হেলিকপ্টারে লেবাননের ১০ বারের প্রধানমন্ত্রীর আসনের কাছেই বোমা রেখেছিল সন্ত্রাসীরা

লেবাননের ১০ বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন রশিদ কারামি। গৃহযুদ্ধপীড়িত দেশটিতে মানুষের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা ছিল বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। ফিলিস্তিনিদের বন্ধু ও সিরিয়াপন্থী কারামির ওপর ক্ষুব্ধ ছিল খ্রিষ্টান মিলিশিয়ারা। তাদেরই লেবানিজ ফোর্সেসের সন্ত্রাসীরা এই প্রধানমন্ত্রীকে খুন করে বলে ধারণা করা হয়। ১ জুন তিনি হেলিকপ্টারে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন। আজ তাঁকে নিয়ে বিশেষ আয়োজন

১৯৮৭ সালে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হওয়ার সময় রশিদ কারামির বয়স ছিল ৬৫ বছরছবি: এক্স থেকে সংগৃহীত

১৯৮৭ সালের ১ জুন। লেবাননে তখন গৃহযুদ্ধ চলছে। বিভিন্ন মিলিশিয়া বাহিনী (সশস্ত্র গোষ্ঠী) লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে বৈরুত সফরে যাবেন সিরীয়পন্থী প্রধানমন্ত্রী রশিদ কারামি। সঙ্গে রয়েছেন আরও কয়েকজন সফরসঙ্গী। ত্রিপোলির কাছাকাছি এলাকার একটি সামরিক ঘাঁটি থেকে তাঁদের নিয়ে রওনা করে সামরিক হেলিকপ্টার। মাঝ–আকাশেই হেলিকপ্টারে বোমা বিস্ফোরণ হয়।

এতে হেলিকপ্টারটির চাকা উড়ে যায় এবং দরজা ভেঙে পড়ে। এর পাইলট গুরুতর আহত হন। এমন অবস্থায় অপেক্ষাকৃত কম আহত সহপাইলট দ্রুত পাইলটের কাছ থেকে হেলিকপ্টারের নিয়ন্ত্রণ নেন। বৈরুতের উত্তরাঞ্চলে একটি ছোট বিমানবন্দরে হেলিকপ্টারটির জরুরি অবতরণ করা হয়। তবে হেলিকপ্টারের অন্যান্য আরোহী আহত হলেও প্রাণ হারান রশিদ কারামি।

খ্রিষ্টান–নিয়ন্ত্রিত জুবাইলে সেন্ট মার্টিন হাসপাতালে কারামির মরদেহ রাখা হয়। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান লেবাননের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আমিন গেমায়েল। এরপর গেমায়েল শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক ডাকেন। এ বোমা হামলার ঘটনাটি তদন্তের জন্য সামরিক বিশেষজ্ঞদের আদেশ দেন তিনি। ঘটনার দিন রাতেই লেবাননের শ্রম ও শিক্ষামন্ত্রী এবং সাবেক শিক্ষামন্ত্রী সেলিম হোসকে নতুন সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

রশিদ কারামির উত্থান

১৯২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর লেবাননের ত্রিপোলিতে একটি সুন্নি মুসলিম পরিবারে রশিদ কারামির জন্ম। ১৯৪২ সালে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে স্নাতক শেষ করেন তিনি। ১৯৫১ সালে তিনি লেবাননের আইনমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। এর চার বছর পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন কারামি। ১৯৫৫ থেকে শুরু করে তিনি ১০ বার লেবাননের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮৭ সালে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হওয়ার সময় রশিদ কারামির বয়স ছিল ৬৫ বছর। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। তাঁকে লেবাননের ‘সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত অবিবাহিত পুরুষ’ (মোস্ট ইলিজিবল ব্যাচেলর) বলে ডাকা হতো।

সুন্নি মুসলিম রশিদ কারামি ফিলিস্তিনের একজন বন্ধু ছিলেন। ১৯৭০ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে লেবাননের আরও বেশি সম্পৃক্ততা চাইছিলেন তিনি। তখন বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালে লেবাননে গৃহযুদ্ধ চলাকালেও তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ছিলেন সিরিয়াপন্থী। এ জন্যও বারবার তাঁকে নানা বাধাবিপত্তির মধ্যে পড়তে হয়েছিল।

রশিদ কারামি আরবির পাশাপাশি ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায়ও পারদর্শী ছিলেন। তবে এরপরও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরবিতেই কথা বলতে পছন্দ করতেন। এ জন্য একজন দোভাষী রাখতেন তিনি।

কারামির বাবা আবদেল হামিদ কারামি লেবানন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পেছনে ভূমিকা রাখা ব্যক্তিদের অন্যতম। ১৯৪৫ সালে তিনি অল্প সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

বোমা ছিল আসনের কাছে

লেবাননের পুলিশের বরাতে ওই সময় ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, হেলিকপ্টারে কারামির আসনের নিচে কিংবা পেছনে বোমাটি রাখা ছিল। আবার কোনো সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, বোমাটি একটি ব্রিফকেসের ভেতর ছিল।

লেবাননের বিমানবাহিনীর তৎকালীন প্রধান ফাহিম হাজ তখন বলেছিলেন, নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে পাঁচটি হেলিকপ্টার থেকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে একটি বেছে নেওয়া হয়েছিল। রশিদ কারামিকে বহনের জন্য এটি প্রথমে জুনিয়েহর সমুদ্রবন্দরের উত্তরাঞ্চলীয় একটি সামরিক ঘাঁটি থেকে ত্রিপোলির কাছে বাকোয়া সাফরিনে পৌঁছায়। সামরিক ঘাঁটি থেকে রওনা করার আগে এটিতে ব্যাপক তল্লাশি চালানো হয়। হেলিকপ্টারটি যাত্রা শুরুর মাত্র ১০ মিনিট আগে পাইলট এবং কো-পাইলট জানতে পেরেছিলেন হেলিকপ্টারের যাত্রী কারা। তবে হেলিকপ্টারে ওঠার আগে কারামি ও অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে থাকা লাগেজগুলো তল্লাশি করা হয়নি।

কারামির মরদেহের ময়নাতদন্ত করেছিলেন জোসেফ সোতো নামের এক চিকিৎসক। তিনি বলেন, বিস্ফোরণের কারণে রশিদ কারামির শরীরের অনেক জায়গায় আঘাত লেগেছিল। শরীরের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণের কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।

সিরিয়াপন্থী হওয়ায় দ্বন্দ্ব

রশিদ কারামি ছিলেন লেবাননে সিরিয়ার ভাবমূর্তি বজায় রাখার প্রচেষ্টাকারী একমাত্র মুসলিম রাজনীতিবিদ। লেবাননে সিরিয়া–নিয়ন্ত্রিত উত্তরাঞ্চলে তিনি একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তবে লেবাননে মিলিশিয়াদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকা হাতে গোনা কয়েক নেতার একজন ছিলেন কারামি।

সিরিয়ার প্রতি সমর্থন জানানোর কারণে কারামির ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন তৎকালীন লেবানিজ প্রেসিডেন্ট আমিন গেমায়েল। লেবানিজ ফোর্সসের প্রতিষ্ঠাতা বশির গেমায়েলের ভাই ছিলেন আমিন।

রশিদ কারামি ও গেমায়েলের মধ্যকার দ্বন্দ্বের শুরু ১৯৮৬ সালের জানুয়ারিতে। তখন সিরিয়ার মধ্যস্থতায় একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান গেমায়েল। ওই চুক্তির প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য খ্রিষ্টান মিলিশিয়াদের বড় ধরনের ছাড় দিতে হবে। লেবাননের রাজনৈতিক ও সামরিক বিষয়গুলো তত্ত্বাবধানে সিরিয়ার এখতিয়ার থাকবে।

সিরিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাকে কেন্দ্র করে খ্রিষ্টান ও মুসলিমদেরও সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন কারামি। এমন অবস্থায় ১৯৮৭ সালের ৪ মে প্রেসিডেন্ট গেমায়েলের কাছে পদত্যাগপত্র দেন তিনি। তবে সে পদত্যাগপত্র মঞ্জুর করেননি গেমায়েল।

কারামির পদত্যাগপত্র মঞ্জুর করার জন্য গেমায়েলকে চাপ দিতে থাকে লেবানিজ ফোর্সেস। তবে গেমায়েল তখনো কারামির পদত্যাগ চূড়ান্ত করেননি। তাঁর ভয় ছিল, কারামির জায়গায় বসানোর মতো যোগ্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না এবং এতে তাঁর প্রশাসন আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।

হত্যার পর প্রতিক্রিয়া

কারামির হত্যাকাণ্ডের পর লেবানন সরকারে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বেড়ে যায়। লেবাননের মুসলিম নেতারা অভিযোগ করেন, ম্যারোনাইট খ্রিষ্টান প্রেসিডেন্ট গেমায়েল ও অন্য খ্রিষ্টান নেতারা এ ঘটনায় তদন্ত ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

কারামি নিহত হওয়ার ঘটনায় সিরিয়ার নেতারাও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সিরিয়ার মন্ত্রিপরিষদে এক মিনিটের নীরবতা পালন করা হয়। দামেস্কের রেডিওগুলোতে অভিযোগ করা হয়, ইসরায়েল ও লেবাননে থাকা ইসরায়েলি এজেন্টরা এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত।

খুন করল কে

রশিদ কারামিকে হত্যার ঘটনায় লেবাননের খ্রিষ্টানভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও গৃহযুদ্ধের সময়কার মিলিশিয়া বাহিনী লেবানিজ ফোর্সেসকে দায়ী করা হয়ে থাকে। রয়টার্সের এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৬ সালে লেবাননে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর লেবানিজ ফোর্সেস গড়ে ওঠে। ম্যারোনাইট খ্রিষ্টান বাশির গেমায়েল এ দল প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্য দিয়ে নিজের পারিবারিক দল কাতায়েবের সশস্ত্র শাখাসহ খ্রিষ্টান মিলিশিয়াদের ঐক্যবদ্ধ করেন তিনি।

প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনসহ (পিএলও) অনেক প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করেছে লেবানিজ ফোর্সেস। ওই সময় লেবাননের বিশাল অংশ নিয়ন্ত্রণ করত ফিলিস্তিনের পিএলও। লেবানিজ ফোর্সেসের প্রতি ইসরায়েলের সমর্থন ছিল। লেবাননে লেবানিজ ফোর্সেসের শত্রুপক্ষের মধ্যে দ্রুজ মিলিশিয়ারাও ছিল।

১৯৮২ সালে বৈরুতে এক ইসরায়েলি অভিযানের পর লেবাননের প্রেসিডেন্ট হন বাশির গেমায়েল। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার এক মাস পরই হত্যার শিকার হন তিনি। এরপর লেবাননের প্রেসিডেন্ট হন তাঁর ভাই আমিন গেমায়েল।

১৯৮২ সালে বাশির গেমায়েলের হত্যার প্রতিশোধ নিতে খ্রিষ্টান মিলিশিয়ারা সাবরা ও শাতিলায় ফিলিস্তিনি শিবিরগুলোতে শত শত নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলা চালায়।

১৯৮৬ সালে লেবানিজ ফোর্সেসের নিয়ন্ত্রণ নেন সামির গিয়াগিয়া। বাশির গেমায়েলের অধীনই তাঁর উত্থান ঘটেছিল। সামিরের নেতৃত্বে খ্রিষ্টান মিলিশিয়াদের প্রভাব–প্রতিপত্তি বজায় থাকে। তারা খ্রিষ্টানদের একটি ছিটমহল পরিচালনা করত।

লিবিয়ার গৃহযুদ্ধের শেষের দিকের বছরগুলোতে খ্রিষ্টান এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য লেবানিজ ফোর্সেস এবং তৎকালীন সেনা কমান্ডার আউনের মধ্যে মূল লড়াইটা হতো। ওই সময় লেবাননের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী সরকারের প্রধান ছিলেন আউন। ১৯৯০ সালে লেবাননে গৃহযুদ্ধের অবসান হয়।

রাশিদ কারামিকে হত্যাসহ গৃহযুদ্ধ চলাকালীন লেবাননে বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে ১৯৯৪ সালে লেবানিজ ফোর্সেসের নেতা সামির গিয়াগিয়া গ্রেপ্তার হন। তাঁর বাহিনীকেও অবৈধ ঘোষণা করা হয়। কারামির হত্যাকাণ্ডসহ গৃহযুদ্ধ চলাকালীন বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে সামিরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। তবে কয়েক বছর কারাদণ্ড ভোগ করার পর ২০০৫ সালে তিনি সাধারণ ক্ষমা পান। তাঁকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে লেবাননের পার্লামেন্টে বিল পাসের পর তিনি মুক্তি পান। তবে সামির তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাঁর দাবি, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে।

তথ্যসূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, রয়টার্স, আল–জাজিরা, ইউপিআই