সুমুদ কী, শব্দটি কীভাবে আলোচনায় এল

ফিলিস্তিনি এক পুরুষের হাতে দেশটির জাতীয় পতাকা, আরেক নারীর হাতে একটি জলপাইগাছ। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে গাজার জাবালিয়া এলাকায় ভূমি দিবস উদ্‌যাপন উপলক্ষেফাইল ছবি: এএফপি

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার কারণে ‘সুমুদ’ শব্দটি নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। আরবি সুমুদ শব্দের অর্থ দৃঢ়তা, অটল থাকা বা অধ্যবসায়। কখনো কখনো যাবতীয় প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতি সত্ত্বেও ঘুরে দাঁড়ানোকে সুমুদ বলা হয়। কিন্তু প্রায় আট দশক ধরে ইসরায়েলের আনুষ্ঠানিক দখলদারি ও নানা মাত্রার আগ্রাসনের মুখে থাকা ফিলিস্তিনিদের জীবনে সুমুদ আক্ষরিক অর্থের সীমানা ছাড়িয়ে গভীর ও বহুমুখী অর্থ তৈরি করে চলছে।

ফিলিস্তিনিদের জীবনে সুমুদের ধারণা যুগে যুগে কীভাবে নিত্যনতুন আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ধারণার জন্ম দিয়েছে, সেটার ইতিহাস লম্বা। সংক্ষেপে বললে, দীর্ঘ পরিক্রমায় সুমুদ ফিলিস্তিনিদের জাতীয় পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। সুমুদকে ঘিরে গড়ে ওঠা নতুন ধরনের চিন্তা ও জ্ঞানের ধারা এরই মধ্যে ফিলিস্তিনের গণ্ডি ছাড়িয়ে গেছে।

সুমুদের ধারণা যেভাবে এল

ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের কাছে ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূখণ্ড থেকে উচ্ছেদ ও বিতাড়িত হওয়ার ইতিহাস কম করে হলেও ১০০ বছরের পুরোনো। তবে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে-পরে এক বছরের মধ্যে অন্তত ৫৩০টি ফিলিস্তিনি গ্রাম এবং শহর ধ্বংস ও দখল, প্রায় ১৩ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা এবং আরও সাড়ে ৭ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করা হয়। এ ঘটনা তাঁদের কাছে নাকবা বা মহাবিপর্যয় হিসেবে পরিচিত।

সন্তান জন্ম দেওয়া ও ঘরবাড়ি গড়া থেকে শুরু করে সাক্ষ্য দেওয়া (আদালতে) এবং লড়াই করা পর্যন্ত সবই সুমুদ।
এডওয়ার্ড ওয়াদি সাইদ, ফিলিস্তিন বংশোদ্ভূত মার্কিন চিন্তাবিদ

নাকবার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল যেসব শহর দখল করে, সেগুলোর মধ্যে ইয়াফা (জাফা), হাইফা, লুদ (লিড), রামলা, নেগেভ মরুভূমির প্রধান বসতি বিরুত-সাবা ও আক্কা অন্যতম। জাতিসংঘের ১৯৪৭ সালের ফিলিস্তিন বিভাজন পরিকল্পনায় এসব শহর ‌প্রস্তাবিত ‘আরব রাষ্ট্রের’ অংশ ছিল।

নাকবার পর ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের জাতীয় জীবনে দ্বিতীয় বড় ধাক্কা আসে। এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা, জেরুজালেম, সিরিয়ার গোলান মালভূমি ও মিসরের সিনাই উপদ্বীপ দখল করে নেয় ইসরায়েল। আনুমানিক তিন লাখ ফিলিস্তিনি নতুন করে বাস্তুচ্যুত হন। ফিলিস্তিনিদের কাছে এ ঘটনা নাকসা বা মহাপ্রত্যাঘাত হিসেবে পরিচিত। জাতীয় জীবনের এ ক্রান্তিকালে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সুমুদের ধারণা শিকড়ের মতো বিস্তার করতে এবং ডালপালা হয়ে মেলতে শুরু করে।

ইসরায়েলের তল্লাশিচৌকিগুলো ফিলিস্তিনিদের দৈনন্দিন জীবনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অধিকৃত পশ্চিম তীরের বেথলেহেমে একজন বৃদ্ধ ফিলিস্তিনি পবিত্র আল-আকসা মসজিদে যেতে অনুমতি পাওয়ার অপেক্ষা করছেন। ২০২৫ সালের মার্চে
ছবি: এএফপি

সুমুদের নানা অর্থ

শুরুর দিকে সুমুদ বলতে নিজের ভূমি বা ঘর-বসতি ছেড়ে না যাওয়া, হামলা উপেক্ষা করে নিজের ঘর বা জমিনে আঁকড়ে পড়ে থাকাকে বোঝানো হতো।

তখন ফিলিস্তিনিদের মধ্যে এ ধারণা গড়ে ওঠে, ইসরায়েলের সেনা বা বসতি স্থাপনকারীরা যতবারই ঘর ভেঙে দিক, তা আবার নির্মাণ করতে হবে। ঘরে যতই বোমা ফেলা হোক, সেই বিধ্বস্ত ঘরেই আবার ফিরতে হবে, ছাই থেকে নতুন ঘর তৈরি করতে হবে। ইসরায়েলিরা যতবারই আয়–উপার্জনের উৎস জলপাইগাছ উপড়ে ফেলুক, নতুন করে গাছ রোপণ করতে হবে। সুমুদের এ ধরন ‘আস-সুমুদস সাকিনু’ বা অটল স্থিরতা নামে পরিচিত।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) সদস্যরা যখন-তখন ফিলিস্তিনিদের ঘরে ঢুকে পড়েন। তাই ফিলিস্তিনিদের জন ও ব্যক্তিগত পরিসরের ভেদরেখা এতটা আলাদা নয়। ফিলিস্তিনিদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভিজ্ঞতা এবং রাজনৈতিক কাঠামো গভীরভাবে যুক্ত।

১৯৬০ ও ’৭০-এর দশকে জর্ডান ও লেবাননে গড়ে ওঠা শত শত শরণার্থীশিবিরে অবস্থানকারী ফিলিস্তিনিদের মধ্যে জাতীয় চেতনা জাগ্রত করতে সুমুদের অংশ হিসেবে নানা কার্যক্রম চালানো হতো। প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) এসব কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিত। তখন এসব শরণার্থীশিবিরে বসবাসকারীরা ‘সামিদিন’ বা দৃঢ়চেতা মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

১৯৭৮ সালে পিএলও প্রস্তাব করে, সুমুদ ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূখণ্ডে অটল থাকার অন্যতম উপায় হওয়ায় যাঁরা বাস্তুচ্যুতির শিকার, তাঁদের সহায়তা করতে হবে; যেন তাঁরা ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ছেড়ে পরদেশে পাড়ি না জমান। এ জন্য গঠিত হয়েছিল ‘সুমুদ সহায়তা তহবিল’। জর্ডানের পিএলও শাখা থেকে পরিচালিত এ তহবিল থেকে পশ্চিম তীর ও গাজার বাসিন্দাদের অর্থসহায়তা দেওয়া হতো। দুর্নীতির অভিযোগে তা একসময় বন্ধ হয়ে যায়। এতে একধরনের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হলেও অল্প কিছুদিন পর সুমুদ নতুন প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে হাজির হয়।

১৯৭০ ও ’৮০-এর দশকে লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময় ‘অবরুদ্ধ শরণার্থীশিবির’ রক্ষায় সামিদিনেরা নানা তৎপরতা চালাতেন। তখন ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে হতাহত ও বন্দী সামিদিনেরা বীরের মর্যাদা পেতেন। এ সময়টাতে ফিলিস্তিনের জাতীয় সংগ্রামে সুমুদ সশস্ত্র প্রতিরোধের ধরন হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। ধরনটি ‘আস-সুমুদুল মুকায়িমু’ বা প্রতিরোধমূলক সুমুদ নামে পরিচিত।

ফিলিস্তিনি প্রতিবাদকারীদের দিকে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ছেন ইসরায়েলের সেনারা। ফিলিস্তিনিরা অবৈধ বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন। ২০২১ সালের এপ্রিলে অধিকৃত পশ্চিম তীরের বেইত দাজানে
ফাইল ছবি: এএফপি

১৯৮০ সালে আইন পাস করে পূর্ব জেরুজালেমকে নিজেদের অংশ করে নেয় ইসরায়েল। একই সময়ে অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরায়েলের বিধিনিষেধ বাড়তে থাকে। পাল্লা দিয়ে সুমুদের অর্থ ও তাতে নতুন মাত্রা তৈরি হতে থাকে। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত চলা প্রথম ইন্তিফাদা (ফিলিস্তিনি গণজাগরণ) এবং ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত চলা দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় সুমুদের পরিধি আরও বিস্তৃত হয়।

এ পর্যায়ে বিশেষজ্ঞদের একটা অংশ দাবি করেন, শুধু সশস্ত্র সংগ্রাম নয়, অধিকৃত ভূখণ্ডে জীবন যাপন করাটাও সুমুদ। বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানো, বাজার করা, ইসরায়েলি বাহিনীর অকারণ তল্লাশি সহ্য কিংবা তল্লাশিচৌকিতে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করাও সুমুদ। ইসরায়েলের কারাগারে আটক সহকয়েদিদের মনোবল চাঙা রাখতে গান করাও অনেকের চোখে সুমুদ।

অনেকে মনে করেন, প্রতিবেশীর প্রতি মিষ্টি করে হাসা, ফিলিস্তিনের জাতীয় পতাকা ওড়ানো, লেখালিখি বা সৃষ্টিশীল কাজ করা, মহল্লাবাসীর সঙ্গে গল্প করা, উৎসবে অংশ নেওয়ার মতো মানবিক সব কর্মকাণ্ডও সুমুদ। রামাল্লাভিত্তিক ফিলিস্তিনি আইনজীবী রাজা শেহাদেহ সুমুদের এ ধরনটি জনপ্রিয় করেন; যাকে তিনি কখনো কখনো তৃতীয় পথ বা দ্য থার্ডওয়ে বলে থাকেন।

শেহাদেহসহ আরও কিছু বিশেষজ্ঞ যুক্তি দেন, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) সদস্যরা যখন-তখন ফিলিস্তিনিদের ঘরে ঢুকে পড়েন। তাই ফিলিস্তিনিদের জন ও ব্যক্তিগত পরিসরের ভেদরেখা এতটা আলাদা নয়। ফিলিস্তিনিদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভিজ্ঞতা এবং রাজনৈতিক কাঠামো গভীরভাবে যুক্ত।

বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানো, বাজার, সৃষ্টিশীল কাজ বা মহল্লাবাসীর সঙ্গে গল্প থেকে শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনীর অকারণ তল্লাশি সহ্য করা কিংবা তল্লাশিচৌকিতে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার মতো কাজগুলোও সুমুদ।

প্রবাসী ফিলিস্তিনি বা বিদেশিদের কাছে সুমুদের ভিন্ন অর্থ আছে, যা সংহতি হিসেবে পরিচিত। ইসরায়েলের দখলদারি, জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া, জাতিগত নিধন বা আগ্রাসনে সহযোগিতাকারী প্রতিষ্ঠান বর্জন, ইসরায়েলি স্বার্থসংশ্লিষ্ট তহবিল প্রত্যাহার ও নিষেধাজ্ঞা (বিডিএস) আন্দোলন সমর্থন বা ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে ‘কেফিয়াহ’ রুমাল পরাও একধরনের সুমুদ।

সুমুদের প্রতীক

ব্রোঞ্জ যুগ (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩০০ থেকে ১২০০ সাল) থেকে ফিলিস্তিন অঞ্চলে জলপাইয়ের চাষ হয়ে আসছে। এর শিকড় বেশ গভীরে চলে যায়। রোপণের চার–পাঁচ বছর পর থেকে ফল দিতে শুরু করলেও একটি জলপাইগাছের পূর্ণ উৎপাদনশীল অবস্থায় পৌঁছাতে সাধারণত ৮ থেকে ১০ বছর লাগে। তবে কোনো কোনো জলপাইগাছ ৩০০ থেকে ৪০০ বছর বেঁচে থাকে এবং ফল দেয়। তাই প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকা জলপাইগাছ ফিলিস্তিনিদের কাছে শুধু অর্থকরী কোনো গাছ নয়; বরং জাতীয় জীবনের প্রতীক। এই গাছকে সুমুদের প্রতীক হিসেবেও দেখা হয়।

ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের দিকে একটি ছাদ থেকে রাসায়নিক ফোম ছুড়ছেন ইসরায়েলের সেনারা। ১৯৮৮ সালের জানুয়ারিতে পশ্চিম তীরের নাবলুসে
ফাইল ছবি: এএফপি

ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই ফিলিস্তিনিদের জলপাইবাগানকে হামলার নিশানা করা হয়েছে। চলমান যুদ্ধেও বিধ্বস্ত গাজা এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরের গ্রামে গ্রামে অসংখ্য জলপাইবাগান ধ্বংস করা হয়েছে। কয়েক শ বছরের পুরোনো অনেক জলপাইগাছ কেটে ফেলেছেন ইসরায়েলের সেনা ও অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা।

নিজেদের জমিতে ইসরায়েলি দখলদারি বাড়তে থাকায় ১৯৭০ ও ’৮০-এর দশক থেকে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে জলপাইবাগান করার বিষয়েও নতুন করে আগ্রহ তৈরি হয়। অনেক ফিলিস্তিনি বংশপরম্পরায় জলপাই চাষ করেন। তবে ইসরায়েলের অবৈধ বসতি বাড়তে থাকায় ফিলিস্তিনি কৃষকদের মধ্যে বেকারত্বও বাড়ে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, বাগান হারানো অনেক কৃষক পরিবারের সন্তানেরা সেই একই ভূমিতে ইসরায়েলের ‘বসতি প্রকল্পে’ স্বল্প বেতনে শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

ফিলিস্তিনিদের জাতীয় কবি হিসেবে পরিচিত মাহমুদ দারবিশের কবিতায় ঘুরেফিরে জলপাইগাছের কথা এসেছে। ‘তাদিকু বিনাল আরদু’ শিরোনামের কবিতার শেষ স্তবকে মাহমুদ দারবিশ লিখেছেন:

‘আমরা এখানেই মারা যাব
এখানে এই শেষ করিডরে
একদিন আমাদের রক্ত থেকে
এখানে-ওখানে জন্ম নেবে
কোনো জলপাইগাছ।’

শিল্প–সাহিত্যে সুমুদ

ফিলিস্তিন বংশোদ্ভূত বিখ্যাত মার্কিন চিন্তাবিদ এডওয়ার্ড ওয়াদি সাইদ তাঁর ‘আফটার দ্য লাস্ট স্কাই: প্যালেস্টিনিয়ান লাইভস’ বইয়ে লিখেছেন, ‘সন্তান জন্ম দেওয়া ও ঘরবাড়ি গড়া থেকে শুরু করে সাক্ষ্য দেওয়া (আদালতে) এবং লড়াই করা পর্যন্ত সবই সুমুদ।’

১৯৮৬ সালে প্রকাশিত এ বইয়ে সাইদ লিখেছেন, ‘তাঁদের (ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের) সুমুদ বাস্তব, দৃঢ় ও শক্ত। তাঁরা ফিলিস্তিনে থাকেন, ফিলিস্তিন আমাদের মতো তাঁদের কাছে কোনো ধারণাগত বিষয় নয়; বরং একটি ভূখণ্ড।’

বলা হয়, ১৯৮০-এর দশকে ইংরেজিভাষী মানুষের কাছে সুমুদ ধারণাটি জনপ্রিয় করেছিলেন রাজা শেহাদেহ। আত্মজীবনীমূলক ‘অকুপেশন ডায়েরিজ’ বইয়ে তিনি লিখেছেন, ফিলিস্তিনিরা ‘ইসরায়েলিদের শক্তিশালী বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে পেরে উঠবে না। তবে আমাদের ক্ষোভকে জাগ্রত রাখতে হবে...। এসব স্মরণ করা ও রেকর্ড করে রাখা আমাদের দায়িত্ব...। একজন আইনজীবী হিসেবে আমার কাছে সুমুদের যদি কোনো অর্থ থাকে, তা হলো ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর গল্প বলে যাওয়া।’

পশ্চিম তীরে বসবাসের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে শেহাদেহ আরও লিখেছেন, ‘আপনার ঘরকে কারাগারে পরিণত হতে দেখাও একধরনের সুমুদ। এরপর আপনি এ কারাগারে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, এটাই আপনার ঘর। আপনার ভয় হয়, একবার ছেড়ে গেলে কারাপ্রহরী আপনাকে আর এ ঘরে ফিরতে দেবে না।’

ফ্রিডম ফ্লোটিলার হান্দালা জাহাজের কাছে মানুষের ভিড়। ২০২৫ সালের জুলাই মাসে ইতালির সিসিলি শহরের সিরাকিউজের একটি বন্দরে
ছবি: এএফপি

ইসরায়েলের সর্বাত্মক নজরদারি ও সরাসরি সম্প্রচার করা জাতিগত নিধনের এ যুগে সুমুদের ধরন আরও বিস্তৃত হয়েছে। ফিলিস্তিনের ৩০০ লেখকের লেখা নিয়ে চলতি বছরের শুরুতে প্রকাশিত সংকলন ‘সুমুদ: আ প্যালেস্টিনিয়ান রিডার’ বইয়ের ভূমিকায় লেখা হয়েছে, ‘সুমুদ ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রতিশ্রুতির সমন্বয়। ক্রমাগত দমন ও শোষণের মধ্যেও এটা নিজেদের জীবনধারা বজায় রাখতে সহায়তা করে।’

ফ্লোটিলা মুখপাত্রের মত

গাজা অভিমুখী ত্রাণবাহী নৌবহর গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার মুখপাত্র সাইফ আবুকেশেক মিডল ইস্ট আইকে বলেন, ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ প্রতিরোধের ইতিহাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ফ্লোটিলার ওই নাম রাখা হয়েছে।

আবুকেশেক বলেন, ‘৭৮ বছর ধরে দখলদারির মধ্যে থাকা ফিলিস্তিনিরা চলমান জাতিগত হত্যার ২২ মাস (দুই বছর) অতিক্রম করেও নিজেদের ভূমিতে অটল থেকে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং প্রতিদিন নতুন দিনের আশায় জেগে উঠছেন। চরম বৈরী পরিস্থিতিতে টিকে থাকার এটাই সবচেয়ে ভালো উদাহরণ, এটাই সুমুদের প্রকৃত অর্থ। প্রতিদিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদেরও এ ঘুরে দাঁড়ানোর মানসিকতা ও ফিলিস্তিনি জনগণের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়া প্রয়োজন।’

তথ্যসূত্র: টু এক্সিস্ট ইজ টু রেসিস্ট: সুমুদ, হিরোইজম, অ্যান্ড দ্য এভরি ডে—আলেক্সান্দ্রা রিজকে, টোনি ভন টেফেলেন; জন বার্জার অ্যান্ড এভরি ডে অ্যাক্টস অব সুমুদ—জুমান সিমান; সোশ্যাল ইকোলজি অব রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সুমুদ অব প্যালেস্টিনিয়ানস—মুহাম্মদ মারি, বেন হ্যানিগান, এলেড জোন্স; এভরি ডে লাইফ ইন দ্য ফেস অব কনফ্লিক্ট: সুমুদ অ্যাজ আ স্প্যাটিয়াল কোটিডিয়ান প্র্যাকটিস ইন প্যালেস্টাইন—ইয়ান বুসে; দ্য গাজা ফ্লোটিলা: হোয়াট ইউ নিড টু নো অ্যাবাউট ‘সুমুদ’—মিডল ইস্ট আই