যুদ্ধাপরাধে ইসরায়েল ও হামাস উভয়েই দায়ী : জাতিসংঘ

ইসরায়েলি বোমা হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে জাতিসংঘের একটি স্কুল। সম্প্রতি গাজায়ছবি : রয়টার্স

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস-উভয়ই গাজা যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে যুদ্ধাপরাধ করেছে। একই সঙ্গে গাজায় ইসরায়েলের হামলার কারণে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। কারণ, ইসরায়েলি হামলায় অসংখ্য বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। আজ বুধবার জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলা ও এরপর গাজায় ইসরায়েলের পাল্টা হামলা নিয়ে জাতিসংঘের কমিশন অব ইনকোয়ারি (সিওআই) দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তিনটি স্বাধীন বিশেষজ্ঞ সংস্থার সমন্বয়ে সিওআই গঠিত। ওই প্রতিবেদনে ইসরায়েল ও হামাসের যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি উঠে এসেছে।

এ তদন্তে কমিশনকে কোনো সহযোগিতা করেনি ইসরায়েল। এ ছাড়া প্রতিবেদন ইসরায়েলবিরোধী পক্ষপাত বলে তারা প্রত্যাখ্যান করেছে। হামাসের পক্ষ থেকে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।

গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের আকস্মিক হামলায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। এ সময় ২৫০ জনকে জিম্মি করেন হামাস সদস্যরা। এর প্রতিশোধ নিতে হামাসকে নির্মূল করার কথা বলে গাজায় ব্যাপক হামলা শুরু করে ইসরায়েল। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ৮ মাসের বেশি হামলায় ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ৩৭ হাজার ২০২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যার অধিকাংশই নারী ও শিশু। এ ছাড়া গাজার ২৩ লাখ মানুষের অধিকাংশই আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন। সেখানে ভয়াবহ মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে।

আগামী সপ্তাহে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের সভায় প্রতিবেদনটি নিয়ে আলোচনা হবে। জাতিসংঘের সংগ্রহ করা এ ধরনের তদন্ত প্রতিবেদন কখনো কখনো যুদ্ধাপরাধের বিচারের ভিত্তি হয়ে ওঠে। জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। গত মাসে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তাঁর প্রতিরক্ষা প্রধানের পাশাপাশি তিনজন হামাস নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আইসিসি।

গত ৭ অক্টোবর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনা স্থান পেয়েছে সিওআইয়ের এই প্রতিবেদনে। প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে, অভিযোগের প্রেক্ষিতে, স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি বিশ্লেষণ করে, মেডিকেল রিপোর্ট এবং উন্মুক্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে হামাসের বিরুদ্ধে ‘ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক মানুষের ওপর হামলা চালানো’ এবং তাদের ‘হত্যা ও ইচ্ছাকৃত খুনের’ অভিযোগ করা হয়েছে। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে ‘নির্যাতন, অমানবিক ও নিষ্ঠুর আচরণ’ এবং ইসরায়েলের জনবহুল এলাকায় নির্বিচার রকেট হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে।

৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের আকস্মিক হামলার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুড়িয়ে, অঙ্গচ্ছেদ ও শিরশ্ছেদের মাধ্যমে মরদেহ অপবিত্র করা হয়েছে। এ ছাড়া মৃতদেহের ওপর অত্যাচার ও যৌন সহিংসতার অভিযোগ আনা হয়েছে।

তালিকায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কৌশল হিসেবে মানুষকে অভুক্ত রাখা, হত্যা বা ইচ্ছাকৃত খুন, বেসামরিক জনগণ ও তাদের বিভিন্ন স্থাপনায় ইচ্ছাকৃতভাবে হামলা চালানো, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা, যৌন সহিংসতার মতো অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণকে সামষ্টিক শাস্তি দিয়েছে ইসরায়েল।

যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টা

যুক্তরাষ্ট্র, মিসর ও কাতার দীর্ঘদিন ধরেই যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির জন্য মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করছে। এখনো হামাসের কাছে ১০০ জনের বেশি জিম্মি রয়েছে। গত ৩১ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দেওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে হামাস।

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠনটি বলেছে, তাদের ‘ইতিবাচক’ সাড়া এ উপত্যকায় আট মাস ধরে চলা যুদ্ধের অবসানে একটি চুক্তিতে পৌঁছার ক্ষেত্রে ‘সুপ্রশস্ত পথ’ খুলে দিয়েছে। তারা চায় এমন এক যুদ্ধবিরতি, যার মধ্য দিয়ে গাজায় বৈরিতার স্থায়ী অবসান ঘটবে।

হামাসের এমন ইতিবাচক মনোভাবের পরও এই সংগঠন বা ইসরায়েল-কোনো পক্ষ চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত না করায় ওই প্রস্তাবের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বলে বিশ্লেষকেরা জানাচ্ছেন।

গত ৩১ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষিত গাজা যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের ওপর গত মঙ্গলবার ওই আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায় হামাস। তবে ইসরায়েল বলেছে, এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করারই শামিল। কেননা হামাসের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, বর্তমান পরিকল্পনায় তাঁদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতিফলন নেই।

গতকাল হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য ইজ্জাত আল-রিশক বলেন, এক বিবৃতিতে হামাস যে জবাব দিয়েছে, তা ‘দায়িত্বশীল, গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক’। এটি যুদ্ধবিরতি বিষয়ে চুক্তি সইয়ের ‘এক সুপ্রশস্ত পথ’ খুলেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে হামাসের এ প্রতিক্রিয়াকে ইতিবাচক বলে ধরা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন কাতার সফর করছেন।

যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনার মধ্যেও গাজা ও রাফায় ব্যাপক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একাধিকবার বলেছেন, হামাসকে নির্মূল না করা পর্যন্ত অভিযান বন্ধ করবেন না তিনি।