ইয়েমেনের ঘটনা দেখিয়ে দিল সৌদি আরব ও আমিরাত পরস্পরকে কতটা অবিশ্বাস করে
ইয়েমেনে সৌদি জোটের বিমান হামলার পর দেশটি থেকে নিজেদের সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। পদক্ষেপটি সৌদি–আমিরাত উত্তেজনা কমাতে সহায়ক হবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এ ঘটনায় উপসাগরীয় তেলসমৃদ্ধ দেশ দুটির মধ্যকার দীর্ঘদিনের মতবিরোধ ও বিশ্বাসের ঘাটতি থাকার বিষয়টি স্পষ্টভাবে ধরা দিয়েছে।
সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট গত মঙ্গলবার ভোরে ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় মুকাল্লা বন্দরে বিমান হামলা চালায়। এর পরপরই আরব আমিরাত তাদের সেনাদের ইয়েমেন ছাড়ার নির্দেশ দেয়।
আরব আমিরাত বলেছে, তারা এ বিমান হামলার ঘটনায় বিস্মিত। এর ঠিক পরেই তারা ঘোষণা দেয় যে সেনাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ইয়েমেন থেকে তাঁদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে।
সৌদি ও আমিরাতের মধ্যকার এ সংকটের সূত্রপাত ডিসেম্বরের শুরুর দিকে। ওই সময় দক্ষিণ ইয়েমেনে আমিরাত–সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা হঠাৎ অগ্রসর হতে শুরু করলে উত্তেজনা তৈরি হয়। এর মধ্য দিয়ে তেল খাতে কোটাব্যবস্থা থেকে শুরু করে ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে দুই উপসাগরীয় দেশের মধ্যকার বিরোধের বিষয়টি সামনে চলে আসে।
সৌদি আরবের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত একটি উপসাগরীয় সূত্র রয়টার্সকে বলেছে, গত নভেম্বরে ওয়াশিংটনে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠক নিয়ে ভুল–বোঝাবুঝিকে কেন্দ্র করে এ উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।
সূত্রটি আরও বলেছে, ডিসেম্বর থেকে সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের আলোচনা ও ফোনালাপ হয়েছে। তবে তা এখনো বাস্তব কোনো ফল দেয়নি।
সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলে তা আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ উপসাগরীয় অঞ্চলের জন্য অশান্তি তৈরি করবে। কারণ, এ অঞ্চলটি নিজেদেরকে অস্থির মধ্যপ্রাচ্যে একটি স্থিতিশীল এলাকা হিসেবে দেখাতে চায়।
এ দুই দেশের মধ্যে মতবিরোধ থাকলে তেলের উৎপাদন নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো কঠিন হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় উভয় দেশই আগামী রোববার অন্যান্য ওপেক প্লাস সদস্যদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল বৈঠকের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
গবেষণাপ্রতিষ্ঠান চাথাম হাউসের সহযোগী ফেলো নিল কুইলিয়াম বলেন, ‘দুই দেশের সম্পর্ক কখনোই স্বাচ্ছন্দ্যের ছিল না। তবে বর্তমান উত্তেজনা গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র মনে হচ্ছে।’
এসটিসির অগ্রসর হওয়া
ডিসেম্বরের শুরুতে হঠাৎ অগ্রসর হতে শুরু করা আমিরাত–সমর্থিত সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিল (এসটিসি) ইতিমধ্যে ইয়েমেনের বড় অংশ দখল করে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হাজরামাউত প্রদেশ।
অথচ একসময় এসটিসি সৌদি–সমর্থিত ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইয়েমেন সরকারের সঙ্গে জোট বেঁধে ইরান–সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। হুতিরা ইয়েমেনের রাজধানী সানা ও জনবহুল উত্তর–পশ্চিমাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে।
সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলে তা আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ উপসাগরীয় অঞ্চলের জন্য অশান্তি তৈরি করবে। কারণ, এ অঞ্চল নিজেদেরকে অস্থির মধ্যপ্রাচ্যে একটি স্থিতিশীল এলাকা হিসেবে দেখাতে চায়।
দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হওয়ার মধ্য দিয়ে এসটিসি সৌদি আরব–সংলগ্ন ইয়েমেন সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এটি এমন একটি এলাকা, যেটিকে সৌদি নাগরিকদের অনেকে নিজেদের আদি নিবাস বলে বিবেচনা করে থাকেন। তাঁদের কাছে ওই এলাকার সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে।
একই সঙ্গে হামলার ঘটনা সৌদি আরব ও আমিরাতকে ২০১৪ সালে শুরু হওয়া ইয়েমেনের দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের বিপরীত পাশে দাঁড় করিয়েছে।
সৌদি আরব ও আরব আমিরাত উভয়ই প্রকাশ্যে বলেছে, তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ইয়েমেনের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলছে। তবে গত কয়েক দিনে ওই প্রদেশে দুবার বিমান হামলা চালিয়েছে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট।
এসটিসিকে দখলকৃত এলাকা থেকে সরে যেতে বলেছে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট। তবে এসটিসি তা প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলেছে, হাজরামাউত ও পূর্বের মাহরা প্রদেশে নিরাপত্তা বজায় রাখতে তারা অভিযান চালিয়ে যাবে।
সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত উভয়ই প্রকাশ্যে বলেছে, তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ইয়েমেনের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলছে। তবে গত কয়েক দিনে ইয়েমেনে দুবার বিমান হামলা চালিয়েছে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট।
মুকাল্লায় হামলার বিষয়ে এক বিবৃতিতে আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষ বলেছে, এসটিসি অগ্রসর হতে শুরু করার পর থেকে তারা উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা করেছে। তাদের দাবি, সৌদি আরবের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর আঘাত বা সীমান্ত লক্ষ্য করে অভিযান চালানোর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
সুদানের বিষয়ে মতপার্থক্য
কুইলিয়াম বলেন, ‘দুই দেশই তাদের সম্পর্কের দ্বন্দ্ব কম করে দেখানোর চেষ্টা করে। তারা যুক্তি দেখায় যে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু গত বছর হঠাৎ প্রতিযোগিতা অনেক বেড়ে গেছে এবং একাধিক জায়গায় তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।’
দুই দেশই তাদের সম্পর্কের দ্বন্দ্বকে কম করে দেখানোর চেষ্টা করে। তারা যুক্তি দেখায় যে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু গত বছর হঠাৎ প্রতিযোগিতা অনেক বেড়ে গেছে এবং একাধিক জায়গায় তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।নিল কুইলিয়াম, চাথাম হাউসের সহযোগী ফেলো
ওই দুই দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও মতপার্থক্যের এমন একটি জায়গা হলো সুদান। দেশটিতে ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে গৃহযুদ্ধ চলছে এবং দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকটের মধ্যে আছে। সৌদি আরব, মিসর, যুক্তরাষ্ট্র ও আমিরাত মিলে গঠিত কোয়াড জোট কূটনৈতিক উদ্যোগ নিলেও সুদানে সংঘাত বেড়েই চলেছে।
আরব আমিরাতের জন্য সুদান একটি স্পর্শকাতর বিষয়। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ ও মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন, আরব আমিরাত সুদানের আধা সামরিক বাহিনী আরএসএফকে সমর্থন দিচ্ছে। আরএসএফ সুদানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে।
তবে আরব আমিরাত কোনো পক্ষকেই সমর্থন করার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
নভেম্বরে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ট্রাম্প ও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সুদান প্রসঙ্গে আলোচনা করেন। উপসাগরীয় একটি সূত্র বলেছে, ওই বৈঠককে কেন্দ্র করে আরব আমিরাতের নেতারা ক্ষুব্ধ ছিলেন। কারণ, তাঁরা বৈঠক নিয়ে একটি ভুল তথ্য পেয়েছিলেন। তাঁদের বলা হয়েছিল যে বৈঠকে সৌদি যুবরাজ শুধু আরএসএফের বিরুদ্ধে আরও নিষেধাজ্ঞাই চাননি; বরং গোষ্ঠীটিকে সমর্থনের অভিযোগে আমিরাতের বিরুদ্ধেও সরাসরি নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছেন।
সূত্রটির মতে, এ ভুল–বোঝাবুঝিই ইয়েমেনে উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়। আমিরাতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে সরাসরি স্বীকার বা অস্বীকার কিছুই করেনি। তারা গত শুক্রবার দেওয়া একটি বিবৃতির কথা উল্লেখ করেছে। সেখানে বলা হয়, ইয়েমেনে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সৌদি আরবের চেষ্টাকে স্বাগত জানায় আমিরাত। একই সঙ্গে আমিরাতও দেশটির স্থিতিশীলতার পক্ষে থাকার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
অতীতের অস্থিতিশীলতা
আমিরাতের প্রেসিডেন্টের কূটনৈতিক উপদেষ্টা আনোয়ার গারগাশ গত শনিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে বলেন, সংলাপ ও রাজনৈতিক সমাধান অপরিহার্য, যা বন্ধুত্ব ও জোটকে রক্ষা করে। তিনি সরাসরি ইয়েমেন বা সৌদি আরবের কথা উল্লেখ করেননি।
এ বিষয়ে হোয়াইট হাউসের বক্তব্য জানার চেষ্টা করেছিল রয়টার্স। তবে তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া পাওয়া যায়নি।
উপসাগরীয় অঞ্চল অতীতেও অস্থিতিশীলতার সাক্ষী হয়েছিল। ২০১৭ সালে কাতারের বিরুদ্ধে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, বাহরাইন, ওমান ও মিসর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছিল। তারা অভিযোগ করেছিল, দেশটি সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন দিচ্ছে। তবে কাতার সে অভিযোগ অস্বীকার করে।
এবারের উত্তেজনা কাতার সংকটের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে বলে মনে হচ্ছে না।
আমিরাতভিত্তিক বিশেষজ্ঞ আবদুলখালেক আবদুল্লাহ বলেন, ‘ইয়েমেন নিয়ে আমাদের শতভাগ মতভেদ আছে এবং বর্তমান উত্তেজনার সঙ্গে সঙ্গে সে মতভিন্নতা আরও বেড়েছে। মিত্রদেরও ঝগড়া হয়…কিন্তু তারা তাদের মতবিরোধ মেটায় এবং অভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট দিকগুলো শক্তিশালী করে।’