গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার প্রমাণ দিচ্ছে তুরস্ক: এরদোয়ান

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ইসরায়েলের বিপক্ষে প্রমাণের প্রয়োজনীয় সব নথি ও দৃশ্যমান উপাত্ত সরবরাহ করবেন।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানছবি: রয়টার্স

গাজায় গণহত্যা চালানোর অভিযোগে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) দক্ষিণ আফ্রিকা যে মামলা করেছে, সেখানে প্রয়োজনীয় নথি ও উপাত্ত দিচ্ছে তুরস্ক।

গত শুক্রবার তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ইসরায়েলের বিপক্ষে তাঁর দেশের নথি সরবরাহের কথা বলেছেন। ইস্তাম্বুলে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এরদোয়ান বলেছেন, গাজায় ইসরায়েলি হামলার বিষয়ে নথি সরবরাহ চালিয়ে যাবে তাঁর দেশ। এসব নথির বেশির ভাগই ভিডিও বা দৃশ্যমান উপাত্ত (ভিজ্যুয়াল)।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেন, ‘আমি মনে করি, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে দোষী সাব্যস্ত হবে ইসরায়েল। জাতিসংঘের শীর্ষ আদালতের বিচারে আমরা বিশ্বাস করি।’

ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ এরদোয়ানের মন্তব্যের জবাবে বলেছেন ‘আর্মেনীয় গণহত্যার ইতিহাস যাদের অতীত, সেই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এখন ভিত্তিহীন দাবি নিয়ে ইসরায়েলকে লক্ষ্যবস্তু করার গর্ব করে। ইসরায়েল আপনার বর্বর মিত্রদের বিরুদ্ধে ধ্বংস নয়, প্রতিরক্ষায় দাঁড়িয়েছে।’

ইসরায়েল কয়েক দশক ধরে ১৯১৫ থেকে ১৯১৭ সালে অটোমান তুর্কিদের দ্বারা আর্মেনীয় গণহত্যাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত বিবেচনার ভিত্তিতে একটি পদক্ষেপ নিয়ে এসেছে তারা। এর মধ্যে তুরস্কের সঙ্গে ভালো সম্পর্কও ছিল আরেকটি কারণ। ২০২১ সালে তাদের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র একে গণহত্যার স্বীকৃতি দিলে ইসরায়েলও সে পথে হাঁটেনি। বিশ্বের ৩০টি দেশ একে গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়েছে। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৯২৩ সালে তুরস্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। আর্মেনিয়ানদের ধ্বংস করার জন্য কৌশলগত কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা অস্বীকার করে আসছে দেশটি।

গাজায় গণহত্যা চালানোর অভিযোগ এনে গত ডিসেম্বরে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলাটি করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রিটোরিয়ার অভিযোগ, এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েল জাতিসংঘের গণহত্যাবিষয়ক কনভেনশন লঙ্ঘন করছে। ৮৪ পৃষ্ঠার নথিতে ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যা বা এ–সম্পর্কিত অপরাধের সীমা লঙ্ঘন করার তথ্য-উপাত্ত দেওয়া হয়।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালত হলো জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত, যার সদর দপ্তর নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি করে আইনি বিষয়ে পরামর্শভিত্তিক মতামত দেওয়ার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জাতিসংঘের এ আদালতে দক্ষিণ আফ্রিকার তোলা অভিযোগে বলা হয়, গাজাবাসীর বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরায়েল। বৃহস্পতিবার হেগের আদালতে গণহত্যার শুনানি শুরু হয়েছে। প্রথম দিনে দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরায়েলি জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের যুদ্ধনীতিবিষয়ক মন্তব্যের ভিত্তিতে যুক্তিতর্ক তুলে ধরে। তাদের যুক্তির ভিত্তি হচ্ছে ইসরায়েলি নীতিতে বেসামরিক লোকজনকে হত্যার অভিপ্রায়ের কথা বলা হয়েছে।

শুনানির প্রথম দিনে নিজেদের অভিযোগের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন দক্ষিণ আফ্রিকার আইনজীবীরা। প্রিটোরিয়া চায়, বিচারকেরা যেন গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করতে ইসরায়েলকে চাপ দেন।

তবে শুক্রবার শুনানিতে দক্ষিণ আফ্রিকার অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে প্রত্যাখ্যান করে ইসরায়েল বলেছে, দেশটি ইহুদি রাষ্ট্র নিশ্চিহ্ন করার হুমকিদাতা হামাসের দূত হিসেবে কাজ করছে। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রতিরক্ষা বাহিনী কেবল হামাসকে লক্ষ্যবস্তু করেছে, ফিলিস্তিনের সাধারণ জনগণকে নয়। কিন্তু লড়াইয়ে বেসামরিক লোকজনের মৃত্যু এড়ানো যায় না। কারণ, সন্ত্রাসীরা জনগণের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে। ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) করা মামলাকে ‘মারাত্মকভাবে বিকৃত’ ও ‘বিদ্বেষপ্রসূত’ বলে মনে করে ইসরায়েল। শুক্রবার এ মামলার শুনানি চলাকালে ইসরায়েলের পক্ষের আইনজীবী আদালতকে এসব কথা বলেন।

গতকাল শুনানি চলাকালে ইসরায়েলের পক্ষের আইনজীবী তাল বেকার বলেন, দুঃখজনকভাবে দক্ষিণ আফ্রিকা আদালতের সামনে ঘটনার বাস্তব ও ন্যায়সংগত চিত্রকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছে। তিনি কিছু ভিডিও ও ছবি ব্যবহার করে গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে চালানো হামাসের হামলার ভয়াবহতার চিত্র উপস্থাপন করেন।

৭ অক্টোবর হামাসের যোদ্ধারা ইসরায়েলে প্রাণঘাতী হামলা চালানোর পর ইসরায়েলি বাহিনী গাজার অধিকাংশ স্থান ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। হামাসের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, ইসরায়েলের হামলায় ২৩ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলের দাবি, তারা গাজায় ৮ হাজার হামাস সদস্যকে হত্যা করেছে। এ ছাড়া ইসরায়েলের ভেতরে থাকা এক হাজার সন্ত্রাসীকেও হত্যা করেছে। তারা বেসামরিক লোকজনের মৃত্যু এড়াতে কাজ করছে।

এরদোয়ানকে ইসরায়েলের অন্যতম সমর্থনকারী মনে করা হয়। গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা শুরুর পর এরদোয়ান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তোলেন। এরপর তুরস্ক থেকে কূটনীতিকদের সরিয়ে নেয় ইসরায়েল। এর জবাবে ইসরায়েল থেকে রাষ্ট্রদূত সরিয়ে নেয় তুরস্ক।

মামলার বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র-জার্মানি

এদিকে বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, আইসিজেতে করা দক্ষিণ আফ্রিকার মামলাটিকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার এমন মন্তব্য করেছেন।

জার্মানিও আইসিজেতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আনা গণহত্যার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। জার্মান সরকারের মুখপাত্র স্টেফেন হেবেস্ট্রাইট এক বিবৃতিতে বলেন, ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে ‘অমানবিক’ হামলা চালানোর পরই ইসরায়েল ‘আত্মরক্ষায়’ পদক্ষেপ নিয়েছে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, জার্মান ইতিহাস ও ইহুদিদের ওপর যে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তার আলোকে জার্মান সরকার সুনির্দিষ্ট করে জাতিসংঘের জেনোসাইড কনভেনশন মেনে চলার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মানিতে ইহুদি নিধনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৮ সালে জেনোসাইড কনভেনশন সই হয়। ইহুদি নিধনের ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা থেকে জার্মানিকে তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে ইসরায়েলকে গুরুত্ব দিতে দেখা যায়।