‘নকল খাবার’ খেয়ে কীভাবে বেঁচে আছে গাজার মানুষ

ইসরায়েলি অবরোধের কারণে গাজায় তীব্র খাদ্যসংকট চলছে। সেখানে এখন দুর্ভিক্ষ অবস্থা। এ অবস্থায় কী খেয়ে বেঁচে আছে মানুষ, তা নিয়ে আল-জাজিরায় লিখেছেন গাজার বাসিন্দা গল্পকার দিমা ফায়্যাদ। ২৯ সেপ্টেম্বর লেখাটি আল-জাজিরার অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হয়।

মসুর ডাল দিয়ে ‘নকল’ রুটি বানিয়ে খাচ্ছে গাজাবাসী
ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

ইসরায়েলের অবরোধের কারণে পুরো গাজায় খাদ্যসংকট যখন তীব্র হয়ে উঠল, তখন অল্প খাবারকে কীভাবে দীর্ঘ সময় রাখা যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হয়েছে গাজাবাসীকে। বাজারে যা পাওয়া যেত না, তার বিকল্প খুঁজে বের করে ‘নকল’ খাবার তৈরি করে খেতে হচ্ছে তাদের। জীবনের পাশাপাশি তাদের খাবারের লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

গাজার ইংরেজি ভাষার গল্পকার ও স্বেচ্ছাসেবক দিমা ফায়্যাদ তাঁর পরিবারের সদস্যরা কী খেয়ে বেঁচে আছেন, সেই গল্প বলেছেন আল-জাজিরার কাছে। দিমা তাঁর লেখার মাধ্যমে বিশ্বকে গাজায় গণহত্যার কঠোর বাস্তবতা দেখাতে চান।

দিমা ফায়্যাদ বলেন, গাজায় যখন খাবার ফুরিয়ে গেল, তখন তাঁর পরিবারকে বাধ্য হয়ে কীভাবে অল্প খাবারকে অনেক দিন খাওয়া যায়, আর বাজারে পাওয়া যায় না—এমন উপকরণের বিকল্প খুঁজে বের করতে হয়েছে।

দিমা বলেন, ‘আমরা নতুন রেসিপি নিয়ে পরীক্ষা করলাম। এমন সব বানালাম, যা আগে কখনো কল্পনাও করিনি। কিছু সমাধান বের করতে পারলাম, যেগুলো আমাদের অন্তত কিছুটা হলেও এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের বাস্তবতা সহ্য করতে এবং বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছে।’

পাস্তা আর মসুর ডালের রুটি

গাজাবাসীর খাদ্যাভ্যাসের মূল অংশ রুটি। কিন্তু ইসরায়েলি অবরোধের কারণে গমের আটা শেষ হয়ে যাওয়ায় রুটি খাওয়া নিয়ে বিপদে পড়ে যায় গাজাবাসী। এ সময় উপায় না পেয়ে দিমারাসহ গাজার প্রায় সবাই পাস্তা দিয়ে রুটি বানানো শুরু করেন। কারণ, তখন বাজারে প্রায় কিছুই পাওয়া যায় না—না ফল, না সবজি, না ডিম, না পনির, না মুরগি, না মাংস।

মানুষ পাস্তা রান্না করে খাওয়ার চেয়ে তা দিয়ে রুটি বানাতে বেশি পছন্দ করছে। কারণ, রুটি প্রতিটি খাবারের সঙ্গে খাওয়া যায়, কিন্তু পাস্তা সাধারণত দুপুরের খাবার। আর তাদের বিশ্বাস, রুটি খেলে পেট বেশি ভরে এবং দীর্ঘক্ষণ তৃপ্ত থাকা যায়।

গত জুনের শুরুতে দিমার পরিবার প্রথমবারের মতো পাস্তার রুটি বানানোর চেষ্টা করে। এর আগে দিমার ভাই ফাদির স্ত্রী দোহা তাঁর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তাঁরা অনেক দিন ধরেই পাস্তার রুটি খাচ্ছিলেন। তাঁদের কাছ থেকেই পাস্তার রুটি বানানোর রেসিপি নেন দোহা। দিমার মা সাহামের সাহায্যে দোহার দেওয়া রেসিপি অনুযায়ী রুটি বানানো শুরু করেন।

প্রথমে পাস্তা ভিজিয়ে নরম করা হলো। তারপর সামান্য গমের আটা মিশিয়ে মণ্ড বানানো হলো। এতে অনেক বেশি পরিশ্রম আর ধৈর্য দরকার। এই রুটি দেখতে শুধু আটা দিয়ে বানানো রুটির থেকে আলাদা।

রুটি বানানো শেষে দিমার ৩৫ বছর বয়সী ভাই ফাদি স্থানীয় মসজিদের গণচুলায় সেই রুটি সেঁকতে গেলেন। সেখানে মানুষের দীর্ঘ সারি। ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট সময় অপেক্ষার পর ফাদি রুটি সেঁকার সুযোগ পান। এরপর যখন রুটি নিয়ে তিনি ফিরে এলেন, তখন দেখা গেল, এ রুটি সাধারণ রুটির মতোই। আর স্বাদও মেনে নেওয়ার মতো।

ম্যাকারনি ভেজে চিপস বানিয়ে খেতে হয়েছে অনেককে
ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই পাস্তা দিয়ে রুটি বানানো মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেল। এ কারণে পাস্তা অপ্রতুল হয়ে পড়ল, দামও বেড়ে গেল। যেভাবে গমের আটার ক্ষেত্রে হয়েছিল।

এরপর দিমার পরিবারসহ অনেকেই আর পাস্তা কিনতে পারছিলেন না। এ কারণে জুলাই মাসে তাঁরা মরিয়া হয়ে অন্য আরেকটি বিকল্প খুঁজতে শুরু করলেন। তখন তাঁরা ভাবলেন, হয়তো মসুর ডাল দিয়ে ‘নকল’ রুটি বানানো যাবে।

ফাদি এক বন্ধুর কাছ থেকে রেসিপি নিয়ে ডাল মেশিনে নিয়ে গিয়ে ময়দার মতো গুঁড়া করালেন। এরপর সামান্য গমের আটা মিশিয়ে মণ্ড তৈরি করার চেষ্টা করা হলো। যেমনটা তাঁরা পাস্তার ক্ষেত্রে করেছিলেন।

কিন্তু মসুর ডালের মণ্ড বানানো পাস্তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ছিল। দিমা ও তাঁর মা অনেক সময় নিয়ে মণ্ড তৈরি করলেন। কিন্তু এর স্বাদ ভয়ানক আর খেতেও অনেক শক্ত। রুটির চেয়ে অনেক বেশি ডালের মতো স্বাদ।

দিমা বলেন, ‘খাওয়ার সময় অদ্ভুত ডালের স্বাদ উপেক্ষা করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না; স্বাদ ছিল ভয়ানক। তবু আমাদের সেটাই খেতে হলো। কারণ, আর কোনো বিকল্প ছিল না। পরের দিন মসুরের রুটি আরও খারাপ হয়ে গেল; শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেল। আর প্রতিটি কামড় যেন গলায় পাথর আটকে যাওয়ার মতো লাগছিল।’

এরপর ওই মসুর ডালের রুটি আগুনে গরম করে কিছুটা নরম হলে তাঁরা দুক্কাহ দিয়ে খেয়েছেন। দুক্কাহ তাঁদের সকাল ও রাতের নিয়মিত খাবার।

দুক্কাহ হলো ভাজা গম আর মসলা (যেমন শুকনা ধনিয়া আর শোলপা বীজ) পিষে তিল দিয়ে বানানো এক মিশ্রণ। তবে এই দুঃসময়ে গাজাবাসী দুক্কাহতে গমের বদলে মসুর ব্যবহার করছে। তার মানে, গাজাবাসী মসুর ডালের রুটি খাচ্ছে, যার ভেতরে পুরে দেওয়া আছে দুক্কাহ। এই দুক্কাহ আবার মসুর ডাল দিয়েই তৈরি।

এরপর অনেকেই মসুর ডালের রুটি বানানো চালিয়ে গেছে। আর দিমার পরিবার রুটি বানানোর বদলে ডাল রান্না করে খেতে বেশি পছন্দ করত। এ কারণে তাঁরা আর কখনো ডালের রুটি বানাননি বলে জানিয়েছেন দিমা।

নকল বার্গারের দুপুর

দেইর আল-বালাহর একটি আশ্রয়কেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছিলেন দিমা। গত ১১ মে কাজ শেষে তিনি বোন ফিদার কাছে গিয়েছিলেন। কারণ, দিমার কর্মস্থল থেকে বোনের বাসা ছিল কয়েক মিনিট দূরত্বে।

৩৭ বছর বয়সী ফিদা ওয়াশ অফিসার হিসেবে কাজ করেন। তাঁর চার সন্তান—বাসমা, ওয়ার্দ, আসেম আর ওমর আবু ডাক্কাহ। ইসরায়েলি হামলায় খান ইউনিসে তাঁর বাসা বিধ্বস্ত হওয়ার পর তাঁর কর্মস্থল থেকে একটি আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার জায়গা দিয়েছে। সেখানে সহকর্মীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে থাকেন।

ফিদা সেদিন দুপুরে বোনের ঘরে গিয়ে দেখেন, ছোট্ট একটি রান্নার জায়গায় বোন ক্যানের মাংস আর ডাল দিয়ে নকল বার্গার তৈরি করছেন। স্থানীয় একটি ফেসবুক গ্রুপে তিনি এই রেসিপি পেয়েছেন।

দিমা বলেন, ‘প্যাটিস বানাতে আমি সাহায্য করতে শুরু করলাম। কিন্তু সেগুলো সহজে তৈরি হচ্ছিল না। কারণ, যে ক্যানের মাংস ব্যবহার করছিলাম, সেটা এ রকম রান্নার জন্য তৈরি ছিল না। সেগুলো সরাসরি খাওয়ার মতো ছিল। তবে সেগুলোর স্বাদ তাজা মাংসের মতো নয়। এ কারণে স্বাদ বৃদ্ধি করতে মাংসের মসলা যোগ করলাম।’

কিন্তু ক্যানের মাংস ভাজলে ভেঙে যাচ্ছিল। বান নেই, তাই সাধারণ ফ্ল্যাটব্রেডে ওপরে শসা দিয়ে স্যান্ডউইচ তৈরি করা হলো। তাঁরা সবাই আগ্রহ নিয়ে দুপুরের খাবারের অপেক্ষা করছিলেন।

প্রথম কামড়ে খাওয়াটা মোটামুটি ভালো। কিন্তু পরের কয়েক কামড়ে স্বাদ তাঁদের কাছে খারাপ মনে হলো। এরপরও সব বার্গার শেষ হয়েছিল। কারণ, এটা ছাড়া খাবারের আর কোনো বিকল্প ছিল না।

ক্যানের মাংস আর মসুর ডাল দিয়ে তৈরি করা ‘নকল’ বার্গার
ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

নকল নাশতার আনন্দ

খাদ্যসংকট কমাতে দিমার পরিবার নকল কিছু নাশতা বানানো শুরু করল। ইসরায়েলের পূর্ণ অবরোধ শুরুর আগে তাঁরা ত্রাণ হিসেবে হালুয়া পেতেন। গত জুনে তাঁর ভাবি দোহা সেই হালুয়া দিয়ে চকলেট স্প্রেড তৈরি করেছিলেন।

হালুয়া গাজার বহুল পরিচিত একটি মিষ্টি। এটি তাহিনি (তিলের বীজ পেস্ট করে তৈরি মাখন) আর মিষ্টি দিয়ে তৈরি করা হয়। হালুয়া কখনো খুব ভালো হয়, আবার কখনো ত্রাণের খাদ্যের মতো সস্তা স্বাদের হয়।

দিমা বলেন, দোহা প্রথমে হালুয়ায় পানি মিশিয়ে তরল করে নিয়েছিলেন। এরপর তার সঙ্গে কোকো মিশিয়ে গরম করেছেন। এতে স্প্রেডে হালুয়ার স্বাদ থেকে গেলেও কোকোর জন্য স্বাদটা ভালো লাগছিল। আর তাঁরা এটা দিয়ে আনন্দের সঙ্গে সকালের নাশতার স্যান্ডউইচ বানিয়ে খাওয়া শুরু করলেন। কিন্তু কোকো শেষ হয়ে যাওয়ায় তা আর বেশি দিন বানানো যায়নি।

নোনতা নাশতার জন্য পাস্তা ভেজে মসলা ছিটিয়ে নকল চিপস বানিয়ে খেয়েছে দিমার পরিবার। আর বাদামের বিকল্প হিসেবে এক বন্ধু ও প্রতিবেশী ছোলা ভেজে সেটাতে মসলা মিশিয়ে দিয়েছিলেন। গাজায় বাদাম খুব জনপ্রিয় নাশতা। যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গায় এই নোনতা ও মসলাদার বাদাম খাওয়া যায়।

কিন্তু এই ছোলার বাদাম ঘন ঘন বানানো সহজ নয়। কারণ, সবকিছুই খোলা আগুনে তৈরি করতে হয়। এতে সময় বেশি লাগে এবং পরিশ্রম করতে হয় অনেক। এ ছাড়া খোলা আগুনে তা ভাজার সময় ধোঁয়ায় চোখে পানি চলে আসে।

দিমা বলেন, ‘আমরা প্রায়ই মজা করি—আমাদের খাবার নানা রকম, কিন্তু আসলে সবই একই জিনিস। পাস্তা, ছোলা আর সবচেয়ে বেশি মসুর ডাল।’

খিদের ক্ষতিপূরণ

ডাল, পাস্তা—ত্রাণসামগ্রীর জিনিসগুলো গাজার মানুষকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছে। তবে এখন এগুলোও অপ্রতুল আর দামি হয়ে গেছে।

দিমার বোন মরিয়ম বলেছেন, ‘পাস্তা আর ডালের জন্য আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কারণ, এসব একদিন বিকল্প খাবার তৈরি করতে সাহায্য করেছে।’

দিমা বলেন, ‘আমার মনে হয়, আমাদের ক্ষতিপূরণ দরকার। যখন এই ভয়ানক অবরোধ শেষ হবে, আমি সবকিছু খেতে চাই—কেবল সেই সব বাদে, যা এই সময় খেতে হয়েছে।’

প্রতিবার যখন ফল, সবজি, ডিম, মুরগি চেয়ে কিছুই পাননি, তার জন্য ক্ষুধায় মাথা ঘুরে যাওয়া প্রতিটি মুহূর্তের জন্য ক্ষতিপূরণ চান দিমা ফায়্যাদ। প্রতিবার খাবারের সময় যখন শুধু ডাল সামনে ছিল, তার জন্যও ক্ষতিপূরণ চান তিনি।