হামলার মধ্যেই গাজায় যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ শুরুর পরিকল্পনা
ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ শুরুর জন্য তৎপরতা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের। যদিও যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের শর্ত অনুযায়ী গাজায় হামলা এখনো পুরোপুরি থামায়নি ইসরায়েল। ইসরায়েলি বাহিনীর আগ্রাসনে প্রায়ই উপত্যকাটিতে ফিলিস্তিনিদের প্রাণহানি হচ্ছে।
দ্বিতীয় ধাপের যুদ্ধবিরতি শুরুর পরিকল্পনার তথ্য টাইমস অব ইসরায়েলকে নিশ্চিত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেছেন, দ্বিতীয় ধাপে সংঘাত-পরবর্তী গাজা পরিচালনার জন্য একটি শাসনব্যবস্থা ও নিরাপত্তাকাঠামো গঠন করা হবে। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে কারা বা কোন কোন দেশ যুক্ত থাকবে, তা সময় হলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই ঘোষণা করবেন।
যুদ্ধবিরতির নতুন ধাপ শুরুর জন্য মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসন চূড়ান্ত পর্যায়ের আলোচনা করছে বলে জানিয়েছেন মার্কিন ওই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ওই আলোচনার মাধ্যমে চলতি বছরের শেষের আগে যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ শুরুর সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে আলোচনায় বাধা এলে তা বাস্তবায়নে দেরিও হতে পারে।
দুই মাসে নিহত ৩৬৬
ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ১০ অক্টোবর গাজায় প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি শুরু হয়। যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী, হামাসের কাছে বন্দী জীবিত ২০ জনের সবাইকে ইসরায়েলের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। একজন বাদে মৃত ২৭ বন্দীর সবার মরদেহও ফেরত পেয়েছে তারা। বিনিময়ে ইসরায়েল থেকে মুক্তি পেয়েছেন কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি। গাজায় নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত সেনাসদস্যদেরও পিছিয়ে এনেছে ইসরায়েল।
গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের একটি শর্ত ছিল উপত্যকাটিতে হামলা বন্ধ করবে ইসরায়েল। তবে যুদ্ধবিরতির পরও সেখানে অন্তত ৩৬৬ জনকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। আহত হয়েছেন ৯০০ জনের বেশি। এর মধ্যে সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার উত্তর গাজায় এক নারীকে হত্যা করা হয়। আগের দিন দক্ষিণে খান ইউনিসে একটি তাঁবুকে বিমান হামলা চালালে নিহত হন পাঁচ ফিলিস্তিনি।
গাজায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে যুদ্ধবিরতি সময় ইসরায়েলের হামলা নিয়ে একটি ইনফোগ্রাফ প্রকাশ করেছে আল-জাজিরা। তাতে দেখা গেছে, যুদ্ধবিরতি শুরুর মাত্র ৯ দিনের মাথায় ১৯ অক্টোবর গাজায় হামলা চালিয়ে ৪৫ জনকে হত্যা করেছিল ইসরায়েল। এরপর ২৯ অক্টোবর ৫২ শিশুসহ হত্যা করা হয় ১০৯ জনকে। সবশেষ বড় হত্যাকাণ্ড হয় ২২ নভেম্বর। সেদিন ইসরায়েলের হামলায় প্রাণহানি হয়েছিল ২১ জনের বেশি ফিলিস্তিনির।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। ওই হামলায় ইসরায়েলে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। সেখান থেকে বন্দী করে গাজায় নিয়ে আসা হয় প্রায় আড়াই শ জনকে। ওই দিন থেকেই গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। গাজা কর্তৃপক্ষের হিসাবে, হামলায় এখন পর্যন্ত উপত্যকাটিতে ৭০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
আলোচনায় কিছু বাধা
যুক্তরাষ্ট্রের ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা অনুযায়ী—প্রথম ধাপের পর হামাসকে গাজার শাসনক্ষমতা ছাড়তে হবে। একই সঙ্গে অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে সংগঠনটিকে। তবে হামাস অস্ত্র সমর্পণ করতে রাজি নয়। আর গাজায় যে অন্তর্বর্তী প্রশাসনের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে বিদেশিদের উপস্থিতি মেনে নেবে না তারা। এই সরকারে শুধুই ফিলিস্তিনিদের চায় হামাস।
এই দুই বিষয়ে হামাসকে রাজি করানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতার, মিসর ও তুরস্ক। সংগঠনটিকে দেওয়া এক প্রস্তাবে তারা বলেছে, প্রথমে তাদের যোদ্ধারা রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্রের মতো ভারী অস্ত্র ত্যাগ করবে। পরে হালকা অস্ত্র সমর্পণ করবে। মার্কিন ওই কর্মকর্তার মতে, হামাস অস্ত্র সমর্পণের পরই কেবল গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে চাইছে ইসরায়েল।
বিষয়টি নিয়ে হামাস ও ইসরায়েলের সঙ্গে মধ্যস্থতাকারীরা একটি সমঝোতায় পৌঁছালে ২০২৬ সালের শুরুর দিকে গাজায় আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েন করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওই কর্মকর্তা। এরই মধ্যে এই বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আগ্রহ দেখিয়েছে ইন্দোনেশিয়া ও আজারবাইজান। তুরস্কও একই আগ্রহ দেখালে তা নাকচ করে দিয়েছিল ইসরায়েল।
তবে আন্তর্জাতিক বাহিনীতে তুরস্কের উপস্থিতিটা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে বলে টাইমস অব ইসরায়েলকে জানিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের একজন কর্মকর্তা। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেছেন, তুরস্ক এই যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোর একটি। তাই আন্তর্জাতিক বাহিনীতে তুরস্কের সেনাসদস্যরা যোগ দিলে তাঁদের ওপর হামাস সদস্যদের গুলি চালানোর আশঙ্কা অনেক কম। সংঘাত-পরবর্তী গাজা পরিচালনায় তুরস্ককে যুক্ত করার জন্য ইসরায়েলকে চাপ দিচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসনও।
গাজায় অন্তর্বর্তী সরকার
যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপে গাজায় ত্রাণ সরবরাহ এবং হামাসকে অস্ত্রমুক্ত করার দায়িত্বে থাকবে একটি কমিটি বা অন্তর্বর্তী সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা অনুযায়ী, সেখানে ফিলিস্তিনি অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা (টেকনোক্র্যাট) থাকলেও হামাসের কেউ থাকতে পারবেন না। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ওই কমিটির ১২ থেকে ১৫ জনের নাম বেছে নেওয়ার কথা রয়েছে ট্রাম্পের।
এই কমিটি আবার থাকবে একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনা বোর্ডের অধীনে। সেখানে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ ও জামাতা জ্যারেড কুশনারের থাকার কথা রয়েছে। এর ওপর নজরদারি করবে ‘বোর্ড অব পিস’। যুক্তরাষ্ট্রের ওই কর্মকর্তা বলেন, ট্রাম্পের নেতৃত্বে বোর্ড অব পিসে সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান থাকতে পারেন।
ওই কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, গাজায় আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনা বোর্ড গঠনের পর ইসরায়েলের হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া উপত্যকাটি পুনর্গঠনের কাজ শুরু হবে। গাজায় বর্তমানে ইসরায়েলি সেনা নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোয় পুনর্গঠন শুরু করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এর ফলে ওই এলাকাগুলোয় আরও দীর্ঘ সময় ধরে ইসরায়েলি সেনারা অবস্থান করতে পারেন বলে আপত্তি জানিয়েছে আরব দেশগুলো।