কিশোরী বিক্ষোভকারীকে যৌন নিপীড়ন ও হত্যার অভিযোগ ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে

নিকা শাকারামিআরব নিউজের এক্স পোস্ট থেকে সংগৃহীত

ইরানে নিকা শাকারামি নামের এক কিশোরী বিক্ষোভকারী যৌন হয়রানি ও হত্যার শিকার হয়েছে। ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর ফাঁস হওয়া একটি নথির বরাত দিয়ে বিবিসির খবরে জানানো হয়েছে, ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর হয়ে কাজ করেন—এমন তিনজন ওই কিশোরীকে যৌন হয়রানি ও হত্যা করেছেন।  

২০২২ সালে ইরানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলাকালে নিখোঁজ হয় ১৬ বছরের নিকা শাকারামি। বিক্ষোভ থেকে নিখোঁজ হওয়ার এক সপ্তাহ পর একটি মর্গে নিকার মরদেহ খুঁজে পায় পরিবার। তবে ইরানের সরকার বিক্ষোভের সঙ্গে নিকার মৃত্যুর ঘটনায় যোগসূত্র থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ইরান সরকার নিজেরাই একটি তদন্ত চালিয়েছিল। সে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, নিকা আত্মহত্যা করেছে।

তবে ফাঁস হওয়া একটি গোপন নথির তথ্য বলছে অন্য কথা। ‘অত্যন্ত গোপনীয়’ হিসেবে চিহ্নিত করা ওই প্রতিবেদনে নিকার মৃত্যুর ঘটনায় হওয়া একটি শুনানির সারাংশ উল্লেখ করা হয়েছে। ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি) ওই শুনানি করেছিল। ওই নথিতে নিকার হত্যাকারীদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যে জ্যেষ্ঠ কমান্ডাররা সত্য লুকাতে চেয়েছিলেন, তাঁদের নামও উল্লেখ করা হয়েছে।

সরকারি নথির নামে ইরানে অসংখ্য ভুয়া নথি প্রকাশ পেয়েছে। কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে এসব নথির সত্যতা যাচাই করেছে বিবিসি। নথি যাচাই করতে গিয়ে দেখা গেছে, নিকাকে নিয়ে ফাঁস হওয়া প্রতিবেদনে তার শেষ সময়ের অনেক গতিবিধির উল্লেখ আছে।

বিক্ষোভকারী নিকা শাকারামির নিখোঁজ হওয়া এবং তাঁর মৃত্যুর খবরটি ইরানে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। ইরানে নিজেদের স্বাধীনতা চেয়ে আন্দোলনরত নারীদের কাছে নিকা শাকারামির ছবিটি লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে। দ্য উইমেন, লাইফ, ফ্রিডম মুভমেন্ট নামের এ আন্দোলন শুরু হয়েছিল মূলত ২২ বছর বয়সী তরুণী মাসা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। জাতিসংঘের একটি সত্য অনুসন্ধান মিশনের তদন্তে দেখা গেছে, পুলিশি হেফাজতে আঘাতের কারণে মাসা মারা যান। যথাযথভাবে হিজাব না পরার অভিযোগে তাঁকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল।  

যেভাবে নিখোঁজ হন নিকা

নিখোঁজ হওয়ার আগে সর্বশেষ ২০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় নিকা শাকারামিকে তেহরানের লালেহ পার্ক এলাকার কাছে দেখা গিয়েছিল। সেখানে ধারণ করা এক ভিডিওতে দেখা গেছে, আবর্জনা রাখার বড় একটি কনটেইনারের ওপর নিকা দাঁড়িয়ে আছে এবং হিজাবে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। তার আশপাশে থাকা বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দিচ্ছিলেন, ‘একনায়ক নিপাত যাক।’ একনায়ক বলতে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লা আলী খামেনিকে বোঝাচ্ছিলেন তাঁরা।

বিক্ষোভ করার সময় নিকা শাকারামি হয়তো জানতে পারেনি তাকে নজরে রাখা হচ্ছে। তবে গোপন নথির তথ্য বলছে, নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকটি গোয়েন্দা দল তাকে নজরে রেখেছিল। এর একটি হলো টিম টুয়েলভ। তারা সন্দেহ করছিল, ওই কিশোরী বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছে। বিষয়টি নিশ্চিত হতে দলটি তাদের কয়েক সদস্যকে বিক্ষোভস্থলে পাঠিয়েছিল। তাঁরা বিক্ষোভকারী সেজে সেখানে গিয়েছিলেন। এরপর নিকাকে গ্রেপ্তারের জন্য তাঁদের নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে সে পালিয়ে যায়।

নিকা শাকারামির এক খালা এর আগে বিবিসির ফারসি সংস্করণে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সে রাতে নিকা তার এক বন্ধুকে ফোন দিয়েছিল। বলেছিল, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাকে ধাওয়া করছে। ফাঁস হওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, পালিয়ে যাওয়ার এক ঘণ্টা পর তাকে খুঁজে বের করা হয়। তাকে আটকের পর ওই দলটির গাড়িতে তোলা হয়। এটি ছিল একটি ফ্রিজার ভ্যান। তবে তাতে বাহিনীর কোনো চিহ্ন ছিল না।

টিম টুয়েলভের তিন সদস্য নিকার সঙ্গে ফ্রিজার ভ্যানের পেছনে বসেছিলেন। তাঁরা হলেন আরশ কালহর, সাদেগ মনজাজি এবং বেহরুজ সাদেগি। আর ওই দলের নেতা মোর্তেজা জলিল সামনে চালকের পাশে বসেছিলেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, নিকাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া যায়, তা খোঁজার চেষ্টা করছিল দলটি।

তারা পার্শ্ববর্তী একটি পুলিশ ক্যাম্পে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। তবে বেশি ভিড় দেখে সিদ্ধান্ত পাল্টায়। এরপর তারা আটককেন্দ্রের দিকে রওনা করে। গাড়ি চালিয়ে সেখানে যেতে ৩৫ মিনিট লাগে। শুরুতে ওই আটককেন্দ্রের কমান্ডার নিকাকে সেখানে রাখতে রাজি হলেও পরে আবার অমত করেন। তদন্তকারীদের ওই কমান্ডার বলেছেন, নিকা একটানা স্লোগান দিয়ে যাচ্ছিল। আর তাতে তার আশঙ্কা হয়েছিল, নিকার এমন আচরণ ওই আটককেন্দ্রে থাকা অপর ১৪ নারীকে উসকে দিতে পারে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, মোর্তেজা জলিল আবারও পরামর্শ নেওয়ার জন্য আইআরজিসির সদর দপ্তরে ফোন করেন। তাঁকে কুখ্যাত এভিন কারাগারে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। পথে মোর্তেজা ফ্রিজার ভ্যানের পেছন থেকে ধস্তাধস্তির আওয়াজ পান।

বেহরুজ সাদেগি তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন, আটককেন্দ্র থেকে বেহরুজ সাদেগিকে গাড়িতে তোলার পর সে অন্ধকারের মধ্যে চিৎকার করছিল এবং স্লোগান দিচ্ছিল। তখন আরশ কালহর তাঁর মোজা দিয়ে নিকার মুখ চেপে ধরেন। নিকাও তখন ধস্তাধস্তি শুরু করে। আরশ কালহর জানান, এরপর তিনি মুঠোফোনে টর্চের আলো জ্বালিয়ে দেখতে পান, সাদেগ নিকার ওপর যৌন নিপীড়ন চালাচ্ছেন এবং পরে তাঁরাও তাতে শামিল হন।

একপর্যায়ে গাড়ির সামনে বসা মোর্তেজা চালককে গাড়ি থামাতে বলেন। পরে গাড়ির পেছনের দরজা খুলে দেখা যায় নিকার মৃতদেহ পড়ে আছে। তাঁর মুখ ও মাথা থেকে রক্ত ঝরছিল।

২০২২ সালের অক্টোবরে বিবিসির ফারসি সংস্করণ নিকার মৃত্যুসনদ সংগ্রহ করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, নিকাকে শক্ত কোনো বস্তু দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল। তার শরীরে কয়েকটি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে এবং এ আঘাতের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে।

বিবিসির পক্ষ থেকে ইরান সরকার ও রেভল্যুশনারি গার্ডকে প্রতিবেদনে পাওয়া তথ্যগুলো জানানো হয়েছিল। তবে সাড়া পাওয়া যায়নি।