যুদ্ধবিরতির পরও শান্তি ফিরছে না গাজায়
ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতির পর থেমেছে ইসরায়েলের নির্বিচার বোমাবর্ষণ। তবে শান্তি ফেরেনি। একে তো ফিলিস্তিনিরা নিজ ঠিকানায় ফিরে ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই পাচ্ছেন না, এরপর আবার চুক্তি অনুযায়ী এখনো গাজায় নির্ধারিত পরিমাণ ত্রাণ প্রবেশ করতে দিচ্ছে না ইসরায়েল। এতে উপত্যকাটিতে খাবারের সংকট কাটছে না।
বুধবার ছিল যুদ্ধবিরতির ষষ্ঠ দিন। আগের পাঁচ দিনে চুক্তি অনুযায়ী বন্দিবিনিময় করেছে হামাস ও ইসরায়েল। তবে হামাস মৃত জিম্মিদের ফেরত পাঠাতে দেরি করছে—এমন অজুহাত তুলে ইসরায়েল জানায়, গতকাল থেকে নির্ধারিত পরিমাণের অর্ধেক অর্থাৎ প্রতিদিন ৩০০ ট্রাক ত্রাণ গাজায় প্রবেশ করতে দেবে তারা। দক্ষিণ গাজার রাফা সীমান্ত ক্রসিংও আপাতত চালু না করার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল। তবে পরে ক্রসিংটি খুলে দেওয়া হয়।
যদিও যুদ্ধবিরতির পর থেকেই দিনে নির্ধারিত ৬০০ ট্রাকের অনেক কম ত্রাণ গাজায় ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। বুধবার বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে, এদিন তাদের মাধ্যমে মাত্র ১৩৭ ট্রাক ত্রাণ উপত্যকাটিতে সরবরাহ করা হয়েছে। এসব ট্রাকে ময়দা ও চিকিৎসা সরঞ্জামের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছিল। তবে পানির পরিমাণ ছিল কম। জ্বালানি তো ছিলই না।
যুদ্ধবিরতির পর বাস্তুচ্যুত যেসব মানুষ গাজা নগরীতে ফিরেছেন, তাঁরা পানি নিয়ে সবচেয়ে বড় দুর্ভোগের মুখে পড়ছেন। নগরীর বাসিন্দা গাদা আল কুর্দ বলেন, প্রায় সব এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে। কোনো পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই। আর দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের বাসিন্দা মাহমুদ এমাদ রোস্তম বলেন, কিছু ত্রাণ প্রবেশ করায় খাবারের সরবরাহ বেড়েছে। তবে জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া।
এ ছাড়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী গাজার ৫৩ শতাংশ এলাকা এখনো ইসরায়েলি সেনাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সেখানে নিজ ভিটেমাটিতে ফিরতে পারছেন না বাসিন্দারা। এসব এলাকায় ফিরতে যাওয়া ৬ জনসহ মোট ৯ ফিলিস্তিনিকে মঙ্গলবার হত্যা করেছেন ইসরায়েলি সেনারা। বুধবারও সুজাইয়া এলাকায় দুই ফিলিস্তিনিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এ নিয়ে গত দুই বছরের বেশি সময়ে ইসরায়েলের হামলায় গাজায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৭ হাজার ৯৩৮।
নিয়ন্ত্রণ বাড়াচ্ছে হামাস
২০০৭ সালে ফাতাহ ও হামাসের মধ্যে ছয় দিনের সংঘর্ষের পর থেকে গাজা নিয়ন্ত্রণ করছিল হামাস। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর উপত্যকাটিতে ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর থেকে সে নিয়ন্ত্রণ হারায় তারা। এখন কিছু এলাকা থেকে ইসরায়েলি সেনারা সরে যাওয়ার পর আবার নিয়ন্ত্রণ বাড়াচ্ছে হামাস। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, শহর এলাকাগুলোর রাস্তাঘাটে হামাসের সশস্ত্র সদস্যদের উপস্থিতি বেড়েছে।
গাজার এসব এলাকায় এখন আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসরায়েলের হামলা না থাকলেও বিগত কয়েক দিনে হামাসের সঙ্গে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সদস্যদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে কয়েক ডজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। সবশেষ মঙ্গলবার সকালে হামাস নিরাপত্তা বাহিনীর এবং হিল্লেস পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ হয়েছে।
এরই মধ্যে একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে দেখা যায়, পিছমোড়া করে হাত বাঁধা সাতজনকে টেনেহিঁচড়ে গাজা নগরীর একটি চত্বরে নেওয়া হয়। সেখানে তাঁদের বসিয়ে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে হামাসের একটি সূত্র রয়টার্সকে জানায়, ভিডিওটি গত সোমবার ধারণ করা। আর সাতজনকে হামাসের সদস্যরাই গুলি করে হত্যা করেন।
গাজায় সংঘাত বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা ‘শান্তি’ পরিকল্পনার একটি শর্ত হলো, হামাসের অস্ত্রসমর্পণ। এ শর্ত নিয়ে এখনো হামাস-ইসরায়েল সমঝোতা হয়নি। তবে সম্প্রতি ট্রাম্প বলেছিলেন, গাজায় শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য হামাসকে স্বল্প সময়ের জন্য অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন তিনি। পরে গত মঙ্গলবার আবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘হামাস অস্ত্র না ছাড়লে আমরা তাদের অস্ত্রমুক্ত করব। আর তা দ্রুত ও সহিংসভাবে করা হবে।’ ট্রাম্পের এই বক্তব্যের পর তাঁর শান্তি পরিকল্পনার ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকারাচ্ছন্ন হলো বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
আরও চার জিম্মির মরদেহ ফেরত
যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী সোমবার জীবিত ২০ জিম্মিকে ইসরায়েলে ফেরত দিয়েছিল হামাস। এ ছাড়া ২৮ মৃত জিম্মির মধ্যে ৪ জনের মরদেহ ফেরত দেওয়া হয়েছিল। যদিও তাঁদের মধ্যে একজনের মরদেহ ইসরায়েলি জিম্মির নয় বলে দাবি করেছে দেশটির সরকার। পরে মঙ্গলবার আরও চার জিম্মির মরদেহ ইসরায়েলের হাতে তুলে দিয়েছে হামাস।
মৃত জিম্মিদের ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে হামাসের বিলম্ব নিয়ে ইসরায়েল যে অভিযোগ করেছে, তার একটি জবাব দিয়েছেন জিম্মিদের পক্ষে মধ্যস্থতাকারী গেরসন বাসকিন। সংবাদমাধ্যম সিবিএসকে তিনি বলেন, মরদেহগুলো কবর দেওয়া হামাস নেতাদের অনেকে নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া ইসরায়েলের হামলায় গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এতে মরদেহগুলো দ্রুত ফেরত দিতে জটিলতা বেড়েছে।
এদিকে চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েল যেসব ফিলিস্তিনির মরদেহ ফেরত দিয়েছে, তাঁদের অনেকের চোখ বাঁধা ও হাতকড়া পরানো অবস্থায় ছিল। এ ছাড়া অনেক ফিলিস্তিনির শরীর ট্যাংকের নিচে পিষ্ট হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। চিকিৎসা-সংক্রান্ত বিভিন্ন সূত্র আল-জাজিরাকে জানিয়েছে, তাদের ধারণা, ওই ফিলিস্তিনিদের বিচার ছাড়াই হত্যা করা হয়েছে।
ত্রাণকে হাতিয়ার বানিয়েছে ইসরায়েল
গাজায় হামলা বন্ধের পর এবার ত্রাণকে ইসরায়েল দর-কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। কারণ, গাজার বর্তমান পরিস্থিতিতে জিম্মিদের মরদেহ দ্রুত ফেরত দেওয়াটা যে জটিল, তা ইসরায়েল জানলেও ত্রাণ সরবরাহ কমানোর বন্ধ করে রাখার কথা বলছে তারা।
গাজায় বর্তমানে যে ত্রাণ প্রবেশ করছে, তা ‘সাগরে এক ফোঁটা পানির’ মতো বলে উল্লেখ করেন যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবিক সহায়তা সংস্থা মেডিকেল এইড ফর প্যালিস্টানিয়ানসের গাজা উপত্যকার পরিচালক ফিকর সালতুত। গাজায় নির্ধারিত ত্রাণ প্রবেশ করতে দিতে এবং সব সীমান্ত ক্রসিং খুলে দিতে ইসরায়েলকে চাপ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বিবিসিকে ফিকর সালতুত বলেন, এটি চরম নিন্দনীয় যে জীবন রক্ষাকারী ত্রাণ ও ফিলিস্তিনিদের জীবনকে দর-কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরায়েল। অথচ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, তাদের দায়িত্ব হলো ত্রাণ প্রবেশ নিশ্চিত করা।