ট্রাম্পের ওপর কেন হামাস এতটা আস্থা রাখছে
হামাস একসময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ‘বর্ণবাদী’ ও ‘অরাজকতার কারিগর’ বলেছিল। গাজা সম্পর্কে তিনি ‘অযৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি’ পোষণ করেন বলেও আখ্যা দিয়েছিল ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠনটি।
তবে গত মাসে নজিরবিহীন এক ফোনালাপের পর হামাসের মধ্যে বিশ্বাস জন্মেছিল, তারা সব জিম্মিকে মুক্তি দিলে ট্রাম্প হয়তো ইসরায়েলকে শান্তিচুক্তিতে বাধ্য করতে পারবেন। ইসরায়েলি এসব জিম্মি এত দিন গাজা যুদ্ধে হামাসের বড় হাতিয়ার ছিল। দুই ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা এমনটা জানিয়েছেন।
সে সময় ওই ফোনালাপ ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল। গত সেপ্টেম্বরে হোয়াইট হাউসে এক বৈঠক শেষে ট্রাম্প ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে একটি টেলিফোন ধরিয়ে দেন এবং ফোনে কাতারের প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাইতে বলেন।
গত মাসের শুরুর দিকে কাতারের রাজধানী দোহায় ভয়াবহ বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। এ হামলার লক্ষ্য ছিল গাজা যুদ্ধের অবসান ঘটাতে দোহায় অবস্থানরত খলিল আল–হায়াসহ হামাসের শীর্ষ মধ্যস্থতাকারীদের হত্যা করা। কিন্তু ইসরায়েলের এ লক্ষ্য সফল হয়নি। কাতারে হামলা চালানোর কারণেই নেতানিয়াহুকে ফোনালাপে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেন।
ফিলিস্তিনি ওই দুই কর্মকর্তা বলেন, ট্রাম্প কাতারের বিষয়টি ভালোভাবে সামাল দেওয়ায় হামাস নেতাদের মধ্যে বিশ্বাস আরও জোরালো হয়েছিল যে তিনি যুদ্ধের অবসানের বিষয়ে আন্তরিক এবং তিনিই নেতানিয়াহুকে মোকাবিলা করতে পারবেন।
আর গত বুধবার ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়ে যাওয়ার পর তাঁর প্রতি হামাসের বিশ্বাস আরও বেড়ে গেছে। অথচ এই ট্রাম্পই চলতি বছর গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করে সেটিকে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত একটি ‘অবকাশযাপনকেন্দ্রে’ পরিণত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
আর গত বুধবার ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়ে যাওয়ার পর তাঁর প্রতি হামাসের বিশ্বাস আরও বেড়ে গেছে। অথচ এই ট্রাম্পই চলতি বছর গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করে সেটিকে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত একটি ‘রিসোর্টে’ পরিণত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
গত শুক্রবার গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হয়েছে। চুক্তিতে গাজা থেকে পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহারের কোনো নিশ্চয়তা ছাড়াই ইসরায়েলি সব জিম্মিকে মুক্তি দিতে রাজি হয় হামাস। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গতকাল সোমবার জীবিত ২০ জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
হামাসের অন্য দুই ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, চুক্তিতে রাজি হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বাজি ধরেছে হামাস। পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে এই মনোভাবের ওপর—ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তির জন্য এত পরিশ্রম করেছেন যে তিনি এটি ভেস্তে যেতে দেবেন না।
এক ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা বলেন, হামাস নেতারা ভালো করেই জানেন, এই বাজির দান উল্টে যেতে পারে। তাঁদের আশঙ্কা, একবার বন্দীরা মুক্তি পেলে ইসরায়েল আবারও সামরিক অভিযান শুরু করতে পারে। গত জানুয়ারিতে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির পর ঠিক এমনটাই ঘটেছিল। ওই যুদ্ধবিরতির সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসন ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল।
মিসরের শারম আল–শেখে গাজা শান্তি সম্মেলনে ইসরায়েলের সঙ্গে পরোক্ষ আলোচনায় ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা ও বিশ্বনেতাদের উপস্থিতিতে হামাসকে যথেষ্ট আশ্বস্ত করেছে। যদিও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের পদক্ষেপসহ তাদের অনেক মৌলিক দাবি এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে অস্পষ্টতা
ট্রাম্পের ২০ দফাবিশিষ্ট গাজা শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপ হয়তো যুদ্ধের অবসানের পথ সুগম করতে পারে। তবে এ পরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপ বাস্তবায়ন হওয়া নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
কিন্তু ট্রাম্প যেভাবে কাতার হামলার ঘটনা মিটমাট ও গত জুনে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে হওয়া ১২ দিনের যুদ্ধের অবসান করেছেন, তাতে হামাসের মধ্যস্থতাকারীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে জিম্মিরা মুক্তি পাওয়ার পর ইসরায়েলকে আবার যুদ্ধ শুরু করতে দেবেন না মার্কিন প্রেসিডেন্ট। দুই ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা ও অন্য একটি সূত্র রয়টার্সকে এমনটা জানিয়েছে।
ওয়াশিংটনের একটি সূত্র জানিয়েছে, কাতার হামলাকে কেন্দ্র করে নেতানিয়াহুর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন ট্রাম্প। আর নেতানিয়াহুকে যুদ্ধবিরতির পরিকল্পনা মেনে নিতে চাপ দেওয়ার জন্য ট্রাম্পের এই ক্ষোভকে কাজে লাগান তাঁর সহযোগীরা।
ট্রাম্পের ২০ দফাবিশিষ্ট গাজা শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপ হয়তো যুদ্ধের অবসানের পথ সুগম করতে পারে। তবে এ পরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপ বাস্তবায়ন হওয়া নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
হোয়াইট হাউসের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ট্রাম্পের বিস্তৃত কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে তিনি সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। কাতারের আমিরকে তিনি একজন বন্ধু বলে মনে করেন। তিনি কাতারে ইসরায়েলের হামলাকে ভালোভাবে নেননি।
হোয়াইট হাউসের এই কর্মকর্তা কাতারে হামলাকে একটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা বলে মনে করছেন, যা আরব দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য জোরদার করেছে।
ট্রাম্প প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, কাতারে আর কখনো এ ধরনের হামলা চালাবে না ইসরায়েল। এই ঘোষণা হামাস ও অন্যান্য আঞ্চলিক গোষ্ঠীর চোখে ট্রাম্পের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে।
ইসরায়েলের বার–ইলান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অধ্যয়ন বিভাগের জোনাথান রেইনহোল্ড বলেন, ‘তিনি (ট্রাম্প) কাতারকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে ইসরায়েল আর হামলা করবে না। এ বিষয়টি হামাসের মনে যুদ্ধবিরতি অটুট থাকা নিয়ে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে।’
গাজার এক ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা বলেন, ইরান–ইসরায়েল সংঘাত বন্ধের জন্য প্রকাশ্যে নির্দেশ দিয়েছিলেন ট্রাম্প। এ বিষয়টিও হামাস নেতাদের মনে বিশ্বাস জোরদার করতে সহায়তা করেছে।