ফিরে দেখা
যুদ্ধ ছাড়াই ৭ আমিরাতকে কীভাবে একটি রাষ্ট্র বানিয়ে ফেললেন শেখ জায়েদ
গত ২ ডিসেম্বর ঈদ আল-ইত্তিহাদ বা জাতীয় একীভূত হওয়ার ৫৪তম বার্ষিকী উদ্যাপন করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে সাতটি অঞ্চলকে নিয়ে এই রাষ্ট্রগঠনের মূল কারিগর, কীভাবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশে পরিণত হলো, এখানে থাকছে সেই গল্প।
বাংলাদেশ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) মধ্যে জন্মের ব্যবধান মাত্র ১৪ দিনের। তবে এশিয়ার দুই প্রান্তের এ দুই দেশের জন্ম হয়েছিল সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে। বাংলাদেশের জন্ম ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাসংগ্রামের মাধ্যমে। অন্যদিকে সমমনা প্রতিবেশী সাতটি আমিরাতের নেতাদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংযুক্ত দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল ইউএই।
অবশ্য শান্তিপূর্ণ এ সম্মিলনের জন্য আমিরাতগুলোর নেতাদের যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। দীর্ঘ চার বছরের নিবিড় কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় বিশ্বের মানচিত্রে ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর ইউএই নামের নতুন রাষ্ট্রটির অভ্যুদয় ঘটেছিল।
গত মঙ্গলবার ঈদ আল-ইত্তিহাদ বা জাতীয় একীভূত হওয়ার ৫৪তম বার্ষিকী উদ্যাপন করেছে ইউএই। এ উপলক্ষে বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশটির জন্ম কীভাবে হলো, তা একনজরে দেখে নেওয়া যাক।
ট্রুসিয়াল স্টেটস এবং ব্রিটিশ সুরক্ষা
১৯৭১ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রতিষ্ঠার আগে অঞ্চলটি ট্রুসিয়াল স্টেটস নামে পরিচিত ছিল। পারস্য (আরব) উপসাগরের তীরে অবস্থিত সাতটি স্বাধীন শেখরাজ্য বা আমিরাত নিয়ে এ ট্রুসিয়াল স্টেটস গঠিত হয়েছিল। শেখ রাজ্যগুলো হলো আবুধাবি, দুবাই, শারজা, আজমান, উম্ম আল কুওয়াইন, ফুজাইরাহ ও রাস আল খাইমাহ।
উনিশ শতকের শুরুতে শেখশাসিত রাজ্যগুলো ব্রিটিশদের প্রভাব বলয়ে আসার আগপর্যন্ত নিজেদের মতো করে মাছ ও মুক্তার আকর্ষণীয় শিল্প গড়ে তুলেছিল। কিন্তু ১৮১৯ সালে রাস আল খাইমাহ শেখরাজ্যের কাসিমি রাজবংশের বাহিনী ব্রিটিশ ও ভারতীয় নৌবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে পরাজিত হয়।
এর মধ্য দিয়ে অঞ্চলটিতে ব্রিটিশরা আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে। এরপর বিভিন্ন সময়ে আবুধাবিসহ অঞ্চলটির অন্যান্য শেখরাজ্য ব্রিটিশদের সঙ্গে নানা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।
১৮৯২ সালে উল্লিখিত সাত শেখরাজ্য ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে ট্রুসিয়াল স্টেটস নামের একটি চুক্তি সই করে। এতে পারস্য উপসাগরের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি সমুদ্রপথে ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। বিনিময়ে শেখরাজ্যগুলোকে প্রতিরক্ষা ও সামরিক সুরক্ষা দিতে সম্মত হয় তারা।
তবে শেখরাজ্যগুলোকে শর্ত দেওয়া হয়, ব্রিটিশদের অনুমতি ছাড়া তারা অন্য কোনো বিদেশি শক্তির কাছে নিজেদের ভূখণ্ড হস্তান্তর বা চুক্তি করতে পারবে না।
তেল আবিষ্কার ও ঐক্যের প্রচেষ্টা
১৯৬২ সালে আবুধাবিতে প্রথমবারের মতো জ্বালানি তেলের সন্ধান পাওয়া যায়। পরে দুবাই ও শারজাতেও তেল পাওয়া যায়। এর মধ্য দিয়ে অঞ্চলটির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে যায়। তেল উত্তোলনের মধ্য দিয়ে এ তিন শেখরাজ্যে দ্রুতগতিতে উন্নয়ন শুরু হয়।
একপর্যায়ে এসব শেখরাজ্য বা আমিরাতের নেতারা অনুভব করেন, উন্নতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা ও স্বাধীনতা প্রয়োজন। এ জন্য তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই।
এমন একটা সময়ে ১৯৬৮ সালের শুরুর দিকে ব্রিটিশরা ঘোষণা দেয়, অর্থনৈতিক চাপের কারণে তাদের পক্ষে আর বেশি দিন শেখরাজ্যগুলোকে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। ১৯৭১ সালের শেষের দিকে ট্রুসিয়াল স্টেটস চুক্তি থেকে তারা সরে দাঁড়াবে। উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে নিজেদের সেনা প্রত্যাহার করে নেবে।
ব্রিটিশদের এ ঘোষণার পর অঞ্চলটিতে একধরনের রাজনৈতিক শূন্যতা দেখা দেয়। প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়েও আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়।
ইউএইর স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ জায়েদ
ব্রিটিশদের সুরক্ষা প্রত্যাহারের ঘোষণা অধিকাংশ শেখরাজ্যের নেতাদের বিচলিত করলেও ব্যতিক্রম ছিলেন আবুধাবির তৎকালীন নেতা শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল–নাহিয়ান। ব্রিটিশদের চলে যাওয়ার ঘোষণাকে বিপদ হিসেবে না দেখে সুযোগ হিসেবে লুফে নেন তিনি।
১৯৬৬ সালে আবুধাবির নেতৃত্ব গ্রহণকারী এই নেতা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, ট্রুসিয়াল স্টেটসভুক্ত শেখরাজ্যগুলোর ইতিহাস ও সংস্কৃতি অভিন্ন। সম্মিলিতভাবে থাকলেই তাদের ভবিষ্যৎ সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল।
ইতিহাসের এ সময়ে বিশ্ব তীব্র শীতল যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। তা ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে নতুন দেশের জন্ম হচ্ছিল। সবমিলিয়ে বিশ্ব একটি বড় ধরনের ভূরাজনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল।
এ সময়ে প্যান আরব আন্দোলনও শক্তিশালী ছিল। এমন একটি রাজনৈতিক আবহে ফেডারেশন গঠনের জন্য প্রতিবেশী শেখরাজ্যের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছিলেন শেখ জায়েদ।
শেখ জায়েদ অন্য ছয় আমিরাতিপ্রধানদের বোঝানোর চেষ্টা করেন, ‘প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে আমাদের দিকে বিদেশি শক্তির নজর পড়েছে। আমাদের মতো ছোট রাজ্যের পক্ষে শক্তিশালী বিদেশি কোনো শক্তিকে এককভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। ব্রিটিশরাও চলে যাচ্ছে। তাই এখন আত্মরক্ষার্থে আমাদের একজোট হতে হবে। নিজেদের সুরক্ষার জন্য ফেডারেল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই আমাদের জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায়। এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমরা শক্তিভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব।’
ঐতিহাসিক আবুধাবি-দুবাই চুক্তি
১৯৬৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আবুধাবির শাসক শেখ জায়েদ আল-সামহা নামের এলাকায় দুবাইয়ের শাসক শেখ রশিদ বিন সাইদ আল-মাকতুম এক ঐতিহাসিক বৈঠকে মিলিত হন। দুই আমিরাতের সীমান্তবর্তী এ এলাকায় তাঁরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সম্মত হন। এ চুক্তিকে ইউএই প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়।
চুক্তিতে বলা হয়েছিল, উভয় আমিরাত একটি ইউনিয়নে একীভূত হবে। পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তানীতি এবং সামাজিক সেবা খাত যৌথভাবে পরিচালনা করা হবে। একটি সাধারণ অভিবাসননীতি চালু করা হবে।
৯ রাষ্ট্রের ফেডারেশন গঠনের চেষ্টা
শেখ জায়েদ ও শেখ রশিদ শুরুতে বাহরাইন ও কাতারের শাসকদের নিয়ে বৃহত্তর ফেডারেশন গঠনের চেষ্টা করেছিলেন। এ উদ্দেশ্যে ৯ আমিরাতের শাসকেরা একটি আলোচনা সভায় মিলিত হয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালের ২৫ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৯ শাসক দুবাইয়ে টানা আলোচনা করেন।
প্রাথমিক আলোচনায় তাঁরা ১১টি মূলনীতি নিয়ে একমত হয়েছিলেন। কথা ছিল, এই ১১ মূলনীতির ভিত্তিতে ‘আরব আমিরাত ফেডারেশন’ প্রতিষ্ঠা হবে। কিন্তু রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক মতপার্থক্য কমিয়ে আনতে না পারায় শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। কাতার ও বাহরাইন নিজেদের মতো স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার পথ বেছে নেয়।
ছয় রাষ্ট্র নিয়ে যাত্রা শুরু
১৯৭১ সালের মাঝামাঝি সময়ে নতুন একটি বিকল্প পরিকল্পনা নিয়ে ট্রুসিয়াল স্টেটসের ছয় দেশের শাসকেরা আলোচনা শুরু করেন। ১৯৭১ সালের ১৮ জুলাই আবুধাবি, দুবাই, শারজা, আজমান, উম্ম আল কুওয়াইন ও ফুজাইরাহর শাসকেরা নতুন ফেডারেশন গঠনের বিষয়ে সম্মত হন।
১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর ‘দৌলত আল–ইমারাত আল–অ্যারাবিয়া আল মুত্তাহিদা’ বা সংযুক্ত আরব আমিরাতকে আনুষ্ঠানিকভাবে সার্বভৌম দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। রাস আল খাইমাহ ১৯৭২ সালে ১০ ফেব্রুয়ারি ফেডারেশনে যোগ দিলে ট্রুসিয়াল স্টেটসভুক্ত সাত আমিরাতের সমন্বয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রগঠনের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়।
ইউএইর সংবিধান প্রণয়ন
আগের আলোচনার ভিত্তিতে তৈরি সংশোধিত খসড়ার ভিত্তিতে একটি অস্থায়ী সংবিধান গৃহীত হয়। ১৫২টি ধারা নিয়ে গঠিত সংবিধান ফেডারেল সরকারের কাঠামো কেমন হবে, তা নির্ধারণ করে। একই সঙ্গে প্রতিটি আমিরাতকে স্থানীয় ক্ষমতা নিজেদের হাতে রাখার সুযোগ দেওয়া হয়।
সংবিধানের আলোকে পাঁচটি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হয়। সাতজন শাসকের সমন্বয়ে ইউনিয়নের সর্বোচ্চ পরিষদ এবং সর্বোচ্চ আইন প্রণয়ন ও কার্যনির্বাহী কর্তৃপক্ষ গঠনের বিধান রাখা হয়। অন্তর্ভুক্ত করা হয় প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ। রাখা হয় মন্ত্রিপরিষদ। সব আমিরাতের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ৪০ সদস্যের পরামর্শমূলক ফেডারেল ন্যাশনাল কাউন্সিলের বিধান রাখা হয়। ফেডারেল বিচারব্যবস্থা বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যার নেতৃত্বে থাকবেন ফেডারেল সুপ্রিম কোর্ট।
সংযুক্ত আরব আমিরাত এখন আরব বিশ্বের একমাত্র সফল ফেডারেল ব্যবস্থা, যা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে আছে এবং বিকশিত হচ্ছে।
আজকের ইউএই
পাঁচ দশক পেরিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত আধুনিক যুগের অন্যতম সফল রাষ্ট্র গঠনের কাহিনি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ১৯৭১ সালে সাতটি ছোট আমিরাতের সমন্বয়ে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রগঠনের সাহসী পরীক্ষা-নিরীক্ষা হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল ইউএই। আজ তা স্থিতিশীল, নিরাপদ ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
কম অপরাধের ঘটনা, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ওচ্চ জীবনযাত্রার মানের জন্য ইউএই এখন সারা বিশ্বে পরিচিত। দেশটিতে বিশ্বের ২০০টির বেশি দেশ ও জাতির কয়েক কোটি মানুষ বাস করেন।
একসময় জ্বালানি সম্পদের ওপর নির্ভরশীল থাকলেও আরব আমিরাত এখন তেলবহির্ভূত খাতের দিকে ঝুঁকেছে। বর্তমানে দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তিন-চতুর্থাংশের বেশি আসে তেলবহির্ভূত খাত থেকে।
বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষের পাশাপাশি শান্তিতে বসবাসের জন্য বিশ্বদরবারে আরব আমিরাতের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। সঠিক নেতৃত্বের কল্যাণে একটি আধুনিক দেশ কতটা সফল হতে পারে, সেটির অনন্য উদাহরণ আজকের সংযুক্ত আরব আমিরাত।
তথ্যসূত্র: গালফ নিউজ, দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি এবং অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের আলোকে