গাজায় বন্দিবিনিময়: দীর্ঘদিন পর স্বজনদের কাছে পেয়ে উচ্ছ্বাস

গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং বন্দিবিনিময় চুক্তির অংশ হিসেবে মুক্তি পেয়েছেন ফিলিস্তিনি নারী নিদা জাগেবি। দীর্ঘদিন পর কাছে পেয়ে দুই মেয়েকে মায়ের আলিঙ্গন। গতকাল পশ্চিম তীরের জেনিনেছবি: রয়টার্স

ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর প্রথম ধাপের বন্দিবিনিময় সম্পন্ন হয়েছে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ইসরায়েলি তিন নারী জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে। বিপরীতে ৯০ ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুকে মুক্তি দিয়েছে ইসরায়েল। দীর্ঘদিন পর প্রিয় মানুষদের কাছে পেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন স্বজনেরা।

এদিকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা। তবে তাঁদের বেশির ভাগের বাড়িঘরই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।

গত রোববার তিন ইসরায়েলি জিম্মি মুক্তি পেয়ে প্রথমে স্বজনদের সঙ্গে দেখা করেন। এরপর তাঁদের মধ্য ইসরায়েলের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সদ্য মুক্তি পাওয়া এসব জিম্মির অবস্থা স্থিতিশীল বলে জানান চিকিৎসকেরা।

তিন জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর রোববার দিবাগত রাত একটার দিকে বাসে করে ইসরায়েলের দখলকৃত পশ্চিম তীরের ওফের কারাগার ছাড়েন ফিলিস্তিনি বন্দীরা। পার্শ্ববর্তী বেইতুনিয়া শহরে পৌঁছালে বিপুলসংখ্যক ফিলিস্তিনি তাঁদের বরণ করে নেন।

এর আগে ঘোষিত সময়ের চেয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা পর রোববার সকালে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এরপর ১৫ মাস ধরে চলা যুদ্ধে ক্লান্ত বাসিন্দারা বিধ্বস্ত উপত্যকায় নিজেদের বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেন।

‘বাড়ি বলতে কিছুই নেই’

ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হামলায় গাজার বড় অংশই এখন বিরান ভূমি। উত্তর গাজার জাবালিয়ায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া সড়কের বালু মাড়িয়ে কয়েক শ বাসিন্দাকে বাড়ি ফিরতে দেখা যায়। সড়কের দুই পাশে ছিল মহাধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন।

জাবালিয়ায় ফিরেছেন ৪৩ বছর বয়সী রানা মোহসেন। তিনি বলেন, ‘অবশেষে আমরা আমাদের বাড়িতে। তবে কেবলই ধ্বংসস্তূপ, বাড়ি বলতে কিছুই নেই। এরপরও এটাই আমাদের ঠাঁই নেওয়ার জায়গা।’

এদিকে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গতকাল সোমবার জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ৪৭ হাজার ৩৫ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ১১ হাজার ৯১ জন। রোববার যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার আগের ২৪ ঘণ্টায় ৬০ ফিলিস্তিনি নিহত হন। এ ছাড়া ২৪ ঘণ্টায় ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে আরও ৬২ ফিলিস্তিনির মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

এর আগে গাজার জরুরি পরিষেবা বিভাগ বলেছে, মরদেহের খোঁজে বিধ্বস্ত ভবনের ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ শুরু করেছে তারা। ধারণা করা হচ্ছে, বিধ্বস্ত বাড়িঘর ও স্থাপনার নিচে প্রায় ১০ হাজার মরদেহ পড়ে আছে।

‘পরিবারের সান্নিধ্যে’

আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, সদ্য মুক্তি পাওয়া বন্দীরা স্বজনদের কাছে ফিরলে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। প্রথম ধাপে ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া ৯০ ফিলিস্তিনির একজন রুলা হাসনেইন।

২৯ বছর বয়সী এই নারী সাংবাদিককে গত বছরের ১৯ মার্চ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ওই সময় তাঁর ৯ মাসের দুধের শিশু থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েলি সামরিক আদালত তাঁকে জামিন দেননি। রুলার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহিংসতায় উসকানি দিয়েছেন।

ইসরায়েলের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া আরেকজন খালিদা জাররার। তিনি রাজনীতিবিদ ও অধিকৃত পশ্চিম তীরের পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের (পিএফএলপি) নেতা। খালিদা জাররার একসময় ফিলিস্তিনের পার্লামেন্ট সদস্য ছিলেন। ইসরায়েলে তাঁকে নির্জন কারাকক্ষে রাখা হয়েছিল। মুক্তির পর খালিদার শীর্ণ চেহারা দেখে অবাক হয়েছেন অনেকেই।

মুক্তি পাওয়া তিন ইসরায়েলি জিম্মি হলেন রোমি গোনেন (২৪), এমিলি দামারি (২৮) ও দোরোন স্টেইনব্রিচার (৩১)। এমিলির মা মান্দি দামারি বলেন, ‘৪৭১ দিন পর অবশেষে এমিলি বাড়ি ফিরল। কিন্তু আরও অনেক পরিবারের অসম্ভব এই প্রতীক্ষা অব্যাহত রয়েছে।’

প্রথম দিন ঢুকল ৬৩০টি ত্রাণের ট্রাক

যুদ্ধবিরতির অন্যতম শর্ত ছিল গাজায় ত্রাণ সরবরাহ বাড়ানো। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর রোববার প্রথম দিন ৬৩০টি ত্রাণের ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। এসব ট্রাকের ৩০০টি পাঠানো হয়েছে সাম্প্রতিক স্থল অভিযানে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উত্তর গাজায়।

তবে জাতিসংঘের ত্রাণসহায়তা বিষয়ক প্রধান আন্ডার সেক্রেটারি-জেনারেল টম ফ্লেচার বলেছেন, গাজায় ত্রাণ সরবরাহে সময় নষ্ট করার কোনো সুযোগ নেই। ১৫ মাসের বিরামহীন যুদ্ধের কারণে এখানে মানবিক সহায়তার চাহিদা অভাবনীয় পর্যায়ের।

চুক্তি অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে তিন ধাপে। প্রথম ধাপের ছয় সপ্তাহে ৩৩ জিম্মিকে মুক্তি দেবে হামাস। বিপরীতে প্রায় ১ হাজার ৯০০ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেবে ইসরায়েল। আগামী সপ্তাহে চার ইসরায়েলিকে মুক্তি দেওয়ার কথা রয়েছে।

এদিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষেকের আগের দিন স্থানীয় সময় রোববার এক সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির কৃতিত্ব দাবি করেছেন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেন, নভেম্বরের বিজয়ের কারণে এটা সম্ভব হয়েছে।