হামলার কৌশল বদলেছে ইসরায়েল, লক্ষ্য ‘ভয় ধরানো’
ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযানের সমাপ্তি টেনেছে ইসরায়েল। গত সপ্তাহের সোমবার এ অভিযান শুরু করে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। বুধবার অভিযান শেষ করার কথা জানায়। চলতি শতকের প্রথম দিকে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার পর পশ্চিম তীরে এটাই বড় অভিযান।
জেনিনের ওই শরণার্থী শিবিরে আকাশপথে হামলার পাশাপাশি স্থলপথে কয়েক শ সেনা পাঠিয়েছিল ইসরায়েল। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধারা সেখানে নিজেদের অবস্থান সংহত করেছেন। ইসরায়েল বলছে, এই ‘জঙ্গিদের’ দমনেই অভিযান চালিয়েছে তারা।
ইসরায়েলের দুই দিনের এ অভিযানে ১১ জন নিহত হন। তাঁদের মধ্যে তিনটি শিশু। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, আহত ব্যক্তিদের কারও কারও অবস্থা গুরুতর। আহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে নিতে যাওয়া অ্যাম্বুলেন্সগুলো আটকে দেন ইসরায়েলি সেনারা।
যেকোনো সংঘাত পরিস্থিতিতে যদি সর্বাত্মক যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি না হয়, তাহলে ঘনবসতিপূর্ণ কোনো এলাকায় এ ধরনের হামলা করা একটি বড় সমস্যা এবং ঠিক এই বিষয়টিতে হামলা করার একটা সীমা নির্ধারিত থাকা উচিত।
জেনিনে দুই দিনের এ অভিযানের নাম ছিল ‘হাউস অ্যান্ড গার্ডেন’। ইসরায়েলের সেনাবাহিনী এ অভিযানের প্রশংসা করে বলেছে, ‘সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযান।’
ইসরায়েলের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, ভারী অস্ত্রে সজ্জিত বড় হেলিকপ্টার ও গুপ্তচর ড্রোন ব্যবহার করে জেনিনে আকাশ থেকে ১৫টি হামলা চালানো হয়। এ ছাড়া স্থলপথে হামলায় জেনিনে এক হাজার এলিট স্পেশাল ফোর্সের সঙ্গে দেড় শ সাঁজোয়া যান (ট্যাংক, বুলডোজারসহ) পাঠিয়েছিল তারা।
জেনিনের ওই শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা ও ইনডিপেনডেন্ট কমিশন ফর হিউম্যান রাইটস নামের একটি মানবাধিকার সংগঠনের আইনজীবী মোহাম্মদ কামানজি বলেন, ভারী অস্ত্রে সজ্জিত বড় হেলিকপ্টার দিয়ে হামলা এ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে হামলা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মাত্রা বেড়েছে।
মোহাম্মদ কামানজি বলেন, এটি (ইসরায়েলের হামলার ক্ষেত্রে) একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। কেননা, সাধারণ অস্ত্রধারী অল্পসংখ্যক যোদ্ধার বিরুদ্ধে এমন এক যুদ্ধ শুরু করেছে ইসরায়েল, যাতে মানুষের জীবন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে অবকাঠামো ও বাড়িঘর ধ্বংস করার জন্য হামলা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই বছর ধরে ফিলিস্তিনির প্রতিরোধ যোদ্ধাদের একটা অংশের উত্থান ঘটেছে। এই যোদ্ধাদের দমনে ইসরায়েল তাদের অভিযানের কৌশল বদলেছে। সর্বশেষ জেনিনে শরণার্থী শিবিরে সশস্ত্র বড় হেলিকপ্টার ও ড্রোন দিয়ে একের পরে এক হামলা সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
জেনিনে সর্বশেষ এ ধরনের বড় অভিযান হয়েছিল ২০০২ সালের এপ্রিলে। সে সময় ১০ দিনে ৫২ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছিলেন। কিন্ত চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে এই শরণার্থী শিবিরে পাঁচটি বড় অভিযান চালায় ইসরায়েলের সেনাবাহিনী। এদিকে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের আক্রমণের ধরন পাল্টেছে। গত মাসে প্রথম তারা স্থানীয়ভাবে তৈরি বিস্ফোরক দিয়ে হামলা করে।
গত মাসের শেষ দিকে এভাবেই হেলিকপ্টার দিয়ে জেনিনে হামলা চালান ইসরায়েলি সেনারা। সেই হামলায় তিন ফিলিস্তিনি নিহত হন। ২০০৬ সালের পর প্রথমবার এভাবে হামলা চালাতে দেখা যায় ইসরায়েলকে। জুনের এ হামলার পর জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থার প্রধান ফলকার টুর্ক অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ব্যবহার করে হামলা চালানোয় ইসরায়েলের নিন্দা জানান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই বছর ধরে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের একটা অংশের উত্থান ঘটেছে। এই যোদ্ধাদের দমনে ইসরায়েল তাদের অভিযানের কৌশল বদলেছে। সর্বশেষ জেনিনে শরণার্থী শিবিরে সশস্ত্র বড় হেলিকপ্টার ও ড্রোন দিয়ে একের পরে এক হামলা সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
মোহাম্মদ কামানজির মতে, আগে দেখা যেত ইসরায়েল গুপ্তচর ও স্যাটেলাইট ড্রোন ব্যবহার করে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করত। এরপর এর ওপর ভিত্তি করে সেনা অভিযান বা হামলা চালাত। কিন্তু এখন জেনিনের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সঙ্গে লড়াইয়ের আগের সেই ধরন বদলে ফেলেছে। ইসরায়েল এখন আরও দ্রুত কীভাবে এই যোদ্ধাদের নির্মূল করা যায়, সেই লক্ষ্যে হামলা চালাচ্ছে।
জেনিনে এ ধরনের অভিযানে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ সংকটের বিষয়ও আছে। ফিলিস্তিনিদের ওপর এ ধরনের অভিযান চালিয়ে অভ্যন্তরীণ সংকটগুলো ধামাচাপা দিয়ে নাগরিকদের মনোযোগ সরাতে চাচ্ছে ইসরায়েল।
মানবাধিকার আইনজীবী কামানজি বলেন, ইসরায়েল শুধু অবকাঠামো ধ্বংস ও যোদ্ধাদের হত্যায় এ কৌশলে হামলা চালাচ্ছে, তা কিন্ত নয়। এর আরও একটি বড় দিক আছে, সেটি হচ্ছে জেনিনের এ শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দাদের মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়া, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে।
ফরিদ বাওয়াকনা নামে শরণার্থী শিবিরের এক বাসিন্দা বলেন, ভোরবেলায় তাঁর বাড়ির পাশের একটি জায়গায় বিমান হামলা হয়েছিল। ওই সময় সশস্ত্র প্রতিরোধ যোদ্ধারা সেখানে জড়ো হয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘প্রথমে তারা (ইসরায়েল) একটি ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা করে। এরপর আরও একটি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। এ হামলায় আমাদের ও আশপাশের বাড়িতে আগুন লাগে।’
স্নায়বিক যুদ্ধ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কলিন ওয়ালেস বলেন, যেকোনো সংঘাত পরিস্থিতিতে যদি সর্বাত্মক যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি না হয়, তাহলে ঘনবসতিপূর্ণ কোনো এলাকায় এ ধরনের হামলা করা একটি বড় সমস্যা এবং ঠিক এই বিষয়টিতে হামলা করার একটা সীমা নির্ধারিত থাকা উচিত।
কলিন ওয়ালেস বলেন, এ ধরনের সশস্ত্র প্রতিরোধ মোকাবিলায় অবশ্যই আসন্ন হুমকি ও সশস্ত্র ব্যক্তিদের নির্মূলেই হামলা বা অভিযানের লক্ষ্য হওয়া উচিত। এ ধরনের অভিযানের সময় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাধারণ মানুষেরা যাতে হামলার শিকার না হন, অবশ্যই তা নিশ্চিত করতে হবে।
ইসরায়েল বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হামদুল্লাহ আফানেহ বলছেন, জেনিনে এ ধরনের অভিযানে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ সংকটের বিষয়ও আছে। ফিলিস্তিনিদের ওপর এ ধরনের অভিযান চালিয়ে অভ্যন্তরীণ সংকটগুলো ধামাচাপা দিয়ে নাগরিকদের মনোযোগ সরাতে চাচ্ছে ইসরায়েল।