গাজায় ইসরায়েলের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের প্রভাব কী হতে পারে

গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চলীয় বেই লাহিয়ায় খাবারের জন্য বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি শিশুদের অপেক্ষাছবি: এএফপি ফাইল ছবি

ইসরায়েল ঘোষণা দিয়েছে, তারা গাজা উপত্যকায় বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এতে গাজায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এটিকে জানুয়ারিতে সম্মত যুদ্ধবিরতির শর্তগুলো সংশোধনে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসকে চাপ দিতে ইসরায়েলের আরেকটি চেষ্টা বলে মনে করা হচ্ছে।

যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের মেয়াদ বাড়াতে এবং আরও বন্দীকে মুক্তি দিতে হামাসকে চাপ দিতে মার্চ মাসের শুরুর দিকে গাজায় মানবিক সহায়তা সরবরাহের ওপর অবরোধ আরোপ করে ইসরায়েল। দ্বিতীয় ধাপের যুদ্ধবিরতি এড়াতে তারা এমন পদক্ষেপ নিচ্ছে। দ্বিতীয় ধাপের যুদ্ধবিরতি হলে গাজায় যুদ্ধের স্থায়ী অবসান হতে পারে।

মানবিক সহায়তা সংস্থা, মানবাধিকার সংস্থা, ইসরায়েলের কিছু মিত্রদেশসহ বিভিন্ন দেশ এ সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছে।

আরও পড়ুন

ইসরায়েলের ঘোষণাটি আসলে কী ছিল

ইসরায়েল বলেছে, তারা গাজায় যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে, তার পুরোটাই বন্ধ করে দেবে।

গত রোববার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া পোস্টে ইসরায়েলি জ্বালানিমন্ত্রী এলি কোহেন বলেন, তিনি ‘তাৎক্ষণিকভাবে গাজা উপত্যকার বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন’।

দোহায় আরেকটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে আলোচনার আগের দিন কোহেন বলেছিলেন, ‘কথা তো যথেষ্ট হলো, এখন পদক্ষেপ নেওয়ার সময়!’

তবে ইসরায়েলি গণমাধ্যম বলছে, ঘোষণাটিকে যতটা নাটকীয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, এটি সম্ভবত অতটা নয়।

যুদ্ধে গাজার বেশির ভাগ এলাকাই এমন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

তার মানে কি গাজা অন্ধকার হবে না

এমনিতেই গাজা অন্ধকারের মধ্যে আছে। টাইমস অব ইসরায়েলের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের হামলাকে কেন্দ্র করে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

গত নভেম্বরে গাজার মধ্যাঞ্চলীয় দেইর এল বালাহর কাছে একটি লবণাক্ত পানির পরিশোধনকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল করা হয়েছিল। পরিশোধনাগারটি থেকে প্রায় ছয় লাখ মানুষের পানির ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। এসব মানুষের বেশির ভাগই গাজার মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের বাস্তুচ্যুত বেসামরিক নাগরিক।

এখন শোধনাগারটিকে সঞ্চিত বিদ্যুৎ, জেনারেটর এবং ইসরায়েলি গোলাবর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস না হওয়া সৌরপ্যানেলের অবশিষ্টাংশের ওপর নির্ভর করে চলতে হবে।

ইসরায়েল কি শুধু বিদ্যুৎ ও ত্রাণ সরবরাহই বন্ধ করছে

না। জানুয়ারিতে স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্তগুলো সংশোধন করার চেষ্টায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজা উপত্যকাজুড়ে বিমান হামলা শুরু করেছে। গণমাধ্যমকে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা গাজায় নতুন করে লড়াই শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যুদ্ধবিরতির সময় নিহত বেসামরিক নাগরিকদের নিয়ে দৈনিকই তথ্য প্রকাশ করছে।

রাফায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখতে চাইছে ইসরায়েল। সেখানে শুক্রবার থেকে ইসরায়েলি ট্যাংক ও ড্রোন দিয়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা করা হয়েছে। এতে কমপক্ষে তিনজন নিহত এবং আরও কয়েকজন আহত হয়েছেন।

হামাস কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে

গত রোববার রাতে দেওয়া এক বিবৃতিতে হামাস ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘সস্তা ব্ল্যাকমেলের’ অভিযোগ এনেছে।

হামাস বলেছে, ‘দখলদার বাহিনী খাবার, ওষুধ ও পানি থেকে বঞ্চিত করার পর গাজায় বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমরা তার তীব্র নিন্দা জানাই।’

হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য ইজ্জত আল-রিশেক এ পদক্ষেপকে ‘গাজার জনগণ এবং তাদের প্রতিরোধকে চাপের মুখে ফেলার একটি মরিয়া চেষ্টা’ বলে উল্লেখ করেছেন।

ইসরায়েলকে কে বা কারা সমর্থন দিচ্ছে

দেশটি যুক্তরাষ্ট্র।

ইসরায়েল বলছে, হামাসকে মার্কিন দূত স্টিভ উইটকফের প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য করার জন্য গাজায় বর্তমান অবরোধ দেওয়া হয়েছে। উইটকফ যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের মেয়াদ বাড়ানো এবং গাজা থেকে কয়েকজন ইসরায়েলি বন্দীকে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন।

এ পরিকল্পনায় উইটকফের ভূমিকা কী হবে, তা তিনি এখনো নিশ্চিত করেননি।

তবে গতকাল সোমবার দোহায় আলোচনার আগে সাংবাদিকদের উইটকফ বলেছেন, যৌথভাবে হামাসের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়াসহ ইসরায়েলের প্রতি পূর্ণ সমর্থন অব্যাহত রাখবে মার্কিন প্রশাসন।

একই সময়ে হামাসের কাছে জিম্মি পাঁচ মার্কিন নাগরিককে ফেরত দেওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সংগঠনটির সঙ্গে সরাসরি আলোচনা চালাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, ওই পাঁচ বন্দীর মধ্যে এখন মাত্র একজন জীবিত আছেন।

ইসরায়েলি হামলায় বিধ্বস্ত গাজা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

এ অবরোধে কারা ইসরায়েলকে সমর্থন দিচ্ছে না

বলা চলে, যুক্তরাষ্ট্র বাদে প্রায় কেউ–ই ইসরায়েলকে সমর্থন দিচ্ছে না।

মিসর ও কাতার—দুটি দেশই যুদ্ধবিরতির আলোচনায় মধ্যস্থতা করেছে। গাজা উপত্যকায় খাবার, ওষুধ ও জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় চলতি মাসে ইসরায়েলের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে সৌদি আরব ও জর্ডান।

গত বুধবার এক যৌথ বিবৃতিতে ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্য বলেছে, ‘মানবিক সহায়তা কখনোই যুদ্ধবিরতিনির্ভর হওয়া উচিত নয় অথবা এটিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়।’

গাজায় সহায়তা বন্ধ করা নিয়ে ইসরায়েলের নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো মানবাধিকার সংগঠনগুলোও নতুন করে অবরোধ আরোপের নিন্দা জানিয়েছে। তারা একে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

কাতারে চলমান আলোচনার ওপর এর প্রভাব কী

এটা এখন দেখার বিষয়।

হামাস এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা মার্কিন দূত অ্যাডাম বোহলারসহ অন্য মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে ‘নমনীয় আচরণ’ করেছে। বোহলার মার্কিন জিম্মিদের নিয়ে সরাসরি আলোচনার বিষয়টি তত্ত্বাবধান করছেন এবং যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপের ব্যাপারে ঐকমত্য হওয়ার আশা করছেন।

ইসরায়েলি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের মতো করে একই ধরনের দাবি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ১০ জন জীবিত ইসরায়েলি বন্দীকে ফিরিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে যুদ্ধবিরতির বর্তমান পর্যায় ৬০ দিনের জন্য বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আলচনার অংশ হিসেবে হামাস দাবিগুলো বিবেচনা করছে।