ইয়াসির আরাফাতের গাজার বাড়ি এখন বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয়

ইসরায়েলের সেনাদের হামলায় বিধ্বস্ত নিজের বাড়িতে ফিলিস্তিনের প্রয়াত নেতা ইয়াসির আরাফাতের প্রতিকৃতি। বাড়িটি পরে জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়। গাজা উপত্যকার গাজা নগরীতে, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ছবি: ফিলিস্তিনের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজ থেকে

ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় গাজার অধিকাংশ বাড়িঘরের মতো ফিলিস্তিনের প্রয়াত নেতা ইয়াসির আরাফাতের বাড়িটিও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই বাড়িতেই মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে নিয়েছে কয়েকটি বাস্তুচ্যুত পরিবার।

ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত ২০০৪ সালে মারা যাওয়ার পর তাঁর বাড়িটি জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়। বাড়িটির দেয়ালে দেয়ালে তাঁর স্মরণে নানা চিত্র আঁকা হয়েছিল। কিন্তু ইসরায়েলের বিমান হামলায় এসব প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। বাড়িটির আশপাশে এখন শুধুই ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন।

বার্তা সংস্থা এএফপির গত শনিবারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আরাফাতের বাড়িটি গাজা নগরীর রিমাল এলাকায়। এখানে এখন গাজার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আশরাফ নাফেস আবু সালেমের পরিবারসহ কয়েকটি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। আবু সালেম বাড়িটির আঙিনায় জমে থাকা ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এই বাড়ির বেশির ভাগ অংশই ধ্বংস হয়ে গেছে, পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।’

বাড়িটির ধাতব গেটের দরজার ওপর আরাফাতের একটি পোস্টার রয়েছে। পোস্টারে ফিলিস্তিনি রুমাল কেফিয়াহ ও সানগ্লাস পরা হাস্যোজ্জ্বল আরাফাতের ছবিটি মলিন হয়ে এসেছে। একই পোস্টারে আরাফাতের পেছনে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসেরও একটি ছোট ছবি রয়েছে।

অধ্যাপক আবু সালেম হলদেটে রঙের একটি পুরোনো বই ওলটাচ্ছিলেন। বইটির প্রচ্ছদে আরাফাতের প্রতিকৃতি রয়েছে। এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমরা প্রথম ইন্তিফাদা বা গণজাগরণ (১৯৮৭) প্রজন্মের মানুষ। পাথর ছুড়তে ছুড়তেই আমরা বেড়ে উঠেছি।’ কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট আবু আম্মার আমাদের কাছে ফিলিস্তিনের জাতীয় সংগ্রামের আদর্শ ও প্রতীক।’ ভক্তরা ইয়াসির আরাফাতকে আবু আম্মার বলেই ডাকেন।

২৭ বছরের নির্বাসন জীবন শেষে গাজায় ফেরার পর এই বাড়িতে আরাফাত দীর্ঘ দিন ছিলেন। বাড়িটি ইসরায়েলি হামলা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত
ছবি: ফিলিস্তিনের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজ থেকে

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ইয়াসির আরাফাত ১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ২৭ বছর নির্বাসনে থাকার পর ১৯৯৪ সালে তিনি গাজায় প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। তিনি দীর্ঘ সময় ওই বাড়িতে ছিলেন।

দ্য গার্ডিয়ান–এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলের দুই বছরের আগ্রাসনে গাজা উপত্যকার তিন-চতুর্থাংশ ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে। এর ফলে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী উপত্যকাটিতে প্রায় ৬ কোটি ১০ লাখ টন ধ্বংসাবশেষ তৈরি হয়েছে। এসব ধ্বংসাবশেষের নিচে অন্তত ১০ হাজার ফিলিস্তিনির মরদেহ চাপা পড়ে আছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

৩০ লাখের বেশি বছর হারিয়েছে

যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞান সাময়িকী দ্য ল্যানসেট–এর গত শুক্রবারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় ইসরায়েলের হামলায় মানবজীবন থেকে ৩০ লাখের বেশি বছর হারিয়ে গেছে। গবেষণায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত নিহত ৬০ হাজার ১৯৯ ফিলিস্তিনির তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত গাজায় হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ৬৮ হাজারের বেশি মানুষ।

ল্যানসেট–এর গবেষণায় উঠে এসেছে, গাজায় নিহতের বেশির ভাগই বেসামরিক মানুষ। উপত্যকাটির প্রতিটি মৃত্যুর ফলে গড়ে ৫১ বছর মানবজীবন হারিয়ে গেছে। এর মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর ফলে মানবজীবন থেকে হারিয়ে গেছে ১০ লাখের বেশি বছর।

এই গবেষণা প্রতিবেদনের লেখক যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক স্যামি জাহরান এবং আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের ঘাসান আবু সিত্তাহ বলেন, ‘আমরা যে হিসাবটা দিয়েছি, সেটা ন্যূনতম। প্রকৃত সংখ্যা এর বেশিও হতে পারে।’

ইয়াসির আরাফাতের ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িটিতে এখন বাস্তুচ্যুত কয়েকটি ফিলিস্তিনি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে
ছবি: ফিলিস্তিনের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজ থেকে

হামলা অব্যাহত

যুদ্ধবিরতি উপেক্ষা করে গাজায় ইসরায়েলের হামলা অব্যাহত রয়েছে। গতকাল রোববার ইসরায়েলের ড্রোন হামলায় গাজা নগরীর পূর্ব দিকের শুজাইয়া এলাকায় অন্তত একজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে গতকাল সকাল থেকে শুজাইয়া ও পাশের জায়তুন এলাকার বিভিন্ন ভবনে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী।

গত ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর থেকে ইসরায়েলের হামলায় গাজায় গতকাল পর্যন্ত অন্তত ২২৬ জন নিহত ও ৫৯৪ জন আহত হয়েছেন। এ নিয়ে ইসরায়েলের দুই বছরের হামলায় গাজায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ হাজার ৮৫৮ জন। একই সময়ে আহত হয়েছেন অন্তত ১ লাখ ৭০ হাজার ৬৬৪ জন।

ইস্তাম্বুলে বৈঠক আজ

তুরস্কের ইস্তাম্বুলে আজ সোমবার গাজার যুদ্ধবিরতির সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে কয়েকটি আরব ও মুসলিম দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বৈঠকে বসবেন। গতকাল তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, বৈঠকে গাজার নিরাপত্তা, নতুন প্রশাসন এবং ত্রাণ সরবরাহ বাড়ানোসহ আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে আলোচনা হবে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান বৈঠকে নেতৃত্ব দেবেন।

সূত্রটি জানায়, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি নস্যাতের জন্য ‘অজুহাত’ খুঁজছে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মহলের ‘ইসরায়েলের উসকানির বিরুদ্ধে একটি দৃঢ় অবস্থান নেওয়া উচিত।’

গাজার যুদ্ধবিরতি তদারকির জন্য প্রস্তাবিত আন্তর্জাতিক টাস্কফোর্সে থাকার আশা প্রকাশ করেছে তুরস্ক। কিন্তু ইসরায়েলে তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, তারা গাজায় ইসরায়েলের সেনার উপস্থিতি মেনে নেবে না।