎ বুলডোজারগুলোকে এসব মরদেহ বালুচাপা দিতে নির্দেশ দেন। চারপাশে এত নিরস্ত্র মানুষের মরদেহ দেখা ছিল, ভয়ানক ব্যাপার। কুকুরগুলো মরদেহের অবশিষ্টাংশ নিয়ে খেলছিল।’
সাবেক এই সদস্যদের দেওয়া বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে আইডিএফ কিছু বলতে রাজি হয়নি। ফিলিস্তিনিদের গণকবর দেওয়ার বিষয়টি সব সময়ই অস্বীকার করে আসছে।
গত দুই বছরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজার বিভিন্ন স্থানে অনেকবার ফিলিস্তিনিদের মরদেহ অচিহ্নিত, অগভীর মাটিতে চাপা কিংবা গণকবর দিয়েছে। এর মধ্যে গত বছর খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে উদ্ধার হওয়া শত শত ফিলিস্তিনির মরদেহও রয়েছে বলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। এ ছাড়া গত মার্চে গাজার দক্ষিণে ১৫ ত্রাণকর্মী নিহত হওয়ার ঘটনাও এভাবে ধামাচাপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
খাবার আনতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়া অসংখ্য ফিলিস্তিনির এখনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাঁদের পরিবারগুলো এখনো হারানো স্বজনদের খুঁজতে মরিয়া। প্রিয়জনেরা আশাবাদী, হয়তো তাঁরা কোথাও না কোথাও বেঁচে আছেন। হতে পারে ইসরায়েলি আটককেন্দ্রে কিংবা বাস্তুচ্যুত হয়ে গাজার কোথাও।
আম্মার ওয়াদির ভাই হোসাম বলেন, ‘আম্মারের অনুপস্থিতি আমাদের জীবনে বিশাল শূন্যতা তৈরি করেছে। তাঁকে হারানো মানে, নিজের একটি অংশ হারানো। যদি তিনি শহীদ হয়ে থাকেন, আল্লাহ যেন তাঁর প্রতি দয়া করেন। আর যদি বেঁচে থাকেন, তাহলে আমাদের অন্তত হাতে আঁকড়ে ধরার মতো এতটুকু আশা থাকবে।’