মধ্যপ্রাচ্যে কীভাবে সংঘাত ছড়িয়ে দিচ্ছে ইসরায়েল

গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনীছবি: এএফপি

১২ দিনব্যাপী যুদ্ধের পর ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি নাজুক যুদ্ধবিরতি চলছে, যা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণার এক দিন পর কার্যকর হয়। ১৩ জুন ইরানের কয়েকটি সামরিক অবকাঠামো ও পারমাণবিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ইসরায়েলের আকস্মিক হামলার পর এ যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল।

আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রজেক্টের (এসিএলইডি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এ বছরের ১৩ জুন ইরানে প্রথম হামলা করার দিন পর্যন্ত ইসরায়েল গাজা ও অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড, লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন ও ইরানে প্রায় ৩৫ হাজার হামলা চালিয়েছে। এসব হামলা নথিভুক্ত করা হয়েছে।

ইসরায়েল এসব হামলায় যুদ্ধবিমান ও ড্রোন ব্যবহার করেছে, গোলাবর্ষণের পাশাপাশি ছুড়েছে ক্ষেপণাস্ত্র, ঘটিয়েছে দূরনিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ। এ ছাড়া সুপরিকল্পিতভাবে সম্পত্তি ধ্বংস করেছে।

সবচেয়ে বেশি হামলা চালানো হয়েছে ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড লক্ষ্য করে। এর মধ্যে অন্তত ১৮ হাজার ২৩৫টি হামলা নথিভুক্ত করা হয়েছে। এরপর যথাক্রমে লেবানন (১৫ হাজার ৫২০), সিরিয়া (৬১৬), ইরান (৫৮) ও ইয়েমেনে (৩৯) বেশি হামলা হয়।

ইসরায়েলের আকাশ যুদ্ধ

ইসরায়েল বেশির ভাগ হামলা চালিয়েছে গাজা, অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড পশ্চিম তীর ও লেবাননে। তবে তাদের সামরিক অভিযান আঞ্চলিক এ সীমানা ছাড়িয়ে আরও দূরবর্তী অঞ্চলেও পৌঁছেছে।

ইসরায়েলের যুদ্ধবিমানগুলো শত শত, এমনকি হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে উড়ে গিয়ে হামলা চালিয়েছে; যেমন সিরিয়ার প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার (প্রায় ৩৪০ মাইল), ইরানে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার (৯০০ মাইল) ও ইয়েমেনে প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার (১ হাজার ২০০ মাইল) ভেতর পর্যন্ত প্রবেশ করে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে।

সিরিয়ায় প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার (প্রায় ৩৪০ মাইল), ইরানে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার (৯০০ মাইল) ও ইয়েমেনে প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার (১ হাজার ২০০ মাইল) ভেতর পর্যন্ত প্রবেশ করে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে ইসরায়েল।

দূরপাল্লার এই হামলাগুলো সংঘাতের ভৌগোলিক পরিসর উল্লেখযোগ্যভাবে বিস্তৃত করেছে, যা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে আরও ব্যাপক যুদ্ধ শুরু করা বা সামরিক অভিযান চালানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে।

ইসরায়েলের এসব অভিযান সম্ভব হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা সর্বাধুনিক বিমানবহরের কারণে, যার মধ্যে রয়েছে এফ-১৫, এফ-১৬ এবং রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম স্টেলথ এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান। রাডারে স্টেলথ ক্ষমতাসম্পন্ন যুদ্ধবিমান শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব। এফ-৩৫ ইসরায়েলের অস্ত্রাগারে থাকা সবচেয়ে উন্নত যুদ্ধবিমান।

নজরদারি করা ও লক্ষ্যভিত্তিক হামলা চালানোর জন্য ইসরায়েল ড্রোনের ওপরও ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের ১৩ জুন পর্যন্ত ইসরায়েল যেসব হামলা চালিয়েছে, তার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র নিচে তুলে ধরা হলো।

গাজায় ইসরায়েলের হামলার পর ধ্বংসস্তূপের ওপর অসহায় এক ফিলিস্তিনি
ফাইল ছবি: রয়টার্স

গাজায় হামলা

টানা ৬২৮ দিনের বেশি সময় ধরে বোমাবর্ষণ, অবরোধ ও স্থল হামলার মাধ্যমে গাজায় ধ্বংসাত্মক এক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। বহু বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক গাজায় ইসরায়েলের অভিযানকে গণহত্যা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। গাজায় এখনো হামলা চালিয়ে যাচ্ছে দেশটি।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সেখানে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৬ হাজার ৭৭ জন নিহত এবং ১ লাখ ৩১ হাজারের বেশি আহত হয়েছেন। তবে হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি বলে ধারণা করা হয়।

গাজার ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সেখানে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৬ হাজার ৭৭ জন নিহত এবং ১ লাখ ৩১ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। তবে হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি বলে ধারণা করা হয়।

আরও পড়ুন
ফিলিস্তিনের দখলকৃত পশ্চিম তীরের জেনিন শহরে একটি শরণার্থী শিবিরে রোববার ভোরে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল
ছবি: রয়টার্স

পশ্চিম তীরে হামলা

গাজা যুদ্ধে ইসরায়েল যে কৌশলগুলো ব্যবহার করছে, তার অনেকগুলোই এখন অধিকৃত পশ্চিম তীরে জমি দখল ও নিয়ন্ত্রণে প্রয়োগ করছে তারা।

গত ২১ জানুয়ারি গাজায় অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার ঠিক পরদিন ইসরায়েলি বাহিনী পশ্চিম তীরের উত্তরের কয়েকটি শহরে বড় আকারে সামরিক অভিযান শুরু করে। ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক জাতিসংঘ সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ ওই অভিযানকে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার পর পশ্চিম তীরে এ পর্যন্ত হওয়া সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও ধ্বংসাত্মক অভিযান বলে বর্ণনা করেছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ইসরায়েল, হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য লেবাননী গোষ্ঠী সীমান্তের এপার-ওপারে মোট ১৩ হাজার ৬০০টির বেশি হামলা চালিয়েছে।

ব্রিটিশ গবেষণা সংস্থা ফরেনসিক আর্কিটেকচারের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ইসরায়েল পশ্চিম তীরের জেনিন, নুর শামস ও তুলকারেম শরণার্থীশিবিরসহ বিভিন্ন এলাকায় স্থায়ী সামরিক উপস্থিতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভবন ধ্বংস, সাঁজোয়া বুলডোজার মোতায়েন এবং বিমান হামলার মতো কৌশল ব্যবহার করেছে।

জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এসব অভিযানের ফলে অন্তত ৪০ হাজার ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু হয়েছেন। গত ২০ মাসে অধিকৃত পশ্চিম তীরজুড়ে ইসরায়েলি বাহিনী ও ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা প্রায় ১ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে দুই শতাধিক শিশুও রয়েছে।

আরও পড়ুন
লেবাননে হিজবুল্লাহর ওপর হামলা বাড়িয়েছে ইসরায়েল
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ইসরায়েল-লেবানন সীমান্তে সংঘাত

ইসরায়েল–লেবানন সীমান্তে ইসরায়েলি বাহিনী ও লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর মধ্যে প্রায় ১৪ মাস ধরে সংঘাত চলার পর ২০২৪ সালের ২৭ নভেম্বর একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এ সংঘাতে হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।

ইসরায়েলের হামলায় দক্ষিণ লেবাননের বহু গ্রাম ও বৈরুতের কয়েকটি পাড়া সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ইসরায়েল, হিজবুল্লাহ এবং অন্যান্য লেবাননী গোষ্ঠী সীমান্তের এপার-ওপারে মোট ১৩ হাজার ৬০০টির বেশি হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৮৩ শতাংশ, অর্থাৎ ১১ হাজার ২৩৮টি হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল।

সিরিয়া-ইসরায়েল সীমান্ত এলাকার গোলান মালভূমিতে অবস্থান নিয়েছে ইসরায়েলি ট্যাংক
ছবি: রয়টার্স

সিরিয়ায় হামলা

২০২৪ সালের ১০ ডিসেম্বর সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের ৫৩ বছরের শাসনের নাটকীয় পতনের মাত্র দুই দিন পর দেশটিতে ব্যাপক বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল।

ইসরায়েল ওই হামলায় সিরিয়ার সামরিক অবকাঠামোর বড় এক অংশ ধ্বংস করে দেয়। সিরিয়ার প্রধান প্রধান বিমানবন্দর, আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, যুদ্ধবিমান এবং অন্যান্য কৌশলগত স্থাপনায় হামলা চালিয়ে সেগুলো ধ্বংস করে দেয় তারা।

গত ছয় মাসে ইসরায়েলি বাহিনী সিরিয়াজুড়ে দুই শতাধিক বিমান, ড্রোন ও গোলন্দাজ হামলা চালিয়েছে। আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটার (এসিএলইডি) হিসাব অনুযায়ী, ইসরায়েল গড়ে তিন থেকে চার দিন অন্তর দেশটিতে এসব হামলা চালায়।

আরও পড়ুন
ইসরায়েলি বিমান হামলায় জ্বলছে জ্বালানি অবকাঠামো। ইয়েমেনের রাজধানী সানায়
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ইয়েমেনে হামলা

ইসরায়েল ইয়েমেনের হুতি-নিয়ন্ত্রিত অবকাঠামোগুলোতেও হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সানা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, হোদেইদা বন্দর ও একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।

২০২৪ সালের শেষ দিকে এ হামলা তীব্র আকার ধারণ করে। ২০২৫ সালেও হামলা হয়েছে। হামলার মূল লক্ষ্য, হুতিদের সামরিক সক্ষমতাকে দুর্বল করা। গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে।

ইরানে ইসরায়েলি হামলার পর একটি স্থান থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা যাচ্ছে
ছবি: এএফপি

ইরানে হামলা

গত ১৩ জুন ইরানের অভ্যন্তরে ব্যাপক মাত্রার বিমান ও ড্রোন হামলা চালায় ইসরায়েল। দেশটি সেদিন ইরানের সামরিক স্থাপনা, অস্ত্রের গুদাম এবং ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব ও ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোগুলোতে একযোগে হামলা চালায়।

এভাবে গত ২০ মাসে ইসরায়েল তার আশপাশে দুই হাজার কিলোমিটার দূর পর্যন্ত চারটি দেশ ও ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে তার যুদ্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন