সৌদিকে রাজি করানো ওমানের বড় সফলতা

ইয়েমেনে সংঘাত শুরু হয় ২০১৪ সালে। ২০১৫ সালে এ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট। সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলোর মধ্যে মতভেদ দূর করতে ২০১৫ সালে থেকে কাজ করছে ওমান। শেষ পর্যন্ত সৌদিকে যুদ্ধ বন্ধে রাজি করিয়েছে ওমান—যা মাসকাটের কূটনীতির বড় সফলতা

ইয়েমেনের রাজধানী সানায় ৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত শান্তি আলোচনা
ছবি: রয়টার্স

ইয়েমেনে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা করতে ৯ এপ্রিল দেশটির রাজধানী সানায় হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে বৈঠক করেন সৌদি আরব ও ওমানের প্রতিনিধিরা। দরিদ্র দেশটিতে আট বছরের বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলছে। ওমানের মধ্যস্থতায় সানায় অনুষ্ঠিত এ বৈঠক ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে অনেকের মধ্যে সতর্ক আশাবাদ তৈরি করেছে। ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধে ওমানের বিরামহীন প্রচেষ্টার বিষয়টি উঠে এসেছে আল-জাজিরার এক বিশ্লেষণে।

সম্ভাব্য সমঝোতার বিষয়ে সাধারণ মানুষ এখনো তেমন কিছুই জানে না। তবে সূত্রের ইঙ্গিত, চুক্তিতে আপাতত ছয় মাসের যুদ্ধবিরতির বিষয়টি থাকতে পারে। সীমান্ত ও বন্দরগুলো পুনরায় চালুর কথা থাকতে পারে। এ ছাড়া ইয়েমেনিদের বেতন ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টি চুক্তিতে থাকতে পারে। একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরুর আগে ইয়েমেন থেকে সব বিদেশি বাহিনী প্রত্যাহারের বিষয়টিও চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

যে ধরনের অগ্রগতির কথা শোনা যাচ্ছে, তা যদি সত্য হয়, তাহলে আলোচনার মাধ্যমে ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে ওমানের প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ বলে প্রমাণিত হবে।

আরব উপদ্বীপের ভূরাজনীতিতে ওমানের একটি অনন্য ভারসাম্যমূলক ভূমিকা রয়েছে। ওমান উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের সদস্য। দেশটি এ পরিষদের একমাত্র সদস্য, যে ইয়েমেনে সৌদির নেতৃত্বাধীন সামরিক অভিযানে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।

২০১৫ সালে সৌদির নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় ওমানকে তিরস্কার করেছিল রিয়াদ। কিন্তু সৌদি আরব এখন স্বীকার করছে, এ যুদ্ধ বন্ধের প্রচেষ্টায় মাসকাটের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
বিনা আলি-খান, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের গবেষক

ইয়েমেন সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটির বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বেশ কয়েকবার ওমানের রাজধানী মাসকাটে গেছেন। একই উদ্দেশ্যে সৌদি আরব, ইরান, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকেরা একাধিকবার মাসকাটে গেছেন। জাতিসংঘের কর্মকর্তারাও মাসকাট সফর করেছেন।

আরব সেন্টার ওয়াশিংটন ডিসির অনাবাসিক ফেলো আফরাহ নাসের আল-জাজিরাকে বলেন, ইয়েমেন ইস্যুতে শুরু থেকেই ওমান যুক্তি দিয়ে কথা বলে আসছিল। তারা প্রথম থেকেই বলেছিল, ইয়েমেনে সামরিক হস্তক্ষেপে সমাধান আসবে না; বরং শান্তিপূর্ণ কূটনৈতিক রাজনৈতিক আলোচনাতেই সমাধান আসবে। আট বছর পর ওমান প্রমাণ করছে, ইয়েমেন ইস্যুতে মাসকাটের অবস্থানই ঠিক।
ইরান-সমর্থিত হুতিদের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য এখন সৌদি আরব প্রস্তুত বলে মনে হয়। কারণ, চলমান এ যুদ্ধের ব্যয় সৌদির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইয়েমেন যুদ্ধ থেকে একটি সম্মানজনক প্রস্থানের ব্যাপারে রিয়াদকে রাজি করিয়েছে ওমান। আবার তারা হুতিদেরও একটি সমঝোতার ব্যাপারে রাজি করিয়েছে

এ প্রসঙ্গে জাপানের টোকিওর ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং অধ্যাপক আবদুল্লাহ বাবুদ আল-জাজিরাকে বলেন, সৌদি আরব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা এ যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। এ যুদ্ধ রিয়াদের জন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে খুব ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে।

দীর্ঘদিনের প্রতিপক্ষ ইরান ও সৌদি আরব গত মাসে সম্পর্ক জোড়া লাগানোর বিষয়ে একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়ার ঘোষণা দেয়। এ চুক্তিতে মধ্যস্থতা করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় চীন। এ প্রেক্ষাপটে ইয়েমেন সংকট নিরসনে সম্প্রতি যে অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে, তাতে বেশির ভাগ কৃতিত্ব বেইজিংকে দিতে চান কিছু বিশ্লেষক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বছরের পর বছর ধরে মাসকাটের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় ইয়েমেন সংকট নিরসনের ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে।

২০১৪ সালে ইয়েমেনে সংঘাত শুরু হয়। ২০১৫ সালে এ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট। সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলোর মধ্যে মতভেদ দূর করতে ২০১৫ সালে থেকে কাজ করছে ওমান।

ইয়েমেনে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত জেরাল্ড ফিয়েরস্টেইন আল-জাজিরাকে বলেন, ইয়েমেন সংঘাতের অবসান প্রচেষ্টায় ওমান একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, বিশেষ করে হুতিদের সঙ্গে খোলামেলা সংলাপ বজায় রাখার ক্ষেত্রে।
ইয়েমেন যুদ্ধ থেকে একটি সম্মানজনক প্রস্থানের ব্যাপারে রিয়াদকে রাজি করিয়েছে ওমান। আবার তারা হুতিদেরও একটি সমঝোতার ব্যাপারে রাজি করিয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের গবেষক বিনা আলি-খান বলেন, ২০১৫ সালে সৌদির নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় ওমানকে তিরস্কার করেছিল রিয়াদ। কিন্তু সৌদি আরব এখন স্বীকার করছে, এ যুদ্ধ বন্ধের প্রচেষ্টায় মাসকাটের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর মাসকাটের দৃষ্টিতে, সৌদি আরব শেষ পর্যন্ত ওমানের কথা শুনছে। আট বছর ধরে সংঘাত চলার পর এখন রিয়াদ সংকট নিরসনে কূটনৈতিক পন্থাকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

ইয়েমেন সংঘাতের অবসান প্রচেষ্টায় ওমান একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, বিশেষ করে হুতিদের সঙ্গে খোলামেলা সংলাপ বজায় রাখার ক্ষেত্রে
জেরাল্ড ফিয়েরস্টেইন, ইয়েমেনে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত

আরব সেন্টার ওয়াশিংটন ডিসির অনাবাসিক ফেলো আফরাহ নাসের বলেন, শান্তি আলোচনায় বিবদমান পক্ষগুলোর গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে ওমানের অধ্যবসায় অবশেষে ফল দিচ্ছে। শান্তি স্থাপনকারী হিসেবে কাজ করা, যুদ্ধরত পক্ষগুলোকে সরাসরি আলোচনার টেবিলে আনার পাশাপাশি ওমানের ভূমিকা এখন মুখরক্ষাকারীর মতো। যুদ্ধরত পক্ষগুলো এই তৃতীয় পক্ষের (ওমান) ভূমিকার ব্যাপারে মরিয়া, যারা সবার মুখ রক্ষা করতে পারে, যার সহায়তায় জয়-পরাজয়ের ঘোষণা ছাড়াই সংঘাতের অবসান ঘটতে পারে।