ভাইরাল হওয়া ছবিটি নিয়ে বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ-বিতর্ক, পেছনের সত্যটা কী
গাজার ১৮ মাস বয়সী এক ফিলিস্তিনি শিশুর ছবি। শিশুটির কঙ্কালসার দেহে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে হাড়গোড়, পাঁজর ও মেরুদণ্ড। ইন্টারনেটে গত সপ্তাহে দ্রুত ও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে ছবিটি।
বিবিসি, সিএনএন ও নিউইয়র্ক টাইমসসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ছবিটি ছাপা হয় এবং তা বিশ্বব্যাপী তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়।
তবে ছবিটি ঘিরে বিতর্কও তৈরি হয়েছে। ইসরায়েল ও এর সমর্থকেরা দাবি করেছে, শিশুটির আগে থেকেই ‘স্বাস্থ্যগত জটিলতা’ ছিল।
এ দাবির ভিত্তিতেই ইসরায়েল ও এর সমর্থকেরা গাজায় শিশুদের অভুক্ত থাকার খবরকে ‘মিথ্যে প্রচার’ বলার চেষ্টা করছেন।
মিডল ইস্ট আই শিশুটির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল গাজা সিটির পশ্চিমাঞ্চলে, একটি অস্থায়ী তাঁবুতে। সেখানে তার মা হিদায়া বলছিলেন, কীভাবে তাঁর সন্তান মোহাম্মদ আল-মুতাওয়াক আজকের অবস্থায় পৌঁছেছে, সেই কাহিনি।
‘গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় আমি ছিলাম সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা’—ওই সময়ের একটি বিয়ের হলের ধ্বংসাবশেষে দাঁড়িয়ে বলছিলেন হিদায়া। এ হল এখন তাঁদের বাসস্থান হিসেবে (অস্থায়ী তাঁবু) ব্যবহৃত হচ্ছে।
‘মোহাম্মদের (আল-মুতাওয়াক) জন্ম ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে, যুদ্ধের সবচেয়ে ভয়ংকর পর্যায়ে ও (ফিলিস্তিনিদের) ক্ষুধায় মারার প্রথম দফার ইসরায়েলি অভিযানের দ্বিতীয় মাসে।
মিডল ইস্ট আই শিশুটির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল গাজা সিটির পশ্চিমাঞ্চলে, একটি অস্থায়ী তাঁবুতে। সেখানে তার মা হিদায়া বলছিলেন, কীভাবে তাঁর সন্তান মোহাম্মদ আল-মুতাওয়াক আজকের অবস্থায় পৌঁছেছে, সেই কাহিনি।
‘জন্মের সময় ওর শরীরে কিছুটা অক্সিজেনের ঘাটতি হয়, যা সামান্য পেশি দুর্বলতার কারণ হয়েছিল’, যোগ করেন হিদায়া।
তবে সেই প্রাথমিক সমস্যাগুলোর পরও আল–মুতাওয়াকের চিকিৎসা চলছিল এবং তার স্বাস্থ্যের উন্নতি হচ্ছিল।
‘চিকিৎসকেরাও ওর উন্নতি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন’, বলেন হিদায়া।
তবে আল–মুতাওয়াক যখন মাত্র দুই মাস বয়সী, তখন হিদায়া নিজেই অপুষ্টিতে ভুগতে শুরু করেন। ফলে সে আর বুকের দুধ খেত না এবং তখনই শুরু হয় দুধ আর বেবি ফর্মুলার জন্য সংগ্রামের নতুন অধ্যায়।
‘প্রথম দফার ক্ষুধা অভিযানের সময় ও এর আগের কয়েকটি মাস আমরা হাসপাতালে গিয়ে কিছু দুধ সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম’, বলেন হিদায়া।
‘তখন ওর বাবা বেঁচে ছিলেন। তিনিই আমাদের দুধ এনে দিতেন; যত দিন না তিনি এক ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন।’
ওই সময় পর্যন্ত শিশুটির স্বাস্থ্য ধীরে ধীরে উন্নতির দিকেই ছিল। সে বয়স অনুযায়ী বেশ কিছু মাইলফলকে পৌঁছাচ্ছিল। ‘ও তখন ‘‘আম্মা’’, ‘‘আব্বা’’ বলতে শুরু করেছিল’, বলেন হিদায়া।
একসময় তো ভাবছিলাম, ও বুঝি মারা গেছে। আমি মাথা রেখে ওর বুকে শুনতাম, কোনো শব্দ পাই কি না। ও একেবারেই নড়ত না। সঙ্গে ছিল প্রবল ডায়রিয়া।
২০২৫ সালের শুরুতে আল–মুতাওয়াক হামাগুড়ি দিতে ও দাঁড়াতে শিখে গিয়েছিল। কিন্তু এরপরই জাবালিয়া (গাজার শরণার্থী শিবির) থেকে আবার তাঁদের উৎখাত করা হয়।
এর পর থেকেই আল–মুতাওয়াকের স্বাস্থ্যের মারাত্মক অবনতি শুরু হয়। ওজন নেমে আসে ৯ কেজি থেকে ৬ কেজির নিচে। পেশিশক্তি ও চলাফেরার যেসব অগ্রগতি হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ উল্টোপথে চলতে থাকে।
‘যখন ওর শরীর আর মুখে এ পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করলাম, আমি ওকে কয়েকটি হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু চিকিৎসকেরা বলেন, “এখন খাবারই ওর একমাত্র চিকিৎসা। ওর দরকার যথাযথ পুষ্টি।”’, বলেন হিদায়া।
‘এমন একটি শিশুর প্রয়োজন দুধ, ডিম, পনির, সবজি ও ফলমূল। কিন্তু ও জন্ম থেকেই কোনো দিন ফল মুখে দেয়নি। জন্মই নিয়েছে এক অভুক্ত থাকা ও বঞ্চনার বাস্তবতায়।’
‘চরম মাত্রার তীব্র অপুষ্টি’
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, শিশুটি এখন ‘সিভিয়ার অ্যাকিউট ম্যালনিউট্রিশন (এসএএম)’ বা চরম মাত্রার তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। এটি অপুষ্টির সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ। তাঁরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, যদি ওর জন্য জরুরি ও ধারাবাহিকভাবে সুষম খাবার ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা না যায়, তবে জীবন ভীষণ রকমের ঝুঁকিতে থাকবে।
হিদায়া বলছিলেন, ইতিমধ্যে শিশুটির শরীরে নানা ভয়ানক পরিবর্তন তিনি খেয়াল করছেন।
২০২৫ সালের শুরুতে আল-মুতাওয়াক হামাগুড়ি দিতে ও দাঁড়াতে শিখে গিয়েছিল। কিন্তু এরপরই জাবালিয়া থেকে আবার তাঁদের উৎখাত করা হয়। এর পর থেকেই শিশুটির স্বাস্থ্যের মারাত্মক অবনতি শুরু হয়।
গত জুলাই মাসের শুরুতে আল–মুতাওয়াককে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই ধরা পড়ে, সে মারাত্মক পানিশূন্যতায় ভুগছে।
‘একসময় তো ভাবছিলাম, ও বুঝি মারা গেছে। আমি ওর বুকে মাথা রেখে শুনতাম, কোনো শব্দ পাই কি না। ও একেবারেই নড়ত না। সঙ্গে ছিল প্রবল ডায়রিয়া’, বলেন হিদায়া।
‘আমি বিশ্বাস করি, যেসব অস্বাস্থ্যকর খাবার আমরা খাচ্ছি, সেগুলোর কারণেই ওর এমন হয়েছিল। সেগুলোই আমরা পুষ্টিকর খাবারের বিকল্প হিসেবে নিচ্ছিলাম।
হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা শিশুটির পানিশূন্যতা শনাক্ত করেন এবং কিছু ওষুধ দেন; যা সামান্য উন্নতি ঘটায়। তবু চিকিৎসকেরা সাফ জানিয়ে দেন, যথাযথ খাবার ছাড়া ওর স্বাস্থ্যের উন্নতি সম্ভব নয়।
অথচ সেই দুর্বল অবস্থাতেও আল–মুতাওয়াককে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়; যাতে আরও শিশুর জন্য জায়গা হয়।
আল–মুতাওয়াকের মতোই গাজার হাসপাতালে শত শত শিশু অসুস্থ ও অনাহারে কাতরাচ্ছে। তাদের সবার একই রোগ—চরম অপুষ্টি।
জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের শুরু থেকে মে মাস পর্যন্ত গাজায় প্রতিদিন গড়ে ১১২টি শিশু চরম অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়েছে।
আমি ওকে দুইটা পলিথিনে মুড়ে রাখি। ভাবুন, গরমের মধ্যে, তা-ও তাঁবুর মতো জায়গায়, শিশুর ত্বকে সেই নাইলনের ঘষা আর গরমের যন্ত্রণাটা কেমন হয়।
জাতিসংঘের সংস্থাটি জানিয়েছে, গত জুনে ৬ হাজার ৫০০ শিশু চরম অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়েছে। শুধু জুলাইয়ের প্রথম দুই সপ্তাহেই এতে আক্রান্ত হয়েছে আরও ৫ হাজার শিশু।
ইউনিসেফ আরও জানায়, গাজা উপত্যকার পুরো জনসংখ্যাই এখন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। পাঁচ বছরের নিচের সব শিশু, যাদের সংখ্যা ৩ লাখ ২০ হাজারের বেশি, অকস্মাৎ চরম অপুষ্টিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে।
‘আল–মুতাওয়াক হাঁটতে শিখেছিল, কিন্তু এখন সে বসতেও পারে না। ও মাথা ধরে রাখতে পারে না, পা নাড়ায় না বললেই চলে। এখন হাত পর্যন্ত নড়াতে পারছে না’, মিডল ইস্ট আইকে বলেন হিদায়া।
‘যদি আমি ওকে আগেই হামাগুড়ি দিতে আর দাঁড়াতে না দেখতাম, তবে হয়তো ভাবতাম, ওর বর্তমান অবস্থা স্বাস্থ্যগত অন্য সমস্যার কারণে। কিন্তু না, ওর স্বাস্থ্য সামান্য খারাপ ছিল আর উন্নতিই হচ্ছিল। শুধু খাবার আর দুধ জোগাড় করতে না পারার পরই ওর এমন পতন শুরু হয়।’
আজ রাতের বেলা আল–মুতাওয়াক যখন দুধ চেয়ে কাঁদছিল, হিদায়া ওকে সান্ত্বনা দেন পানি দিয়ে।
‘অনেক দিন আমরা না খেয়েই ঘুমাতে যাই। কখনো কখনো টানা চার দিন কিছু না খেয়েই থাকতে হয়।
‘বেবি ফুড, দুধ কিংবা পুষ্টিকর সাপ্লিমেন্ট কিছুই পাওয়া যায় না। যদি বাজারে কোথাও পাওয়া যায়ও, তা এতটাই দুষ্প্রাপ্য যে দাম কল্পনাতীত।
‘আমার স্বামী নিহত হওয়ার পর আমি দুই সন্তানের একমাত্র অভিভাবক। এত দামে খাবার কেনা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
‘আমার ছেলে এখন আক্ষরিক অর্থেই কঙ্কাল ছাড়া আর কিছু নয়। আপনি ওর শরীরের ওপর দিয়েই পাঁজর আর মেরুদণ্ড দেখে ফেলতে পারবেন—এ সবই শুধু খাদ্যের অভাবে।’
খাবার জোগাড়ের পাশাপাশি হিদায়া এখন আরেকটা সংগ্রামের মধ্যে আছেন—ছেলের জন্য ডায়াপার পাওয়া। কারণ, ইসরায়েল স্বাস্থ্যসামগ্রী পর্যন্ত গাজায় ঢুকতে দিচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত তিনি বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করছেন প্লাস্টিকের ব্যাগ।
‘আমি ওকে দুইটা পলিথিনে মুড়ে রাখি। ভাবুন, গরমের মধ্যে, তা–ও তাঁবুর মতো জায়গায়, শিশুর ত্বকে সেই নাইলনের ঘষা আর গরমের যন্ত্রণাটা কেমন হয়’, বলেন হিদায়া।
‘আমি জানি না, ও কোন দুনিয়ায় জন্মেছে। এমনকি সেই ন্যূনতমটুকুও দিতে পারি না, যেটা পৃথিবীর অন্য প্রান্তে মানুষ স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়।
‘দখলদার শক্তি আমাদের বিরুদ্ধে লড়ছে—ক্ষুধার মাধ্যমে। ওরা আমাদের শিশুদের লক্ষ্যবস্তু করেছে।’